তীব্র তাপপ্রবাহ যখন বইছে, তখন একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য জলাশয়েরর পাশে গাছের ছায়া খোঁজেন সবাই। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তা মেলাই ভার।
বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি শহর বাসযোগ্য রাখতে মোট ভূমির ১০-১২ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়।
৩৬০ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা মহানগরীতে (সিটি করপোরেশন এলাকা ধরে) ১৯৯৫ সালেও মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি জলাভূমি ছিল। কিন্তু তা কমতে কমতে এখন ২ শতাংশের নিচে নেমেছে।
একটি শহরের বসবাসের যোগ্য হতে বৃক্ষ আচ্ছাদিত বা সবুজ এলাকা কম করে হলেও ১৫ শতাংশ প্রয়োজন। কিন্তু এখন ৮ শতাংশের বেশি নেই সবুজ এলাকা।
অন্যদিকে গত ২৮ বছরে ঢাকা শহরে কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ঢাকা শহরের বিপদ আরও বাড়বে। অবিলম্বে দখলকৃত জলাধারগুলো উদ্ধার করতে হবে। বাড়াতে হবে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না।
সবুজ হারাচ্ছে যেভাবে
ঢাকার সবুজ এলাকা কমার পেছনে পার্কগুলো কংক্রিটে আচ্ছাদিত করা, খেলার মাঠ দখল করে হাটবাজার ও ক্লাব স্থাপন এবং গাছ কাটাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকার সবুজ এলাকা সবচেয়ে বেশি কমেছে বলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালের এক গবেষণায় উঠে আসে।
তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গ কিলোমিটারে বেশি। পরের পাঁচ বছরে এটি বেড়ে ৬০ বর্গকিলোমিটার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু এরপর কমতে থাকে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে ঢাকা শহরে (নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন) সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫৩ দশমিক ১১ বর্গ কিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা কমে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
সবুজ কমার প্রভাব তাপমাত্রায় কতটা পড়ছে, তা দেখা যায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে।
গবেষকরা ঢাকার উষ্ণতম স্থান এবং শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে দিন ও রাতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান হতাশা প্রকাশ করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের উন্নয়ন মনস্তত্ত্বে সবুজের জায়গা হয়নি। কিন্তু এই সবুজ আমাদের জীবনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই কথাটা বোঝাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি সরকারকে।”
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবুজ এলাকা ধ্বংসের একটি নজির হিসাবে তিনি ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেইটের একমাত্র উন্মুক্ত এলাকা আনোয়ারা উদ্যানে মেট্রোরেলের প্রকল্প অফিস ও ইয়ার্ড স্থাপনকে দেখান।
“এখন সেখানে মেট্রো প্লাজা বানানো হচ্ছে। আমাদের তো সবুজ দরকার ছিল। আমরা মেট্রো রেলের প্লাজা দিয়ে কী করব?”
বিভিন্ন পার্কে স্থাপনা নির্মাণের দিকটি তুলে ধরেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা কয়েকদিন আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার তাণ্ডব দেখেছি। আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে পুরান ঢাকার ধূপখোলা মাঠে আজকে মার্কেট বানানোর তোড়জোড় চলছে।
“প্রত্যেকটি পার্কে কংক্রিটে আচ্ছাদিত রেস্টুরেন্ট, লাইব্রেরি বানানো হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানে যে সবুজ ছিল, তা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। একটি শহরে কেন সবুজ দখল করে বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করতে হবে। এজন্য আমাদের কেন বারবার মামলা করতে হবে?”
আদিল খান বলেন, “যতটুক সবুজ বাকি আছে, তার প্রত্যেকটি ইঞ্চি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। সবুজ তো বাড়াতেই হবে, তার সাথে যতটুকু আছে তাও রক্ষা করতে হবে।”
পরিকল্পনা করে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। একইসঙ্গে ঢাকাকে কেন্দ্র করে আশে পাশে সবুজ অঞ্চল বানানোর পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শও তিনি দেন।
সবুজ বাড়াতে ছাদ বাগানের যে টোটকা দেওয়া হচ্ছে, তাতে খুব একটা ফল আসবে না বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল খান।
তিনি বলেন, “বাসার ছাদে গাছ লাগালে মনের খোরাক হয়ত মিটবে, কিন্তু বড় কোনও লাভ হবে না। ছাদে তো আপনি বৃক্ষ মানে বড় গাছ তো লাগাতে পারবেন না।”
জলাধার কমে বেড়েছে কংক্রিটের আচ্ছাদন
বিআইপির গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে ঢাকায় জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। পরের পাঁচ বছরে ওই জলাভূমির ১১ দশমিক ৮২ বর্গ কিলোমিটার ভরাট করা হয়। মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভরাট হয় গত ২৮ বছরে।
গবেষণায় ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই ২৮ বছরের মধ্যে জলাভূমি সবচেয়ে বেশি ভরাট হয়েছে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে। এখন জলাধার আছে কেবল ৪ দশমিক ২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায়।
তবে গত আট বছরে জলাধার ভরাটের হার কমেছে উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে শূন্য দশমিক ৪৪ বর্গ কিলোমিটার জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে।
জলাধার কমার বিপরীতে গত ২৮ বছরে ঢাকা শহরে কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে বলে বিআইপির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা (অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে এমন এলাকা) ছিল ৬৪ বর্গ কিলোমিটারের মতো। সেটি বেড়ে এখন প্রায় ১১৩ বর্গ কিলোমিটার হয়েছে।
এর ফলে যে গরমের তীব্রতা বাড়ছে, সেই দিকটি দেখিয়ে আদিল খান বলেন, “আমরা সবুজ হারিয়েছে, কিন্তু শহরে কংক্রিট বেড়েছে। এখন বড় বড় বিল্ডিং হচ্ছে, শহরের উষ্ণ হওয়ার এটাও বড় একটি কারণ।”
বেলার প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান বলেন, শুধু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দায়ী করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
“দায়ী আমরাই। আপনি যদি একটি বড় গাছের নিচে দাঁড়ান, তাহলে আপনার গরম কম লাগবে, একটি উঁচু সিলিংয়ের রুমে থাকেন, তাহলেও গরম কম লাগবে। গাছ ধ্বংস করে দেওয়া, ভূলভাবে ভবনের ডিজাইন অনুমোদন করা কিংবা শহরকে কংক্রিটে আচ্ছাদিত করে ফেলা, সবই আমাদের ভূল।”
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করে তিনি ঢাকার পাশে গাজীপুরের শালবন ধ্বংসকে নজির হিসাবে দেখান।
রিজওয়ানা বলেন, “শালবনের একটি অংশ সরকারিভাবে বন হিসেবে স্বীকৃত, আরেকটি অংশ বনের মতো হলেও তা বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত নয়। এখন সেই জায়গায় রাজউক পূর্বাচল দ্বিতীয় ফেজের আবাসনের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে বড়লোকদের প্লট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজউক। আমাদের ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে রাজউক কিন্তু এভাবে ভূমিকা রাখল।
“পূর্বাচলের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে রাজউক যত টাকা দিয়েছে জমি অধিগ্রহণের জন্য, তার থেকে বেশি টাকা দিয়েছে গাছের ক্ষতিপূরণের জন্য। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে রাজউক কী পরিমাণ গাছ সেখানে ধ্বংস করেছে।”
এর বাইরে রাজউকের আশুলিয়ার বন্যা প্রবাহ এলাকায় আরেকটি আবাসন প্রকল্প নেওয়ার তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, “এটার নাম তারা দিয়েছে লেক সিটি। এখানে ৩০ ভাগ ভরাট হবে, বাকি ৭০ ভাগ জলাশয় থাকবে। এগুলোর কোন মানে হতে পারে?”
শহরে সবুজ এবং জলাশয় ধ্বংসের জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের প্রশ্রয়ে থাকা ভূমিদস্যুদের দায়ী করেন রিজওয়ানা।