Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

হজযাত্রী কমার কারণ কি বিমান ভাড়া

বাংলাদেশ থেকে এবছর হজে যাচ্ছে ৮৫ হাজার ২৫৭। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ থেকে এবছর হজে যাচ্ছে ৮৫ হাজার ২৫৭। ফাইল ছবি
Picture of অনিক রায়

অনিক রায়

সুযোগ ছিল ১ লাখ ২৭ হাজারের, কিন্তু হজযাত্রী তত সংখ্যক পাওয়া যায়নি। ফলে এবারও কোটা পূরণ না করেই বাংলাদেশ থেকে শুরু হচ্ছে হজযাত্রা।

হজযাত্রীদের নিয়ে ঢাকা থেকে প্রথম ফ্লাইট বৃহস্পতিবার উড়বে। তার আগে বুধবার ঢাকার আশকোনায় হজ ক্যাম্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ক্যাম্প থেকেই ধাপে ধাপে বিমানে চড়বেন হজযাত্রীরা।

জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী জুন মাসের ১৬/১৭ তারিখে হজ হতে পারে। তার আগে বৃহস্পতিবার হজ ফ্লাইট শুরু হয়ে চলবে ১০ জুন পর্যন্ত। মোট ২২৮টি ফ্লাইটে হজযাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার পর ২১ জুন শুরু হবে ফেরার যাত্রা।

সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের হজ পালনে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

তবে হজ ক্যাম্প উদ্বোধনের পর বুধবার দুপুর পর্যন্ত সরকারি হজের পোর্টালে দেখা যায়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় নিবন্ধন করেছেন ৪ হাজার ৩১৯ জন, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৭৮ হাজার ৮৯৫ জন।

তাতে এবার হজযাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ২১৪ জন।

ধর্ম মন্ত্রণালয় এবারের হজযাত্রীর সংখ্যা ৮৫ হাজার ২৫৭ জন জানাচ্ছে। পোর্টালে কম দেখানোর ব্যাখ্যায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছে, তালিকা হালনাগাদ হলেই সংখ্যাটি কিছুটা কম দেখাচ্ছে।

গত বছরও কোটা অনুযায়ী হজযাত্রী যায়নি বাংলাদেশ থেকে। নিবন্ধনের সময় বার বার বাড়ানোর পরও কোটার চেয়ে সংখ্যাটি ৫ হাজারের মতো কম ছিল। তার আগের বছর ২০২২ সালে কোটা পূরণ হয়েছিল।

খরচ বাড়ছে, কমছে হজযাত্রী

হজে গমনেচ্ছু কমে যাওয়ার জন্য খরচ বেড়ে যাওয়াকেই মূল কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে।

২০২২ সালে যখন কোটা পূরণ হয়েছিল, তখন বাংলাদেশ থেকে হজের খরচ ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

গত বছর এক ধাক্কায় খরচ ২ লাখ টাকার বেশি বেড়ে যায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের খরচ নির্ধারণ হয় ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা।

এবার খরচ ৯০ হাজার টাকার মতো কমলেও হজযাত্রী গতবারের চেয়েও কমেছে।

এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যাওয়ার সর্বনিম্ন প্যাকেজ ৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, বেসরকারিভাবে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকার।

ধর্ম মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের হজের খরচের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায় বাড়ি ভাড়া, বিমান টিকেট ও সার্ভিস চার্জ আগের বছরের চেয়ে কমানো হয়েছে। পরিবহন ব্যয় বা ভিসা ফির মতো খরচগুলো আগের মতোই রয়েছে। 

এ বছর বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪১০ টাকা, গত বছর যেখানে ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল।

গত বছর তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ-কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সেবার সার্ভিস চার্জ ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা ছিল। এবার এই খাতে খরচ ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৪ টাকা।

বিমান ভাড়াই বেশি

বারবার সময় বাড়িয়েও কোটা পূরণ না হওয়ার জন্য অতিরিক্ত বিমান ভাড়াকেই দায়ী করছে হজ এজেন্সিগুলো। তারা বলছে, বিমান ভাড়া বাবদ যে টাকা ধরা হয়েছে, তা আরও অন্তত ৫০ হাজার টাকা কমানো যেত।

ভাড়া নির্ধারণের একক দায়িত্ব থাকে বাংলাদেশ বিমানের। এখানেই সমস্যা দেখছে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)।

অন্য সময়ে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবের বিমান ভাড়া ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে থাকে। কিন্তু হজের সময় ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ থেকে এবার অধিকাংশ হজযাত্রী পরিবহন করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এছাড়া সৌদি আরবের দুটি বিমান সংস্থাও যাত্রী পরিবহন করবে।

হজ এজেন্সির এক কর্মকর্তা বলেন, যার বিমানে যাবে, তারা ভাড়া ঠিক করলে, তা কখনও বাস্তবসম্মত হবে না।

এদিকে বিমানের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লাইটগুলো শুধু হজের জন্য বিশেষ বরাদ্দকৃত হয়। হজযাত্রী নিয়ে তাদের খালি উড়োজাহাজ নিয়ে ফিরতে হয়। ফলে ভাড়া কমানো যায় না।

বাংলাদেশ বিমানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “এবার যে খরচ ধরা হয়েছে, তা সবচেয়ে কম। এসময় অনেক বার আমাদের খালি ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয়। এজন্য স্বাভাবিক অবস্থার সাথে হজ ফ্লাইটের তুলনা করলে চলবে না। খরচ সেটাই ধরা হয়েছে, যাতে লোকসান এড়ানো যায়, সেভাবেই।”

জেট ফুয়েল ও ডলারের দাম বৃদ্ধিও বিমান ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে দেখাচ্ছেন এই কর্মকর্তা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার হজযাত্রার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।

গত বছরের ৫ নভেম্বর হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিল হাব। সেখানে সরকার নির্ধারিত বিমান ভাড়া ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার আবেদন তারা করেছিল।

হাবের সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একথা ঠিক যে অন্য সময়ের সাথে হজের সময়কে মেলানো যাবে না। কিন্তু তাও ভাড়ার একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন।”

এজন্য তিনি ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব এককভাবে বিমানের হাতে না রাখার পরিবর্তে একটি ‘টেকনিক্যাল কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেন।

তসলিম বলেন, “ভাড়াটা এককভাবে বাংলাদেশ বিমান ঠিক করে। এখানে তো আমাদের অংশগ্রহণ দরকার। সবার মিলে এসব প্যাকেজের খরচ ঠিক করা উচিৎ।

“একটা স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি করা উচিৎ। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে যেখানে বাংলাদেশ বিমানের প্রতিনিধিরাও থাকবে এবং হাবের প্রতিনিধিরাও থাকবে। তারা বিচার-বিশ্লেষণ করে বাস্তবিক একটা ভাড়া নির্ধারণ করবে।”

স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি করা যায় কি না- জানতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুশাখার যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা তো আমার সিদ্ধান্তের বিষয় না। সরকার যদি মনে করে তাহলে হবে। যেভাবে গাইডলাইন তৈরি হবে সেভাবেই আমরা কাজ পরিচালনা করব।”

পরিবহনে ৩ বিমান সংস্থা

হজযাত্রী পরিবহনের জন্য এবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমানের সঙ্গে রয়েছে সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা সৌদিয়া এবং সেদেশের বেসরকারি সংস্থা ফ্লাই নাস।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, এবার হজ ধরে বাংলাদেশ বিমানের সর্বমোট ফ্লাইট ১১৮টি, সৌদিয়ার ৭৫টি এবং ফ্লাই নাসের ৩৫টি।

কিন্তু বুধবার দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের বুকিং হয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ। যেখানে সৌদিয়ার ৮৪ শতাংশ এবং ফ্লাই নাসের ৪৭ শতাংশ বুকিং হয়ে গেছে।

হজযাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশ বিমান সর্বোচ্চ পরিবহন করতে পারবে ৪৮ হাজার ৮৩৫ জন, সৌদিয়া ৩০ হাজার ৭৯১ জন এবং ফ্লাই নাস ১৩ হাজার ৭৬৫ জন।

সৌদি আরবে প্রতি বছর ২৫ লাখের মতো মুসলমানকে হজ পালনের সুযোগ দেয়।

সৌদি আরব পাচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি

হজের জন্য হাজিরা যে ব্যয় করছে, তার বড় অংশই চলে যাবে সৌদি আরবের কাছে।

বাসা ভাড়া, তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ কম্বল, পরিবহন এবং খাবারের অর্থ সরাসরি পাবে সৌদি আরব।

দেশের হজযাত্রীদের ব্যবস্থাপনার জন্য মোয়াল্লেম সেবা দেয় হজ এজেন্সিগুলো। তারা একটি খরচ নেয় এর জন্য। এছাড়া বিমান ব্যবস্থাপনায় দুটি সংস্থা সৌদি আরবের হওয়ায় এখান থেকেও তারা আয় করবে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ।

বাসা ভাড়া বাবদ এ বছর সর্বনিম্ন প্যাকেজে হাজিপ্রতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪১০ টাকা। ৮৫ হাজার হজযাত্রীকে এই প্যাকেজে ধরলেও শুধু বাসা ভাড়া বাবদ ১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা যোগ হবে সৌদি আরবের অর্থনীতিতে।

একইরকমভাবে বিমান ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা। তিন বিমান সংস্থার মধ্যে সৌদি দুই বিমান সংস্থা পরিবহন করবে ৪৪ হাজার ৫৫৬ জন। এতে বিমান ভাড়া বাবদ তাদের আয় হবে ৮৬৭ কোটি টাকা।

হজ এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁবু, ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ কম্বল, খাবার সরবরাহে মোয়াল্লেম সেবার সার্ভিস চার্জ বাবদ ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৪ টাকার মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা বাদে বাকিটুকু খরচ হয়ে যায় সৌদি আরবেই। সে অনুযায়ী এই খাতেও প্রায় ৯০৬ কোটি টাকা পায় সৌদি আরব।

এই হিসাব অনুযায়ী এবারের হজ ঘিরে সৌদি আরব ৩ হাজার ২১৭ কোটি টাকা পাবে বাংলাদেশ থেকে। এছাড়া ভিসা ফি, কুরবানির পশু কেনা ছাড়াও আরও বেশ কিছু খরচ যুক্ত হবে এর সঙ্গে। হাজিরা কিছু কেনাকাটাও করেন।

আবার যেহেতু হজকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্যাকেজ থাকে। ফলে একটি ধারণা করা যায়, হজকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ থেকেই এবার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে সৌদি আরবের তেলসমৃদ্ধ অর্থনীতিতে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত