Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা কেন মা হতে চাইছেন না 

নানা কারণে সন্তান ধারণে আগ্রহ পাচ্ছেন না দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা। ছবি: বিবিসি
নানা কারণে সন্তান ধারণে আগ্রহ পাচ্ছেন না দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা। ছবি: বিবিসি
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ইয়েজিন, বয়স তার ৩০ বছর। তিনি একজন টেলিভিশন প্রযোজক। থাকেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সউলের উপকণ্ঠে এক অ্যাপার্টমেন্টে। বিয়ে করেননি, একাই থাকেন এই নারী । হ্যাপিলি সিঙ্গেল বা একা থেকে সুখী যারা, তাদেরই একজন তিনি।

একদিন বৃষ্টিস্নাত দুপুরে বাসায় বান্ধবীদের দাওয়াত দেন ইয়াজিন। রান্না-বান্না নিজেই করেন। খাবার টেবিলে বান্ধবীদের একজন মোবাইল ফোনে থাকা একটি ডাইনোসরের মিম সবাইকে দেখান। ডাইনোসরটি বলছে, “সাবধান। আমাদের মতো তোমরা নিজেদের বিলুপ্ত করে ফেল না।”                    

মিমটি দেখে সব নারী একসঙ্গে হেসে ওঠেন। ইয়েজিন বলেন, “এটি মজার। তবে উদ্বেগের। কারণ আমরা নিজেরাই তো নিজেদের বিলুপ্তির জন্য দায়ী।”         

শুধু ইয়েজিন নয়, তার বান্ধবীদের কারোরই মা হওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। সন্তানমুক্ত জীবন বেছে নেওয়া নারীদের অংশ তারা। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।          

বিশ্বে সবচেয়ে কম জন্মহার দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রতি বছরই দেশটিতে জন্মহার কমছে। এক বছরের রেকর্ড ভাঙছে পরের বছর।         

জন্মহার সংক্রান্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহার আরও ৮ শতাংশ কমে শূন্য দশমিক ৭২ এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ দেশটিতে একজন নারী গড়ে শূন্য দশমিক ৭২টি শিশু জন্ম দিচ্ছে।

অথচ জনসংখ্যা স্থির রাখতে চাইলেও এই হার ২.১ হতে হয়।

এভাবে চলতে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজার।  

একা জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা।

জরুরি অবস্থা ঘোষণা

গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে, উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার এমনিতেই পড়তির দিকে। তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মহারের চিত্র বিশ্বের আর কোনও দেশে দেখা যায় না।

এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন ভয়াবহ পূর্বাভাস।

তাদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। সেখানে বাধ্যতামূলক সামরিক সেবায় অংশগ্রহণে যোগ্য তরুণের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ কমে যাবে। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ৬৫ বছরের বেশি বয়সী হবে।

এমন পরিস্থিতি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি, পেনশন তহবিল ও নিরাপত্তায় অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের পূর্বাভাস বিবেচনায় নিয়ে তাই দেশটির রাজনীতিকরা বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রায় ২০ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় যে সরকারই এসেছে, তারা প্রত্যেকেই জন্মহার সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে দেদারছে টাকা ঢেলে গেছে। দুই দশকে তারা খরচ করেছে ২৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।          

যেসব দম্পতির সন্তান আছে, প্রতি মাসে তাদের প্রচুর আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। মাসিক ভাতা থেকে শুরু করে ভর্তুকি দেওয়া বাড়ি, ট্যাক্সিতে বিনামূল্যে চলাচল-কী নেই এতে। হাসপাতালে ভর্তির খরচ, এমনকি বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা ব্যয়ও বহন করছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার।  

অর্থনৈতিক এসব প্রণোদনার পরও আলোর পথ দেখছেন না দেশটির রাজনীতিকরা। তাদের আরও ‘সৃজনশীল’ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে।

এরই অংশ হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম বেতনে ন্যানি (শিশুদের দেখাশোনা করে যারা) দেশে আনছে তারা। এছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্য যারা ৩০ এর কোঠা পেরোনোর আগেই তিনটি সন্তানের জনক হয়েছেন, তাদের বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।           

এত কিছুর পরও অভিযোগের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না দক্ষিণ কোরিয়ার নীতি-নির্ধারকরা। তারা তরুণদের বিশেষ করে তরুণ নারীদের চাহিদা বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে উদাসীন, এমন অভিযোগ উঠেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের চাহিদা বা প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সউলে বিবিসির প্রতিনিধি। বোঝার চেষ্টা করেছেন, কেন তারা সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিশের কোঠার মাঝামাঝি সময়ে ইয়েজিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি একাই থাকবেন। এর পাঁচ বছর পর তিনি বিয়ে না করা এবং সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।         

তার মতে, “দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্পর্ক করার মতো মানুষ পাওয়া কঠিন। ঘরের কাজ, সন্তান লালন-পালনের কাজ ভাগাভাগি করে করবে, এমন মানসিকতার মানুষ এখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর যে নারীরা একাই সন্তান দেখভাল করেন, তাদের প্রতি সমাজ নমনীয় নয়।”  

২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিয়েবহির্ভূত সন্তান জন্মদানের হার ছিল মাত্র দুই শতাংশ।

ঘরের কাজ, সন্তান লালন-পালনের কাজ ভাগাভাগি করে করবে, এমন মানসিকতার মানুষ এখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কাজের চাপ

ঘর-সংসারের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে টেলিভিশনে ক্যারিয়ারেই মনোনিবেশ করেছেন ইয়েজিন। অবশ্য এমন এক পেশা তিনি বেছে নিয়েছেন, চাইলেও সন্তানকে সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মঘণ্টা দীর্ঘ।

ইয়েজিনের অফিস টাইম আর সবার মতো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। তবে তিনি জানান, রাত ৮টার আগে অফিস থেকে বের হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসে খাটাখাটুনির পর ইয়েজিন যখন বাসায় ফেরেন, তখন তার হাতে ঘর পরিষ্কার বা ব্যায়াম করার বাইরে আর কিছু করার মতো সময় থাকে না।  

ইয়েজিন বলেন, “আমি আমার কাজ উপভোগ করি। এটি আমাকে অনেক পরিপূর্ণতা দেয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজ করা কঠিন। এখানে সারাক্ষণ কাজের চক্রের ভেতরে আটকে থাকতে হয়।”

কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও করতে হয় ইয়েজিনকে। বলেন, “চাকরিতে উন্নতি করতে হলে অবসর সময়ে পড়াশোনা করা লাগে আমাদের। কোরিয়ানরা মনে করেন, প্রতিনিয়ত কাজের দক্ষতা-যোগ্যতা না বাড়ালে প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ে যেতে হয় এবং একপর্যায়ে ব্যর্থ হতে হয়। এই মানসিকতা মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। এই ভয় আমাদের দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।”

এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানসিকতা অনেক কোরিয়ান নারীকে সন্তান ধারণে নিরুৎসাহিত করে বলে মনে করেন ইয়েজিন। তিনি বলেন, “সন্তান হলে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চাপ পরোক্ষভাবে দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। আমার নিজের বোন ও দুজন প্রিয় সংবাদ উপস্থাপিকার ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখেছি।”

প্রতিনিয়ত কাজের দক্ষতা-যোগ্যতা না বাড়ালে প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ে যেতে হয়। এবং একপর্যায়ে ব্যর্থ হতে হয়। এই মানসিকতা মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। এই ভয় আমাদের দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।

ব্যয়বহুল সন্তান পালন

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) দেশগুলোর নারীদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত। তা সত্ত্বেও দেশটিতে লিঙ্গভিত্তিক বেতনের ব্যবধান সর্বোচ্চ এবং পুরুষ বেকারের চেয়ে নারী বেকারের সংখ্যা বেশি।

গবেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের সামনে একটি বিকল্প উপস্থাপন করছে- কর্মজীবন অথবা পরিবার। ক্রমশ তারা কর্মজীবনকে বেছে নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে বিবিসির সউলের প্রতিনিধি কথা বলেন ৩৯ বছর বয়সী নিঃসন্তান স্টেলা শিনের সঙ্গে। পাঁচ বছরের শিশুদের ইংরেজি পড়ান তিনি।  

ছয় বছর আগে বিয়ে হয় স্টেলার। তিনি সন্তান চেয়েছিলেন। তার স্বামীরও একই ইচ্ছে ছিল। তবে কাজের চাপের কারণে তাদের পক্ষে সন্তান নেওয়া সম্ভব হয়নি। স্টেলা মেনে নিয়েছেন, তার যা জীবনযাপন, তাতে সন্তান ধারণ অসম্ভব। 

স্টেলা বলেন, “সন্তান জন্ম নেওয়ার পর প্রথম দুবছর তাকে লালন-পালন করতে মায়েদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এটি ভাবলেই বিষন্ন হয়ে পড়ি। আমি আমার ক্যারিয়ার পছন্দ করি। নিজের যত্ন নিজেরই নিতে ভালো লাগে।”     

চার বছর বয়স থেকে শিশুদের বিভিন্ন ক্লাসে পাঠাতে হয়। ছবি: বিবিসি

এরপর আছে সন্তানদের প্রাইভেটে শিক্ষাব্যয়।

চার বছর বয়স থেকে শিশুদের গণিত থেকে ইংরেজির ক্লাস, গানের ক্লাস, তায়কোয়ান্দো (কোরিয়ান মার্শাল আর্ট) ক্লাসসহ ব্যয়বহুল পাঠ্যক্রম বহির্ভূত বিভিন্ন ক্লাসে ভর্তি করতে হয়। এই চর্চা এতটাই ব্যাপক যে, স্রোতের বাইরে যাওয়ার অর্থ প্রতিযোগিতায় সন্তানদের পিছিয়ে পড়া।

২০২২ সালের এক গবেষণা বলছে, মাত্র ২ শতাংশ অভিভাবক এসব ব্যয়বহুল ক্লাসের পেছনে অর্থ ব্যয় করেন না। অন্যদিকে ৯৪ শতাংশ অভিভাবক এগুলোকে ‘আর্থিক বোঝা’ হিসেবে দেখেন।

এসব কারণে সন্তান লালন-পালনে বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ হয়ে উঠেছে দক্ষিণ কোরিয়া।               

স্টেলা জানান, একটি শিশুর পেছনে প্রতি মাসে একজন অভিভাবককে ৮৯০ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হয়। অনেকে এই খরচ মেটাতে হিমশিম খান।      

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত