Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

অনুদানে নির্মিত সিনেমা নিয়ে কেন খেপেছে রাশিয়ার সরকারপন্থিরা

দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা।ছবি- বিবিসি
দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা।ছবি- বিবিসি
Picture of সৈয়দ ফরহাদ

সৈয়দ ফরহাদ

বক্স অফিসে হিট সিনেমা ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড দ্য মার্গারিটা’। কিন্তু তা হলে কী হবে! এটি পরিচালনার জন্য ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অভিযোগ জুটেছে পরিচালক মাইকেল লকশিনের ভাগ্যে, যা নিয়ে ভালোই বিপদে আছেন তিনি।

রাষ্ট্রীয় তহবিলের অর্থায়নে নির্মিত এ সিনেমাটি নিয়ে খেপেছে খোদ রাশিয়ার সরকারপন্থিরাই।

হতাশা জানিয়ে পরিচালক মাইকেল লকশিন বলেছেন, “আমরা যখন নিষিদ্ধ এক লেখকের চরিত্র নির্ভর সিনেমাটি করার প্রস্তাব দিই- তখন সেন্সরশিপের এতো বাধ্যবাধকতা ছিল না, এখন যেমনটা রয়েছে। এটা কল্পনা করাও কঠিন যে, মাত্র তিন বছর আগেও আমরা সম্পূর্ণ অন্য এক পরিস্থিতিতে ছিলাম।”

আমেরিকান পরিচালক লকশিন শৈশবের বেশিরভাগটা কাটিয়েছেন মস্কোয়। রাশিয়ার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হর্তাকর্তাদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল। লকশিনের ওপর তাদের আস্থা এতোটাই বেশি ছিল যে, ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’র নির্মাণে ৪০ শতাংশ অর্থায়ন রাশিয়া সরকারই করেছে।

স্টালিনের আমলে লেখা মিখাইল বুলগাকভের লেখা উপন্যাস ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মারগারিটা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে লকশিনের সিনেমাটি । ১৯৩০ এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইরত একজন লেখকের সংগ্রাম ছিল এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য।

রাশিয়ার সরকার ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড দ্য মার্গারিটা’র অর্থায়ন করে ২০২০ সালে। তখনও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হয়নি। কয়েকমাস আগে এটি মুক্তি পায় রাশিয়ার বিভিন্ন সিনেমা হলে।

তবে এ কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি এতোটাই বদলেছে যে, লকশিনের শঙ্কা হলো- রাশিয়ায় পা রাখামাত্রই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তার ভাষায়, “তারা আমাকে ‘ক্রিমিনাল’ বলছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তারা আমাকে সন্ত্রাসী বলতেও ছাড়েনি।”

এই ‘তারা’ যে পুতিনপন্থিরা সে কথা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলতে ভোলেননি লকশিন।

দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা ২০ শতকের সর্বাধিক পঠিত রাশিয়ান উপন্যাস গুলোর একটি। ছবি-বিবিসি

বিপত্তির নেপথ্যে কী ছিল

বিপত্তির শুরু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। যখন রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হয়। লকশিন তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে বসে সিনেমাটির সম্পাদনার কাজ করছিলেন। হামলার ঘটনায় চুপ থাকতে না পেরে লকশিন ইউক্রেইনের সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বসেন। এতে যা হওয়ার তাই হলো। সিনেমাটি রাশিয়ায় রিলিজ দিতে বহু ঝক্কি পোহাতে হলো।

শেষমেশ মাস দুই আগে সিনেমাটি রাশিয়ায় রিলিজ পেল। তবে সিনেমাটির প্রচারণায় কোথাও লকশিনের নাম দেওয়া হয়নি।

সিনেমা মুক্তির পরপরই যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রাম এর একটি চ্যানেলে লকশিনকে ‘রাশিয়াফোব’ বলে উল্লেখ করা হয়। আর ‘কল অব দ্য পিপল’ নামের ডানপন্থি একটি দল দাবি জানায়, “মিথ্যা প্রচারের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করে’ লকশিনকে বিচারের আওতায় আনতে।

টেলিভিশন উপস্থাপক ভ্লাদিমির সলোভিওভ তার এক শোতে প্রশ্ন তুলেছেন- “কিভাবে এই দেশ বিরোধী সিনেমা ছাড়পত্র পেল?” আরেক প্রেজেন্টার টিগ্রান কিওসায়ান আরও এক কাঠি সরেস। তার দাবি, সিনেমাটি কিভাবে নির্মিত হয়েছিল তার তদন্ত হওয়া উচিৎ। উল্লেখ্য যে, টিগ্রান কিওসায়ানের স্ত্রী আবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।

সিনেমাটির নির্মাণ পরবর্তী কাজ চলার সময় রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হয়। ছবি – বিবিসি

রাশিয়ার একজন প্রযোজক ইভান ফিলিপভ কিছুদিন আগেই বিবিসিকে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “কোনও সিনেমার প্রচারণা নিয়ে এমন উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রতিক্রিয়া এর আগে রাশিয়ায় দেখা যায়নি।”

সিনেমা রিলিজ দিতে গিয়ে লকশিন নিজেই হয়তো একই রকম নিপীড়নের মুখোমুখি হচ্ছেন। পর্দায় কিংবা বাস্তবে যা যা হচ্ছে, স্টালিনের রাশিয়া এবং সমকালীন রাশিয়ার পরিস্থিতির মিল যেন পরিষ্কার ফুটে উঠছে।

১৯৮৬ সালে লকশিনের পরিবার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে আবাস গড়ে। লকশিনের বয়স তখন মাত্র পাঁচ। সে সময় কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতি থাকার কারণে তার বাবা এফবিআইয়ের কাছে ব্যাপক হেনস্তারও শিকার হন। আর অন্যদিকে তারা মস্কোতে পৌঁছালে সেখানে নাকি এক উৎসবমূখর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাঠ চুকিয়ে লকশিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায় পালা করে বসবাস করতে থাকেন। তবে ২০২১ সালে চলে আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসে।

‘সিলভার স্কেটস’ (২০২০)  আর নির্মিত প্রথম সিনেমা। যেটি নেটফ্লিক্সের প্রথম রাশিয়ান ভাষার সিনেমা। ‘সিলভার স্কেটস’ রাশিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।  

বুলগাকভের এই অসাধারণ উপন্যাসটি রাশিয়ার বাইরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। আমেরিকান সিংগার সংরাইটার প্যাটি স্মিথ এবং কিংবদন্তী ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ‘রোলিং স্টোন’ এর ফ্রন্ট ম্যান মাইক জ্যাগারও এই উপন্যাসের অনুরাগী ছিলেন। এই উপন্যাসের অনুপ্রেরণায় ‘রোলিং স্টোন’ এর বিখ্যাত গান ‘সিম্প্যাথি ফর দ্য ডেভিল’ এর সৃষ্টি।  

বহু শিক্ষিত রাশিয়ানের মতোই, লকশিন ছোটবেলায় বইটি পড়েছিলেন। অ্যাবসার্ডিস্ট কমেডিতে ভরপুর এই সিনেমায় তৎকালীন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের প্রতি ছিল সমালোচনা।    

লকশিনের প্রযোজক যখন তাকে এই উপন্যাস থেকে সিনেমার পান্ডুলিপি বানাতে বলেন, তখন লকশিন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন তার সহ-লেখক রোমান কান্টরের সঙ্গে।

দুজনে মিলে ঠিক করলেন লেখক বুলগাকভের সংগ্রাম এবং উপন্যাসের গল্প, দুটোর সমন্বয়ে গল্পটি তৈরি করবেন।

লেখক বুলগাকভের নাটকগুলোও তৎসময়ে প্রসংশিত (১৯৩০ এর দশকে) হয়েছিল। যদিও সেগুলো স্টালিনের নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ হয়ে যায়।

১৯২৮ সাল থেকে লেখা শুরু হয় উপন্যাস ‘দ্য মাস্টার এবং মার্গারিটা’। ১৯৪০ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বুলগাকভ উপন্যাসটি সংশোধন করেন। কারণ তিনি জানতেন স্টালিনের আমলে তার এই বই কোনদিন প্রকাশিত হবে না।

পরে সংশোধিত একটি সংস্করণ ১৯৬৬ সালে রাশিয়ান একটি ম্যাগাজিনে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল।

গল্পটিতে খুব স্পষ্টভাবে কর্তৃত্ববাদ বিরোধী বক্তব্য থাকার পরও লকশিন সিনেমার কাজ শুরু করেন। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়েও তিনি খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না।

এ বিষয়ে তার বক্তব্য “ আমরা একজন লেখকের গল্প বলতে চেয়েছি যাকে পদে পদে সেন্সর করা হয়েছে। এই লেখক স্টালিনের সময়ের। স্টালিন যুগ দমন-পীড়ন এবং ভয়ের । আজকের পুতিনের রাশিয়ার সাথেও বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক। আজকের মতো সেন্সরশীপ নিকট অতীতে কখনোই ছিলনা। মাত্র তিন বছর আগেও আমরা যেন এক অন্য জগতের বসিন্দা ছিলাম। সব যেন কল্পনা”

সিনেমায় স্টালিন যুগের সেন্সরশিপ উঠে এসেছে। ছবি- বিবিসি

সিনেমাটি রাজনীতি এবং ফ্যান্টাসির এক ঘোরলাগা সংমিশ্রণ। এটি টেরি গিলিয়ামের ‘ব্রাজিল’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়। সিনেমার অন্যতম চরিত্র মাস্টার। সিনেমায় দেখানো হয় রাষ্ট্রের কাছে মাস্টার হেনস্তা হচ্ছে। তার লেখা নাটকগুলো কর্তৃপক্ষ একে একে বন্ধ করে দেয়।

২০২২ এর পুরোটা জুড়ে সিনেমাটি নিয়ে লকশিন ছিলেন চরম অনিশ্চয়তায়। রাশিয়ার ইউক্রেইন আক্রমণ তার সিনেমা মুক্তিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। সিনেমাটি বিতরণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে তাদের নাম সরিয়ে নেয়।

লকশিনের আলাপেই জানা যায়, তার প্রযোজক তাকে সে সময় বলেছিলেন, “আপনি একজন ক্রিমিনালে পরিণত হতে যাচ্ছেন।” কারণ- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউক্রেইনের সমর্থনে তার পোস্ট।

বাস্তব পৃথিবীর রাজনীতি বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমাটিও যে এমন অস্থির পরিস্থিতিতে পড়বে তা কে জানতো!

‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’র একটি দৃশ্যে দেখা যায় লেখক মাস্টারকে রাইটার্স ইউনিয়নের ট্রাবুনালে দাঁড় করানো হয়েছে। যেখানে সমালোচকরা তার স্টালিন বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য নিন্দা করে যাচ্ছে। এই দৃশ্যের মধ্য দিয়েই লকশিন এবং আজকের রাশিয়ার অবস্থানই যেন ফুটে উঠেছে।

দৃশ্যটি সম্পর্কে লকশিন জানান, স্টালিন যুগের বিচার ব্যবস্থার ঐতিহাসিক দলিলের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছে দৃশ্যটি।

রাশিয়ার নির্বাসিত চলচ্চিত্র সমালোচক অ্যান্টন ডলিন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, “রাশিয়া যে ঐতিহাসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে এই দৃশ্য কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।”

তারপরও সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত যে মুক্তি পেল তা বেশ আশ্চর্যের বিষয়। লকশিনের মতে “একদিন হয়তো আমরা জানব সত্যি কী ঘটেছিল”।

সিনেমাটির প্রচুর নিন্দা পেলেও লকশিনকে আজ অবধি অফিসিয়ালি কিছু জানানো হয়নি। তিনি ধারণা করছেন, রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মানের কারণে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার হয়তো দরকার ছিল। নতুবা কর্তৃপক্ষ হয়তো বিব্রত হতো।

তাছাড়া সিনেমাটি নির্মাণের সময় থেকেই যথেষ্ট আলোচনা চলছিল ফলে দর্শকদের প্রত্যাশাও অনেক বেশি ছিল।

মুক্তির দিন সিনেমাটি বহু দর্শকের মনযোগ কেড়ে নেয়। রাশিয়ান এক প্রযোজক জানিয়েছেন, সিনেমাটি দেখার সময় হলে দর্শকদের তিনি উল্লাস করতে দেখেছেন।

তিনি বলেন, “কর্তৃত্ববাদী এবং দমন পীড়নবাদী রাষ্ট্রবিরোধী বার্তা আছে এমন সিনেমা দেখতে পেয়ে দর্শকরা বেশ খুশি।”

তার মতে “এমন সাড়া জাগানো এই চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হলে উল্টো খুব অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।”

সিনেমাটির পেছনে এখন পর্যন্ত ১৭ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। রাশিয়ার বক্স অফিসে এটি ২৬ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা কিনা প্রত্যশার চাইতেও বেশি।

লস অ্যাঞ্জেলেসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকা লকশিন অবশ্য মনে করছেন না তিনি নির্বাসনে আছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া দুই দেশেই তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

তবে সত্যিটা তিনি বলেই ফেলেছেন-

“এটা সত্য যে, আমার পক্ষে অদূর ভবিষ্যতেও আর রাশিয়ায় ফিরে যাওয়া সম্ভন নয়। এটা খুবই পরিহাসের বিষয় যে রাশিয়ার ক্ষমতাশীলরা আমার পেছনে লেগেছে। এটা খুব ভীতিকরও। তবে আমি ভাবছি এই পরিস্থিতিতে বুলগাকভ কী করতেন?  তিনি হয়তো হো হো করে হাসতেন।”

সূত্র: ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা: দ্য রাশিয়ান বক্স অফিস হিট দ্যাট ক্রিটিসাইজড দ্য স্টেট’, বিবিসি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত