Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

কর্পোরেট জগতের আজব দ্বন্দ্বের ফেরে কোরিয়ার ব্যান্ড বিটিএস

BTS HYBE ADOR
Picture of সৈয়দ ফরহাদ

সৈয়দ ফরহাদ

সঙ্গীতের দুনিয়ার আজব এক কর্পোরেট দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি এবং এর আইকনিক ব্যান্ড বিটিএস। অনেকে বাজার বিশ্লেষকই একে স্বাধীন শিল্প সত্ত্বা প্রকাশের বিপরীতে কর্পোরেটের বাজার ধরার কৌশলের লড়াই হিসেবে দেখছেন ।  

এ লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বিটিএস ব্যান্ড তারকাদের নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন জগতে ডালপালা মেলছে নানা গুজব। সেসব প্রশ্নবিদ্ধ করছে কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি এবং বিটিএসকে। সবশেষ এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে বিটিএস এর গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের সংগঠনও।

কী নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু

বিটিএসের রেকর্ড লেবেলের ইংরেজি আদ্যক্ষর সংক্ষেপিত নাম (ADOR) অ্যাডর। এটি আবার বহুজাতিক কোম্পানি হাইব (HYBE) এর সাবসিডিয়ারি বা অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান। এই কোম্পানিটির প্রধান মিন হি জিন, যিনি এর আগে এসএম এন্টারটেইনমেন্টে ছিলেন। মিন মূলত সঙ্গীতের ভিজ্যুয়াল এবং ধারণাগত দিকটি নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে রীতিমত একজন সেলিব্রিটি।

তার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েই অ্যাডর কোরিয়ার মেয়েদের ফ্ল্যাগশিপ ব্যান্ড দল ‘নিউজিনস’ গড়ে তোলে। বিশেষ করে ‘নিউজিনস’ এর চমৎকার শব্দপ্রকৌশল এবং নান্দনিকতা ছিল প্রথাগত কে-পপ মিউজিক থেকে একেবারে আলাদা। ফলে খুব দ্রুত সাড়া ফেলে। মূলত এটি মিনের সাফল্য। কিন্তু হাইব-এর সঙ্গে মিনের পরে সঙ্গীতের প্রচারণা কৌশল এবং শৈল্পিক নির্দেশনা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

মিন-হি-জিন

মিন সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে বহুজাতিক হাইব এর বিরুদ্ধে শৈল্পিক সত্তায় অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে হতাশা প্রকাশ করেন। তার এই অভিযোগের পরপরই বিনোদন শিল্পে দুনিয়াব্যাপী কর্পোরেট নেতৃত্ব বনাম ক্রিয়েটিভ নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের আলোচনা পুনরায় চাওর হয়ে ওঠে।

এক সাক্ষাৎকারে মিন বলেছিলেন, “অ্যাডর শুরু থেকেই একটি স্বায়ত্তশাসিত রেকর্ড লেবেল। তাই হাইব এর ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সঙ্গে কার্যত এর কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়।”

হাইব এর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে মিন বলেন, “মিউজিক ভিডিও রিলিজ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কী রিলিজ করতে যাচ্ছি সে সম্পর্কে হাইব এর কোনও ধারণাই ছিল না।”

এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় যে, মূল মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অ্যাডর কতটা বিচ্ছিন্ন! কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিতে এমন ঘটনা বিরল।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকলে দুই পক্ষই আইনি পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। আর এভাবে এই দুই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও প্রকাশ্যে চলে আসে।

মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব

হাইব বনাম অ্যাডর দ্বন্দ্ব বিনোদন জগতে অস্থিরতার পাশাপাশি কে-পপের ভবিষ্যত নিয়েও বিস্তৃত পরিসরে এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সৃজনশীলতার প্রতি মিনের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট হয় যখন তিনি বলেন, “ইপির (অ্যালবাম) চারটা ট্র্যাক নিয়ে আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। তিনটি লিড সিংগেল রাখার কারণও নিজের ওপর আস্থা আর বিশ্বাস। আমার সবসময় মনে হয়েছে , একটি লিড সিংগেলের সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেওয়া খুবই হতাশার”।

এখানে বলে রাখা ভালো, লিড সিংগেল বলতে- একটি অ্যালবামের তিনটি গানকে প্রধান গান হিসেবে আগে রিলিজ করে দেওয়া বোঝানো হয়। সাধারণত একটি অ্যালবাম রিলিজ হওয়ার আগে ইন্টারনেটের যুগে একটি গানকে প্রধান হিসেবে রিলিজ করার প্রথা রয়েছে। ফলে অ্যালবাম হিট এবং আলোচনায় ওই একটি গানই এতদিন নিয়ামক হিসেবে কাজ করতো।

কাজেই মিনের এই ভিন্নরকম কৌশল ও মন্তব্যে কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিকে ঢেলে সাজানোর আগ্রহ আর আন্তরিকতার ছাপ পাওয়া যায়।

হাইব-অ্যাডর বিরোধ মিডিয়া কাভারেজেই সীমাবদ্ধ নেই। বিনোদন মাধ্যম ছাড়িয়ে এই বিরোধ পরিণত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিতর্কে। কর্পোরেট প্রভাব এবং শিল্পীর স্বাধীনতা ভারসাম্য বজায় রাখার উপায় নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

বিস্তৃত প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা

হাইব বনাম অ্যাডর বিতর্ক কেবল কে-পপ শিল্পে কর্পোরেট আধিপত্যের চ্যালেঞ্জগুলোকেই উন্মুক্ত করে দেয়নি , বরং সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক ছাড়ের প্রশ্নে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াকেও সামনে নিয়ে এসেছে।

অ্যাডর এর অফিশিয়াল কিছু নথিপত্র ঘেঁটে এরই মধ্যে বেশ স্পর্শকাতর একটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। কোরিয়ার এই মিউজিক লেবেলটি ‘প্রজেক্ট ১৯৪৫’-কে কেন্দ্র করে ওই ঘটনার অবতারণা। ১৯৪৫ সালে জাপানের শাসন থেকে কোরিয়া মুক্ত হয়। আর এই ‘প্রজেক্ট ১৯৪৫’ হলো হাইব থেকে তাদের স্বায়ত্বশাসিত হওয়ার পরিকল্পনা! প্রকল্পের এমন নামে জনসাধারণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাদের মতে, প্রকল্পের এমন নামকরণ একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি স্পর্শকাতর ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে অ্যাডরের স্বায়ত্বশাসনকে মেলানো অনেকের কাছেই দুঃখজনক ছিল।   

এই ঘটনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি সামনে নিয়ে আসে। আর তা হলো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কৌশল নির্ধারণের সময় সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এটি কেবল ব্যবসায়িক দক্ষতার প্রশ্ন নয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক প্রত্যাশা প্রতিফলিত হওয়ারও বিষয়।

বিবৃতি এবং আইনি চ্যালেঞ্জ

উত্তেজনা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, মিন প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন যে- হাইব শৈল্পিক সততা এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের চেয়ে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

এক বিবৃতিতে মিন আরও গুরুতর অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন অ্যাডরের মেধাসত্ব হাইব অন্য এক জায়গায় ব্যবহার করেছে। স্পষ্টতই এটা চুরির অভিযোগ। তার মতে, “হাইব মুনাফার জন্য অন্ধ হয়ে গেছে।”

তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, মিন এবার তার নিজের গড়া দল ‘নিউজিন্স’ এর সৃজনশীল মালিকানা রক্ষা করার জন্য আইনি ব্যবস্থার দিকেই যাবেন।

এর প্রতিক্রিয়ায়,  হাইব একটি অডিট শুরু করেছে। পাশাপাশি অ্যাডর এর বিরুদ্ধে কর্পোরেট দখলবাজির চেষ্টা এবং গোপনীয় তথ্য অপব্যবহারের অভিযোগ এনে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা ভাবছে।

যেভাবে জড়ালো বিটিএস

ইয়োনহাপ নিউজ জানিয়েছে , হাইব এর অডিটে নাকি উঠে এসেছে বোমা ফাটানো এক খবর। হাইবের দাবি মিন হি-জিন নাকি ব্যক্তিগতভাবে বলে বেড়াচ্ছেন ব্যাং সি-হিয়াক বিটিএস গঠন করতে গিয়ে তার ধারণাই চুরি করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই, এই অভিযোগ বিটিএস এর ফ্যান গোষ্ঠী বিটিএস আর্মি ভালভাবে নেয়নি।

যদিও প্রেস কনফারেন্সে, মিন এমন কিছু বলার কথা অস্বীকার করেছেন।

কিন্তু বিবাদের জল গড়িয়েছে বহুদূর। পেয়েছে নতুন মাত্রা। রেকর্ড লেবেল অ্যাডর, বিটিএস- এর অফিশিয়াল ফ্যান বেইজ ‘বিটিএস আর্মি’ এবং বহুজাতিক বিনোদন কোম্পানি হাইব- এর মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।

ত্রিমুখী এই বিবাদে সবার আগে এসেছে বিটিএসের নাম। তাদের ফ্যানরা ব্যান্ড নিয়ে যাবতীয় ‘মিথ্যা ও নোংরা’ মন্তব্যে ভীষণ ক্ষেপে আছে। তারা মনে করছে, তাদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। আর তাই ‘আর্মি’ হাইবের বিরুদ্ধে বেশ খোলামেলা অবস্থান নিয়েছে।

আর এ কাজ করতে গিয়ে তারা ঘটিয়েছে এক অদ্ভূত কাণ্ড। পুরো এক পাতা জুড়ে সংবাদপত্রে প্রতিবাদ লিপি তো ছাপিয়েছেই, পাশাপাশি হাইব বরাবর পাঠিয়ে দিয়েছে বিশেষ ধরনের ফুলের তোড়া। কোরিয়ান সংস্কৃতিতে যার অর্থ হলো, ‘তোমাদের কাজে আমরা খুশি নই’।

বিটিএস ভক্তরা এতই ক্ষেপেছে যে তারা এমনকি বিটিএস শিল্পীদের রেকর্ড লেবেলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে স্বাধীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানায়।  

ভক্তদের দাবি কী?

গ্র্যামি মনোনিত এই বিটিএসের ভক্তদের দাবি- “হাইব  এবং রেকর্ড লেবেল বিগ হিট মিউজিককে বিটিএসের ( নিউজিন্স নকল করে বিটিএস গঠন) বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন অভিযোগগুলোকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। শুধু তাই নয়, এই অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে তাদের আইনি লড়াইয়েও যেতে হবে। আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে এর অগ্রগতিও জানাতে হবে ।”

জানা যায়, হাইব বনাম অ্যাডর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাচ্ছে শিল্পীদের নাম। এসব নিয়ে রটছে অনেক উড়ো খবর। শিল্পীদের নিয়ে গুজবও ছড়াচ্ছে দিগ্বিদিক।

ফলে মহাবিরক্ত বিটিএস ফ্যানেরা প্রয়োজনে সম্পর্ক ছেদ করতে বলছে হাইবের সঙ্গেও।

‘বিটিএস’ শিল্পীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধের দাবি

এইসব প্রতিবাদলিপি এবং বিক্ষুদ্ধ চিঠির অনেকটাই আবার হাইব এর চেয়ারম্যান বাং সি হিয়াং-কে উদ্দেশ্য করে লেখা। যেখানে হাইব-অ্যাডর চলমান দ্বন্দ্বে বিটিএস শিল্পীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধের দাবি জানানো হয়। ব্যঙ্গ করে লেখা হয়, “ইন্ডাস্ট্রির এক নম্বর অযোগ্য এজেন্সি হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন”।

বাং-সি-হিয়াং

অন্য আরেক ভক্ত লিখেছেন, “হাইবের চেয়ারম্যান এবং সিইও এর  উচিত হবে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিটিএসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা এবং চলমান সংকটের নিরসন করা।”

ছড়িয়ে গেছে গুজবের ডালপালা

হাইব-অ্যাডর দ্বন্দ্বে গুজব ছড়িয়েছে বহুদূর। এই দ্বন্দ্বের মাঝেই বিটিএস শিল্পীদের জড়িয়ে বেরিয়েছে নানা ‘উড়ো’ তথ্য। বলা হচ্ছে, মেয়েদের গানের গ্রুপ ‘নিউজিন্স’ এর সাফল্যের পথেও নাকি কাঁটা বিছিয়েছে তারা। অভিযোগ উঠেছে, বিশ্বব্যাপী সঙ্গীত র‌্যাংকিংয়ের জন্য খ্যাত বিলবোর্ডের চার্টে কারসাজি করে এমন একটি গোষ্ঠীর আস্তানাতেও নাকি বিটিএস তারকাদের নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে।   

আর এইসব গুজব রটছে এমনই এক সময়ে, যখন বিটিএস সদস্য জিন, আরএম, জিমিন, জাংকুক, তাইহিয়াং সুগা এবং জে-হোপ দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে সেই দেশের সেনাবাহিনীতে তাদের রুটিন সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন।

শোনা যাচ্ছে, বিটিএস তারকারা ফিরে আসার পর হাইব তাদের আগমন নিয়ে বড়সর এক ইভেন্টের আয়োজন করবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত