Beta
শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪
Beta
শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে আনন্দমুখর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাস

উচ্ছ্বাস আর আনন্দময় পরিবেশে রবিবার উদযাপন হলো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
উচ্ছ্বাস আর আনন্দময় পরিবেশে রবিবার উদযাপন হলো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
Picture of বিশেষ প্রতিনিধি, সকাল সন্ধ্যা

বিশেষ প্রতিনিধি, সকাল সন্ধ্যা

২৮ এপ্রিল। ক্যাডেট কলেজের ক্যাম্পাস সপ্তাহের অন্য ছয়টি দিনের মতো ছিল না। সেদিন সূর্য উঠেছিল সঠিক সময়ে। পাহাড়ঘেরা এবং সাগরের হাতছানি দেয়া সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসের মাঝখানে ঝিক ঝিক করে ট্রেন ছুটছিল। কিন্তু ক্যাডেটদের ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে দিনের সব কাজ এদিন ছিল অন্যরকম। কারণ পুরো দিনটিই ছিল ক্যাডেটদের জন্য আনন্দমুখর এবং বৈচিত্রময়। দিনটি ছিল এই ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন।

১৯৫৮ সালের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা পায়। নিউজিল্যান্ডের নাগরিক উইলিয়াম মরিস ব্রাউনের হাত ধরে এ কলেজের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এটি ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ’ নামে পরিচিত ছিল। পরে এর নাম পাল্টে এলাকার নাম ধরেই রাখা হয় ‘ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ’। প্রাথমিকভাবে সামরিক বাহিনীর জন্য যোগ্য কর্মকর্তা তৈরি করাই ছিল এ কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।

তবে এই কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেটদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্যাডেট বেসামরিক প্রশাসনেও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে দেশ সেবা করে চলেছেন। এছাড়াও দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব আন্তর্জাতিক সংস্থায় এ কলেজের ক্যাডেটরা তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

১৮৫ একর জুড়ে গড়ে উঠা এই ক্যাম্পাসের একেবারে গা ছুঁয়েই গেছে চট্টগ্রাম-ঢাকা রেললাইন। আবার চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের পাশেই সীতাকুণ্ড অতিক্রমের সময় যখন চোখ আটকে যাবে একটি শ্লোগানে “কথা নয় কাজ,” তখনই আপনি বুঝে নিবেন এটি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাস।

ক্যাডেট কলেজ থেকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার। আবার কলেজের আধা কিলোমিটার দুরেই দেখা মিলে বঙ্গোপসাগরের। ফলে ভৌগলিকভাবেই কলেজের অবস্থান একেবারে প্রাইম লোকেশনে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনটিকে ঘিরেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ আনন্দমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়। ক্যাম্পাসে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা হয়। চলে খেলাধুলা। আলোচনা। কেক কাটা। সাংস্কৃতিক আয়োজনসহ অনেক কিছু।

রবিবার ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসে এমন পরিবেশের দেখা মিলেছে। সকাল আটটা থেকেই অনুষ্ঠানের শুরু। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু হয়। যেখানে কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষকমন্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্যাডেট শিক্ষার্থী, আমন্ত্রিত সাবেক শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের উপস্থিতি দেখে যে কেউ বুঝে নিতে পারবেন তাদের পরিচয়। বর্তমান ক্যাডেটদের জন্য যেমন খাকি পোশাক ছিল, তেমনি সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা এবং অতিথিদের জন্য ছিল নির্ধারিত ড্রেসকোড। সুশৃঙ্খল সারিতেই উপস্থিত সবাই জানান দিচ্ছে ব্যক্তিজীবনে তারা কতটা শৃঙ্খল।

ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক বিকাল চারটা, তখন সবাই প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত। প্রখর রোদ, তাপে পুড়ছে সবাই। কিন্তু বর্তমান কলেজ প্রিফেক্ট অনুষ্ঠান ঘোষণা দিচ্ছিলেন তপ্তরোদে। কিন্তু তার ঘোষণা শুনে-দেখে মনেই হচ্ছিল না তাপ তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেছে।

সামিয়ানা টানানো প্যান্ডেলের একপাশে ছিল বর্তমান ক্যাডেটরা। আরেক পাশে ছিল আমন্ত্রিত অতিথি অর্থাৎ সাবেক ক্যাডেটরা। সেই প্যান্ডেল থেকে উঠে গিয়ে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ মাহিনুর আক্তার যখন বক্তৃতা মঞ্চে যাচ্ছিলেন তখন তারও পথচলা ছিল দৃপ্ত ও অবিচল।

অধ্যক্ষ নিজে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের একজন প্রাক্তন ক্যাডেট। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, “আজকে দিনটি আমাদের সবার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। এই দিনটি না আসলে ক্যাডেট কলেজের জন্ম হতো না। আর ক্যাডেট কলেজের জন্ম না হলে আমরা ক্যাডেট হতে পারতাম না।”

১৯৫৮ সালের ২৮ এপ্রিল তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ’ নামে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের ধারাবাহিকতায় দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো ১১টি ক্যাডেট কলেজ। তাই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজকে এই অঞ্চলে ক্যাডেট তৈরির সূতিকাগার হিসাবে বলা যায়।

সবচেয়ে বড় গৌরবের বিষয়; এই কলেজের প্রাক্তন ৫১ জন ক্যাডেট বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আটজন প্রাক্তন ক্যাডেট শহীদের মর্যাদা অর্জন করেছিলেন ।

মহান মুক্তিযুদ্ধে কলেজ ক্যাডেটদের অবদান-আত্নত্যাগের সেই কথা স্মরণ করিয়ে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন। যিনি স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এই কলেজে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। স্বাধীনতার পর তিনিসহ ৪২ জন ভর্তি হন। ফলে স্বাধীনতার পর তারাই ছিলেন প্রথম ব্যাচ। তাদের সবাই দেশের সরকারি-বেসরকারি-সামরিক পদে সুপ্রতিষ্ঠিত।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে বর্তমানে ২৯৬ জন শিক্ষার্থী আছে। প্রতি ব্যাচে ৫০ জন শিক্ষার্থী মেধার ভিত্তিতে ভর্তি হন। আর সপ্তম শ্রেণী থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে যারা ক্যাডেট হিসেবে পাস করেছেন তাদের একটি সংগঠন আছে, নাম ওল্ড ফৌজিয়ানস এসোসিয়েশন (ওফা)। সেই এসোসিয়েশনের সেন্ট্রাল গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন।

অনুষ্ঠানে ক্যাডেটদের উজ্জীবন করা বক্তৃতায় তিনি বলেন, “এই কলেজ ট্রেনিং, টিচিং এবং আহরিত জ্ঞান মিলিয়ে আজ এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। ফলে এই কলেজের ক্যাডেট হিসেবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ আজকের আমাকে তৈরি করেছে এই ক্যাডেট কলেজ।”

“কলেজ ক্যাম্পাসটা এতই অনন্য, বৈচিত্রময় এবং ঐতিহ্যবাহী যে এখনো ক্যাম্পাসে আসলে নিজেকে ক্যাডেটই মনে হয়,” ক্যাম্পাস নিয়ে বলেন তিনি।

সংগঠনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনটি চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আমরা ওল্ড ফৌজিয়ানস এসোসিয়েশন এগুচ্ছি। একটি হচ্ছে, ডিসেম্বরের ১২, ১৩ এবং ১‌৪ তারিখে সাবেক ক্যাডেটদের নিয়ে একটি পূণর্মিলনী অনুষ্ঠান। দ্বিতীয়ত, কলেজ ক্যাম্পাসের ঐতিহ্যকে ধারন করে নতুন নকশায় একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরী করা। তৃতীয়ত, ঢাকায় ওল্ড ফৌজিয়ানস এসোসিয়েশন (ওফা) জন্য স্থায়ী একটি অফিস (ওফা সেন্টার) তৈরি করা।”

বিকালে ক্যাম্পাসেই চলে জমজমাট বাস্কেট বল খেলা। মাঠে বসেই খেলা উপভোগ করেন ওল্ড ফৌজিয়ানস এসোসিয়েশন (ওফা) এর নেতারা এবং অন্যান্য ওল্ড ফৌজিয়ানরা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল শাহরিয়ার আকবর চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যখনই ক্যাম্পাসে আসি, তখনই মনে পড়ে ক্যাডেট জীবনের সেসব সুখস্মৃতির কথা। সপ্তম শ্রেণীতে যেহেতু বাবা-মা-পরিজন ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হই, ফলে সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র, শিক্ষকমণ্ডলী এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ- সবাইকেই পরিবারের সদস্য মনে হতো।

“ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে, প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা, পড়ালেখা এবং রাতে ঘুমানো পর্যন্ত তারাই ছিল সব। এই ক্যাডেট কলেজই আমাদের শিখিয়েছে একটি সুশৃঙ্খল জীবন। আবার শিখিয়েছে কিভাবে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে, নিজের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে কীভাবে পরিশ্রম করতে হয় তার প্রস্তুতি নিতে।”

এই অনুষ্ঠানে ওফার ঢাকা চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট সারফুল আলম এবং চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে আরও ছিল ক্যাম্পাসে বৃক্ষ রোপণ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটা-চা চক্র। বিশেষ মোনাজাত। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ভাঙে এই মিলনমেলা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত