Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ইউক্রেন যুদ্ধ : ভারতীয় ও নেপালিদের টোপ দিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে প্রতারণা

রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তের দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ভারতীয় নাগরিক হেমিল অশ্বিনভাই মাঙ্গুকিয়া। ছবি: ফার্স্টপোস্ট।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তের দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ভারতীয় নাগরিক হেমিল অশ্বিনভাই মাঙ্গুকিয়া। ছবি: ফার্স্টপোস্ট।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বছরে গড়ানোর মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, ইউরোপের উন্নত জীবন এবং উচ্চ বেতনের লোভ দেখিয়ে শত শত ভারতীয় ও নেপালি নাগরিককে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করাতে নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দালালদের মাধ্যমে ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করার জন্য গিয়ে অন্তত এক ডজন ভারতীয় নাগরিক প্রতারিত হয়েছেন। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্য হিন্দু জানায়, একজন ভারতীয় সম্প্রতি ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন।

দ্য ফার্স্ট পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ান সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে এদের অনেককে চাকরি দেওয়া হয়।

সম্প্রতি নিহত ভারতীয় নাগরিক হেমিল অশ্বিনভাই মাঙ্গুকিয়া গুজরাটের সুরাটের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তের দনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের বিমান হামলায় নিহত হন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি রুশ সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সহকারী হিসেবে চাকরি নিয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন।

হেমিলের বাবা ২৩ ফেব্রুয়ারি বিবিসিকে বলেন, তিন দিন আগে তিনি তার ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন। জানতে পেরেছিলেন, ছেলেকে ইউক্রেন সীমান্তের ২০-২২ কিলোমিটার ভেতরে পাঠানো হয়েছে। এজন্য প্রায়ই তার মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকত না। তাই কয়েকদিন পরপর যখনই তাকে মোবাইলে পাওয়া যেত তখনই তিনি তাকে ফোন করতেন।

ইউক্রেন যুদ্ধে যাওয়া বাকি ভারতীয়দের পরিবারগুলোও এখন তাদের সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, যাদের বয়স ২২ থেকে ৩১ বছর। পরিবারগুলোর অভিযোগ, প্রশিক্ষণের নামে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে।

রাশিয়ায় থাকা ভারতীয় সূত্রগুলো বলছে, কয়েক ডজন ভারতীয় নাগরিক রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তবে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র দ্য হিন্দুকে জানিয়েছে, গত বছর ভারত থেকে নিয়োগের প্রকৃত সংখ্যা আনুমানিক ১০০ জন। বিবিসি দিল্লিতে রাশিয়ান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, কিন্তু এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও গত ২৩ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) স্বীকার করেছে, বেশ কিছু ভারতীয় নাগরিক রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে গেছে। তবে বিষয়টি রাশিয়ার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে।

এরপর বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় জানায়, রাশিয়া থেকে অন্তত ২০ জন ভারতীয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

এদের মধ্যে অনেকে তাদের অবস্থা নিয়ে ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। ভিডিওতে তারা কীভাবে দালালরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে তার বিবরণ দেন। তারা জানান, তাদের সকলেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের বাবা-মা ও ভাইবোনরা হয় টুক-টুক (অটোরিকশা) বা ঠেলাগাড়ি চালক অথবা চা বিক্রেতা।

উচ্চ বেতন ও নাগরিকত্বের লোভ

প্রতারণার শিকার তরুণ ও তাদের পরিবারের অভিযোগ, দালালরা তাদের কাছ থেকে ৩ লাখ রুপি করে নিয়েছে। বিনিময়ে তাদেরকে কয়েক মাস সেনাবাহিনীতে চাকরির পর রাশিয়ার পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দালালরা ভারতসহ সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকেও অনেক মানুষকে রাশিয়ায় নিয়েছে। এজন্য তারা চাকরি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১২ লাখ রুপি পর্যন্ত ফি নিয়েছে।

প্রতারণার শিকারদের কয়েকজনের আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি জানতে পেরেছে, তাদের উচ্চ বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

ভারতের কর্ণাটকের এক প্রতারিত তরুণের চা ও ডিম বিক্রেতা বাবা বলেন, “আমার ২৮ বছর বয়সী ছেলে দুবাইতে একটি প্যাকেজিং কোম্পানিতে কাজ করত। সে ও তার তিন বন্ধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক দালালের ভিডিও দেখে। ওই দালাল বলে যে, রাশিয়ায় কাজ করতে গেলে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা বেতন পাওয়া যাবে। অথচ তাদের বর্তমান আয় মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার। এতে তারা লোভে পড়ে ঋণ করে ওই দালালকে ৩ লাখ টাকা করে দেয়।”

একইভাবে তেলেঙ্গানা, গুজরাট, কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশ থেকেও অনেক তরুণ দালালদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। এদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছেন।

উত্তরপ্রদেশ থেকে যাওয়া এক তরুণ জানুয়ারির শেষদিকে একটি ভিডিওতে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর এক অজ্ঞাত স্থান থেকে বলেছেন, বাবাভ্লগ নামে এক ভারতীয়ের পরিচালিত একটি ইউটিউব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখে তিনি রাশিয়ায় আসতে প্রলুব্ধ হন। তাকে প্রতি মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার রুপি বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের বলা হয়নি যে, তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হচ্ছে। বিবিসি চ্যানেলটির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনও সাড়া পায়নি।

রাশিয়ান ভাষায় চুক্তি

সেনাবাহিনীর যুদ্ধ-পোশাক পরা উত্তরপ্রদেশের ওই ব্যক্তি ভিডিওতে বলেন, “মস্কোতে আমরা রাশিয়ান ভাষায় লেখা একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছি এবং নিজের অজান্তেই যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো সৈন্য হয়েছি। আমরা প্রতারিত হয়েছি।”

সেই ব্যক্তি আরও জানান, তিনিসহ আরও দুই ভারতীয় যুদ্ধে আহত হয়েছেন। এসময় তিনি তার আঘাতপ্রাপ্ত ডান হাতটি দেখান।

রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ফোনে কাশ্মীরের একজন জানান, তিনি ইউক্রেনের মারিউপোলে আটকা পড়েছেন। তার সঙ্গে একজন ভারতীয় এবং নেপাল ও কিউবারও নয়জন আছেন। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের সময় তার পায়ে গুলি লেগেছে।

আরেকজনের ভাই বলেছেন, তিনি জানেন না যে, তার ভাইসহ কয়েকজন ভারতীয় ভাগনার গ্রুপের প্রাইভেট আর্মি না রাশিয়ান আর্মিতে রয়েছে। তারা ইউক্রেন সীমান্তের প্রায় ৪০ কিলোমিটার ভেতরে কাজ করছে। তাদের তিন মাসের মধ্যে রাশিয়ার নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

শুধুমাত্র গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে যাওয়া শেখ মোহাম্মদ তাহির নামের এক তরুণ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ বা মোতায়েন এড়াতে পেরেছেন। ২৪ বছর বয়সী তাহির বলেন, “আমি সেখানে একটি গাড়ির ব্যাটারি ওয়ার্কশপে কাজ করতাম।”

গত সপ্তাহে তিনি ভারতে ফিরেছেন।

বিবিসি রাশিয়ায় একজন ভারতীয়ের সঙ্গেও কথা বলেছে, যিনি ইউক্রেন সীমান্তের কাছে কাজ করেছিলেন। কিন্তু এখন আর রুশ সেনাবাহিনীতে নেই। তিনি বলেছেন, তার অভিজ্ঞতা ছিল, রাশিয়ান সেনাবাহিনীর কার্যক্রম খুবই স্বচ্ছ এবং অনলাইনেও তাদের চুক্তিগুলো শেয়ার করা হয়েছে। তবে তিনি এও বলেন যে, যারা রাশিয়ান ভাষা জানেন না তারাই দালাদের হাতে প্রতারিত হচ্ছেন।

বিষয়টি যেভাবে ফাঁস হলো

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় কিছুসংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের স্বেচ্ছায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার খবর এসেছিল সংবাদ মাধ্যমে। তবে যুদ্ধের ভূমিকায় রাশিয়ার পক্ষে ভারতীয়দের উপস্থিতি নিয়ে এই প্রথমবারের মতো খবর এলো।

হায়দরাবাদ শহরের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিষয়টি উত্থাপন করার পর তা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। গত ২৩শে জানুয়ারি তিনি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে এই তরুণদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপের আবেদন জানান।

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেও অভিযোগ করেছেন, গত বছর প্রায় ১০০ জন ভারতীয়কে রুশ সেনাবাহিনীতে হেল্পার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “কিন্তু বেদনাদায়কভাবে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে রুশবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিছু কর্মী এও বলেছেন যে, পাসপোর্ট ও কাগজপত্র জব্দ করে তাদের আটকে রাখা হয়েছে, যাতে তারা দেশে ফিরে আসতে না পারে।”

প্রতারিত শতশত নেপালি

একইভাবে নেপাল থেকেও অনেকে রাশিয়ায় গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। আল জাজিরা তেমনই কয়েকজন নেপালি ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় ঠিক কতজন নেপালি ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করতে গেছেন তার কোনও হিসাব নেপালের সরকারের কাছে নেই। তবে, বিশ্লেষকদের ধারণা, রাশিয়ায় যাওয়া নেপালিদের মোট সংখ্যা এক হাজারের মতো হতে পারে। এ ছাড়া যুদ্ধে কমপক্ষে ১২ জন নেপালি নিহত এবং আরও পাঁচজন ইউক্রেনের হাতে বন্দী হয়েছে।

ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা কয়েকজন নেপালি ভাড়াটে সেনা। ছবি: আল জাজিরা।

জীবিত নেপালি ও নিহতদের মৃতদেহ ফিরিয়ে আনার জন্য নেপাল সরকার রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করছে। কিন্তু তাদের পরিবারগুলো ধৈর্য্য হারাচ্ছে। গত মঙ্গলবার প্রতারিত নেপালিদের পরিবারগুলো কাঠমাণ্ডুতে রাশিয়ান দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করেছে।

তাদের দাবি নিহতদের মরদেহসহ জীবিতদেরও অবিলম্বে ফেরত পাঠাতে হবে। আর নতুন নিয়োগ বন্ধ করার পাশাপাশি নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানান তারা।

পালাতে গিয়ে ফের প্রতারিত দুই নেপালি

বিমল ভাণ্ডারি (ছদ্ম নাম) নামে ৩২ বছর বয়সী এক নেপালি আল জাজিরাকে বলেন, রাশিয়ায় গিয়ে প্রতারিত হয়ে তিনি ও তার এক সহযোদ্ধা পালিয়ে আসার সময় ফের আরেকবার প্রতারিত হন। সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে তারা এখন জেলে রয়েছেন।

বিমল বলেন, তিনি প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাইপোথার্মিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি সুস্থ হতে চান না। কারণ সুস্থ হলেই তাকে ফের যুদ্ধে পাঠানো হবে।

বিমল জানান, রাশিয়ায় যাওয়ার আগে তিনি ছয় বছর কুয়েতে ছিলেন। কিন্তু তার পরিবারের দারিদ্র দূর করতে পারেননি। তিনি যা আয় করতেন তার বেশিরভাগই কুয়েতে যাওয়ার জন্য যে ঋণ নিয়েছিলেন তার সুদ পরিশোধ করতে ব্যয় হয়ে যেত।

এতে হতাশ হয়ে তিনি দেশে ফিরে এসে ট্রাক চালক হিসেবে কাজ নেন। একদিন টিকটকে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির ভিডিওতে রাশিয়ায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। ওই এজেন্সির অফিস ছিল রাশিয়ান দূতাবাসের সামনে। এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তাকে ১২০০ ডলারের বিনিময়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে ৩ হাজার ডলার বেতনের চাকরি দেওয়ার লোভ দেখায়। এতে ভাণ্ডারি রাজি হয়ে যান।

ভাণ্ডারি জানান তার সঙ্গে আরও অন্তত ৩০ জন নেপালিকে গত বছরের ১৯ অক্টোবর দুবাই হয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদেরকে সবাইকে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করানো হয় এবং কোনোও প্রশিক্ষণ ছাড়াই ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিমল জানান, তাদেরকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে যুদ্ধও করানো হয়।

কিন্তু তিন মাস কাজ করার পরও বিমলকে একবারের জন্যও বেতন দেওয়া হয়নি। তাই বিমল পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এবারও তিনি আরেক দালালের খপ্পরে পড়ে ৩ হাজার ডলার দেন দেশে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু ওই দালাল ও তার লোকেরা তাদেরকে রুশ সীমান্তের কাছে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে এলে সীমান্তরক্ষীরা তাদের ধরে নিয়ে যায়।

পর্তুগাল যেতে না পেরে রাশিয়ায়

আতিত ছেত্রি (২৫) নামে এমনই আরেকজন নেপালির সঙ্গে কথা বলেছে আল জাজিরা। পশ্চিম নেপালের সুরখেটের বাসিন্দা ছেত্রি জানান, ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় তিনি পর্তুগাল যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে গত বছরের অক্টোবরে টিকটকে এক রিক্রুটিং এজেন্সির ভিডিওতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে পান।

এরপর ওই এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তাকে ৯ হাজার ডলারের বিনিময়ে ৩ হাজার ডলার বেতনের চাকরি এবং তার ও তার পরিবারের সদস্যদের রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ দেখায়। এতে তিনি রাজী হয়ে যান। তাকেও টুরিস্ট ভিসায় দুবাই হয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় গত বছরের ২১ অক্টোবর।

আতিত ছেত্রী (২৫)। ছবি: আল জাজিরা।

ভাণ্ডারি (৩২) ও ছেত্রির (২৫) মতো ভরত শাহও (৩৬) দালালদের লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারান। তিনি দালালদেরকে আড়াই লাখ রুপি দিয়েছিলেন। কিন্তু একমাস পার না হতেই ২৬ নভেম্বর ইউক্রেনে যুদ্ধে নিহত হন ভরত শাহ।

মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপালিরা বলছেন প্রায় কোানও প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে। দালালরা তাদের বলেছিল, যুদ্ধের জন্য তারেদকে তিন মাসব্যাপী একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অথচ তাদের ইউক্রেন সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলে এক মাসেরও কম সময় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

ছেত্রি আল জাজিরাকে বলেন, “আমি এর আগে জীবনে একবার কেবল দূর থেকে একটি বন্দুক দেখেছি, তা ধরেও দেখিনি।”

রত্না কার্কি নামে ৩৪ বছর বয়সী আরেক নেপালি ইউক্রেনে যুদ্ধে আহত হয়ে এখন হাসপাতালে আছেন। তিনি জানান, তার ইউনিটের রাশিয়ান অফিসাররা বেশিরভাগই নেপালি, তাজিক ও আফগান যোদ্ধাদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠায়।

তিনি ফোনে আল জাজিরাকে বলেন, “রাশিয়ানরা আমাদের পেছন থেকে আদেশ করেছিল। আমরা তাদের ঢালের মতো ছিলাম।”

বিমল ভান্ডারীকে তার ব্যাটালিয়নে মোতায়েনের আগে তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু তার যুদ্ধের কোনও দক্ষতা নেই তাই তাকে হয়তো কোনও ব্যাকআপ বাহিনীতে রাখা হয়েছে। কিন্তু ভাণ্ডারী বলেন, “তারা [রাশিয়ান কমান্ডাররা] এমনকি আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে এবং শত্রুদের অবস্থান স্থল পরিদর্শন করতেও বাধ্য করে যা খুবই ভীতিকর। আমি অনেক ইউক্রেনীয়কে হত্যা করেছি, না হলে তারা আমাকেই মেরে ফেলত।”

ছেত্রী বলেন, “যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমাদের রাতদিন সবসমসময়ই প্রস্তুত থাকতে হতো। তারা যখনই আমাদের আদেশ দিত, তখনই আমাদের যুদ্ধে যেতে হতো। কোনও কোনও দিন আমাদের বাঙ্কারেই সারা রাত কাটাতে হয়েছে।”

বিমল ভাণ্ডারী পালিয়ে আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও রাম চন্দ্র শ্রেষ্ঠা নামের একজন পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। শ্রেষ্ঠা নেপালের সেনাবাহিনীর সাবেক সৈনিক। গত ডিসেম্বরে তিনি ও তার তিন বন্ধু ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে রাশিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য মানব পাচারকারীদের ২ হাজার ডলার করে দেন। মানবপচারকারীরা তাদের মস্কোতে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে তারা ভারতের নয়াদিল্লি হয়ে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে ফিরে যান।

শ্রেষ্ঠা আল জাজিরাকে বলেন, “আরও অনেকেই পালানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। এখন রাশিয়ানরাও কঠোর নজরদারি বাড়িয়েছে, তাই পালানো খুব কঠিন।”

দিন কাটছে মৃত্যু আতঙ্কে

বিমল ভাণ্ডারী জানান তিনি তিনমাসেও কোনও বেতন পাননি। ছেত্রীকে অবশ্য প্রতিশ্রুত বেতনের অর্ধেক দেওয়া হয়েছে। প্রতারণতার শিকার নেপালিরা ও তাদের পরিবার নিজ দেশের সরকারের কাছে তাদের ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অমৃত বাহাদুর রাই আল জাজিরাকে বলেছেন, “আমরা রাশিয়ান সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি এবং তাদের কাছে নেপালি যোদ্ধাদের নামের তালিকা চেয়েছি, নিহতদের মরদেহসহ জীবিতদেরও ফেরত পাঠাতে বলেছি। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যও আমরা রাশিয়ার সরকারকে অনুরোধ করেছি।”

তবে রাশিয়ার সরকার প্রকাশ্যে কোনও অনুরোধে সাড়া দেয়নি। এ বিষয়ে আল জাজিরা কাঠমাণ্ডুতে রাশিয়ান দূতাবাসে যোগাযোগ করলেও কেউ কোনও কথা বলতে রাজি হয়নি।

ভরত শাহের বাবা কুল বাহাদুর শাহ তার ছেলের মরদেহ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এখনও ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, “আমার বন্ধুরা বলেছে যে, আমরা কমপক্ষে ৪৫ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ পাবো এবং আমার ছেলের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানরাও রাশিয়ার নাগরিকত্বসহ শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাবে।”

তবে পালাতে গিয়ে ধরা পড়া ভান্ডারী জানান, তিনি এখন আর টাকার তোয়াক্কা করেন না। তিনি বলেন, “আমি বাড়ি ফিরতে চাই। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের আশ্বস্ত করি যে, আমি নিরাপদ আছি, তাদের চিন্তা করার দরকার নেই।

“কিন্তু এখানে আমি সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকি, আমি যেকোনও সময় মারা যেতে পারি।”

তথ্যসূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, ফার্স্টপোস্ট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত