অ্যাস্ট্রাজেনেকা যখন তাদের কোভিড টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা স্বীকার করেছে, তখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, কারও কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না—তার প্রমাণ পেতে হবে।
ব্রিটিশ-সুইডিশ বহুজাতিক কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা সম্প্রতি স্বীকার করেছে, তাদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার কারণে বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। উদ্বৃত্তের কথা বলে তারা বাজার থেকে তাদের সব টিকা তুলেও নিচ্ছে। এই টিকা তারা আর উৎপাদন করবে না বলেও জানিয়েছে।
দ্য টেলিগ্রাফ প্রথম তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, অ্যাস্ট্রাজেনেকা আদালতে স্বীকার করেছে, তাদের টিকা নিলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। এছাড়া রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণও কমে।
গত ৪ মে বিশ্ববাজার থেকে নিজেদের টিকা প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিয়েছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর দুদিন পর ৭ মে তা মঞ্জুর করে ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ)।
তবে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিডের টিকা গ্রহণকারীদের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না—তা খুঁজে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
তিনি বলেছেন, “পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোনও প্রমাণ পেলে ওইসব টিকা দেওয়া হবে না। তবে যতক্ষণ সেরকম কোনও প্রমাণ না পাব, ততক্ষণ আমরা এই টিকা উঠিয়ে নেব না।”
বুধবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ওই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তিনি শুনেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এ ধরনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলছে, তাদের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে চিকিৎসকরা থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম (টিটিএস) বলছেন। টিটিএসের ফলে মানুষের রক্ত জমাট বাঁধে ও প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে যায়।
কোম্পানিটির এই স্বীকারোক্তির পর ৭ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারি সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারের জন্য আর অনুমোদিত নয়।
ইএমএর ঘোষণার পরপরই বিশ্ববাজার থেকে নিজেদের উৎপাদিত কোভিড টিকা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সামন্ত লাল সেন বলেন, “আমি ডিজি হেলথকে নির্দেশ দিয়েছি। যাদেরকে এই টিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর সার্ভে করে আমাকে প্রতিবেদন দেবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রমাণ না পাব, ততক্ষণ আমরা এই টিকা উঠিয়ে নেব না।”
অ্যাস্ট্রাজেনেকা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কোভিড টিকা উৎপাদন করে, যার ব্র্যান্ড নাম ভ্যাক্সজেভরিয়া। এরপর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট সেই টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স পায়। তারা কোভিশিল্ড নামে সেই টিকা বাজারজাত করে।
সেরামের টিকা কোভিশিল্ড বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের কথা জানানো হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ঠিক তার পরের বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে শুরুতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই দেওয়া হয়।
পরে চীন থেকে আসে সিনোফার্মের টিকা, কোভ্যাক্স থেকে মার্ডানার টিকাও আসে। চতুর্থ ডোজে বয়স্কদের দেওয়া হয় ফাইজারের টিকা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ কোটি ৯ লাখের বেশি টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ১৪ কোটি ২২ লাখের বেশি মানুষ। তৃতীয় ডোজ নিয়েছে ৬ কোটি ৮৬ লাখের বেশি মানুষ। আর চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন ৫১ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি মানুষ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার। সব ডোজ মিলিয়ে ২০ কোটি ৭৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৭ জনকে দেওয়া হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।
যুক্তরাজ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে ৫১টিরও বেশি মামলা করা হয়েছে। এই মামলাগুলোতে অভিযোগ করা হয়েছে, কোম্পানিটির তৈরি কোভিড-১৯ টিকা কয়েকজনের মৃত্যু ও অনেকের গুরুতর স্বাস্থ্যহানির কারণ।
কোভিশিল্ড টিকা নিয়ে ভারতেও এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় তার পরিবার বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।
তবে টিকা প্রত্যাহারের বিষয়ে এক বিবৃতিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানায়, কোভিড-১৯ ভ্যারিয়েন্টকে মোকাবিলার মতো নতুন টিকা বর্তমানে বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। ফলে কোভিশিল্ডের চাহিদা কমেছে। এজন্য এই টিকা তৈরি বা সরবরাহ করা হবে না।
২০২০ সালে দেশে দেশে কোভিড মহামারীর রূপ নিলে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার (এসআইআই) সহযোগিতায় ভারত সরকারের কাছে কোভিশিল্ড টিকা সরবরাহ করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু ও শারীরিক জটিলতার অভিযোগে যুক্তরাজ্যে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণের দাবিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলা চলছে।