Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

ইরানের প্রেসিডেন্ট কেন পাকিস্তান সফরে

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে (বামে) সোমবার ইসলামাবাদে নিজ বাস ভবনে স্বাগত জানান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ (ডানে)।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে (বামে) সোমবার ইসলামাবাদে নিজ বাস ভবনে স্বাগত জানান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ (ডানে)।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য তিন দিনের সফরে পাকিস্তানে এসেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। গাজা যুদ্ধকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করার ঝুঁকি নিয়ে ইরান ও ইসরায়েল একে অন্যের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর কয়েকদিন পর সোমবার থেকে শুরু হয় এই সফর।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফসহ দেশটির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করার কথা রয়েছে রাইসির। জানুয়ারিতে পাকিস্তান ও ইরান পরস্পরের ওপর পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেই বিরোধের মীমাংসা করতেই রাইসির এই সফর।

স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, রাইসি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গেও দেখা করবেন।

সফরের এজেন্ডা কী

পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক, সীমান্ত ও জ্বালানি সম্পর্ক জোরদার করা রাইসির এই সফরের প্রধান লক্ষ্য।

সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতির ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। এই সফরে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, জ্বালানি ও সীমান্ত সমস্যাসহ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হবে।”

এর আগে রবিবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ইরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “পাকিস্তান-ইরান সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে এবং বাণিজ্য, সংযোগ, জ্বালানি, কৃষি ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে উভয় পক্ষের একটি বিস্তৃত এজেন্ডা থাকবে।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইরানের প্রেসিডেন্ট লাহোর ও করাচিসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে পরিদর্শন করবেন এবং দ্বিপাক্ষিক ও বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে মনোনিবেশ করবেন।

ইসলামাবাদের পরামর্শ সেবা ফার্ম তাবাদল্যাবের অংশীদার এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা মোশাররফ জাইদি এক লিখিত বিবৃতিতে আল জাজিরাকে বলেছেন, রাইসির সফর ইরানের দিক থেকে ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি [পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব] থেকে সমর্থন সুরক্ষিত করার একটি প্রচেষ্টা। কারণ এটি ইসরায়েলের সঙ্গে বিপজ্জনক সংঘাতের গভীরে প্রবেশ করে হোঁচট খাচ্ছে।

জাইদি আরও বলেন, তবে ইরানের কৌশলগত চিন্তাবিদরা সচেতন আছেন যে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পাকিস্তানের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাতে জড়ানো সম্ভব হবে না।

ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের অবস্থা কী

ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি অস্থির সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। তারা উভয়েই একে অন্যকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থতার জন্য অভিযুক্ত করে।

গত জানুয়ারিতে ইরান সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে দুই শিশুকে হত্যা করলে দেশ দুটির মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা বেড়ে যায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করে, সশস্ত্র গোষ্ঠী জাইশ আল-আদলের দুটি ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাকিস্তানে হামলা চালানো হয়েছে। এর জবাবে পাকিস্তান পাল্টা ইরানের ভূখণ্ডে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং তেহরান থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে প্রতিশোধ নেয়।

তবে পরে দুই প্রতিবেশী নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তেহরান তার শীর্ষ কূটনীতিককে ইসলামাবাদে পাঠায় সম্পর্ক সংশোধনের জন্য। দুই দেশ একসঙ্গে ‘সন্ত্রাসবাদের’ হুমকি মোকাবেলা করতে সম্মত হয়েছে, বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে। রাইসির সফরের আগেই তেহরান ও ইসলামাবাদ ‘সন্ত্রাসবাদ’ মোকাবেলার বিষয়ে কথা বলে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনির পিএইচডি ডিগ্রিধারী মুহাম্মদ ফয়সাল বলেন, “তখন পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তাই ইরানিরা ইঙ্গিত দিয়েছিল, নতুন নির্বাচিত সরকার আসার পরে সম্পর্ক মেরামত এবং পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি সফর হতে পারে।”

পাকিস্তান-ইরান সম্পর্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকরা সীমান্তে উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও ইরানের সঙ্গে পুনরায় স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনকে সমর্থন করেছেন।

প্রবীণ পাকিস্তানি কূটনীতিক মালিহা লোধি জানুয়ারির সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে আল জাজিরাকে বলেন, “ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্তে সমস্যা রয়েছে। তাই ইরানের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক, স্থিতিশীল সম্পর্ক রাখা পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এখনও তাই আছে।”

ইসলামাবাদ ও তেহরান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ করছে। দেশ দুটির মধ্যে বর্তমানে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্যিক লেনদেন হয়।

ফয়সাল আল জাজিরাকে বলেছেন, দুটি দেশের মধ্যে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ও অপরিশোধিত তেল সহ একটি বড় ধরনের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইরান বেলুচিস্তান প্রদেশ ও পাকিস্তানের অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

২০২৩ সালের মে মাসে শেহবাজ শরীফ ও রাইসি মান্দ-পিশিন সীমান্ত ক্রসিং-এ প্রথম সীমান্ত বাজার উদ্বোধন করেন।

এ ছাড়া দুই প্রতিবেশীর ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে, পাকিস্তান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিম ইরানে তীর্থযাত্রায় যায়।

যাইহোক, তাবাদল্যাবের জাইদি বলেন, সাধারণ সাংস্কৃতিক বন্ধন ও একটি দীর্ঘ সীমান্ত (প্রায় ৯০০ কিলোমিটার) থাকা সত্ত্বেও দেশ দুটির জনগণের মধ্যে লেনদেন এবং গভীর বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বরং দেশ দুটির মধ্যে যে বাণিজ্য হয় তার বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক এবং ভ্রমণও ধর্মীয় পর্যটনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

চলমান সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। রাইসি বলেন, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্তর রাজনৈতিক সম্পর্কের স্তরের সমান নয়। গত আগস্টে দেশ দুটি ৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।

পাকিস্তানে ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির জন্য একটি পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে স্থবির হয়ে রয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনি থেকে ফয়সাল বলেন, রাইসির এই সফরে পাকিস্তান-ইরান গ্যাস পাইপলাইন নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী

১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলের ওপর ইরানের হামলার একদিন পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ইরান ও ইসরায়েলকে পরস্পরের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে ঘটনাগুলোকে ‘কূটনৈতিক বিপর্যয়ের পরিণতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “কোনও ক্ষেত্রে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে তার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে এই ঘটনা তার একটি নজির।”

এতে আরও বলা হয়, পাকিস্তান এই অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “এখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা এবং শান্তি পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানাই।”

পাকিস্তান ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না এবং দেশটির সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগেরও কোনও মাধ্যমও নেই।

জাইদি বলেন, “উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট জিসিসি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিন নীতিতে পরিবর্তন আনার জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ দেয় বলে ধারণা করা হয়। তবে পাকিস্তান তার ফিলিস্তিন নীতিতে পরিবর্তন আনার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।”

উল্লেখ্য যে, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ কয়েকটি উপসাগরীয় আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবছে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত