Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

মিল্টনের আশ্রমে প্রবেশ নিষিদ্ধ

মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমের সামনে উৎসুক মানুষের ভিড়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমের সামনে উৎসুক মানুষের ভিড়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of সাজ্জাদ হোসেন

সাজ্জাদ হোসেন

ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের আশ্রমে সাংবাদিকসহ কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশ্রমে থাকা বৃদ্ধ ও শিশুরা ভালো আছেন বলে দাবি করেছেন তারা। 

‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধাশ্রমের চেয়ারম্যান আলোচিত-সমালোচিত মিল্টন সমাদ্দারকে গতকাল বুধবার আটক করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে জাল মৃত্যুসনদ তৈরি, আশ্রমের ‘টর্চার সেলে’ মানুষকে মারধর ও মানবপাচারের অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জাল মৃত্যুসনদ তৈরির মামলায় তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত।

মিল্টন সমাদ্দার
মিল্টন সমাদ্দার

মিল্টন সমাদ্দারের অনুপস্থিতে অসহায় মানুষগুলো কেমন আছে জানতে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমে যায় এই প্রতিবেদক।

তখন দেখা যায়, আশ্রমের প্রধান ফটক বন্ধ। সামনে সাংবাদিক, এলাকাবাসী ও উৎসুক মানুষের ভিড়। কেউ কেউ এসেছেন আশ্রমে থাকা পরিচিত মানুষের খোঁজ নিতে। 

নাতির খোঁজে আশ্রমের ফটকে বৃদ্ধ

দুপুর ২টার দিকে ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ এর ফটকে বসে থাকতে দেখা যায় তারা মিয়া নামে এক বৃদ্ধকে। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানান, তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার নয়াপাড়া গ্রামে। এই আশ্রমে থাকা তার পাঁচ বছর বয়সী নাতি খাদিজাকে নিতে এসেছেন।

নাতির খোঁজে আশ্রমের ফটকে নারায়ণগঞ্জের তারা মিয়া। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তারা মিয়া বলেন, “আমার নাতিডা জন্ম থেকেই পঙ্গু। গরিব বইলা তার চিকৎসা করাইতে পারি নাই। তাই মিল্টন সমাদ্দারের এই আশ্রমে রাইখা গেছিলাম। কিন্তু অহন তার সমন্ধে যে কথা শুনতাছি তাতে নাতিরে আর রাখার সাহস পাইতেছি না। তাই আইলাম নাতিরে নিতে।”

তিনি বলেন, “আশ্রমে আসার পর তারা কইলো আমার নাতি নাকি এইহানে নাই, তারে নাকি সাভার রাখা হইছে। এহান থাইক্যা কাগজ দেওয়ার পর সাভার যামু নাতিরে নিতে, তাই বইসা আছি।”

তারা মিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় ফটকের সামনে আসেন জুঁই নামে এক তরুণী। আশ্রমে থাকা শাবনূর নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী ও তার সন্তানের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি।

সকাল সন্ধ্যাকে জুঁই জানান, শত অনুরোধের পরও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি আশ্রমের নিরাপত্তাকর্মী।

আশ্রমের ফটকে থাকা উৎসুক মানুষের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রওশন আরা সিরাজ।

তিনি বলেন, “মিল্টন সমাদ্দার ভালো কাজ করছেন, জেনে শুরু তার আশ্রমের জন্য আমরাও বিভিন্নভাবে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। কিন্তু এখন তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা দুঃখজনক। আমি চাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে সঠিক বিচার।”

ফটকের উপর দিয়ে আশ্রমের ভেতরের এমন চিত্র দেখা যায় দুপুরে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক স্থানীয় বাসিন্দা জাফর। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমি ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরেই এই এলাকায় থাকি। বিভিন্ন সময় ব্যক্তি মিল্টন সমাদ্দারের বিষয়ে আমরা অনেক অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু আমরা ভেবেছি তিনি ব্যক্তি মানুষ যেমনই হোন, কাজ তো ভালো করছেন। এজন্য স্থানীয় অনেক মানুষই তাকে সাযাহ্য করেছে।”

আশ্রমের অদূরেই চায়ের দোকান চালান ইব্রাহিম নামে এক যুবক। তিনিও স্থানীয়দেরকে মিল্টনের আশ্রমের সাহায্যে এগিয়ে আসার কথা জানান।

ইব্রাহিম বলেন, “শুরুর দিকে মিল্টন সমাদ্দারকে স্থানীয় মানুষেরা যে যেভাবে পেরেছেন সাহায্য করেছেন। অনেকেই তার আশ্রমে থাকা মানুষের জন্য খাবার দিয়ে আসতেন। দিন যত গেছে মিল্টন সমাদ্দারের তত খারাপ চেহারা সামনে এসেছে। কিন্তু তাকে এসব বিষয়ে কোনও কিছু জিজ্ঞাসা করা যেত না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই নির্যাতন ও হেনস্তার শিকার হতে হতো।”   

বাচ্চু মিয়া নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার দাবি, ছোট ব্যবসা করেও আশ্রমের জন্য মিল্টন সমাদ্দারের হাতে লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি।  

বাচ্চু মিয়া বলেন, “আমি কাঁচামালের ব্যবসা করি। সেই ব্যবসায় নিজেরই চলতে কষ্ট হয়। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মিল্টন সমাদ্দারকে ১ লাখ টাকা দিয়েছি। এর মধ্যে আশ্রমের নিবন্ধনের সময়ই একসঙ্গে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু মহৎ কাজ ভেবে আমি যাকে এতদিন সাহায্য করেছি, তার ভেতরে এত অন্যায় বুঝতে পারিনি।”

মিল্টন সমাদ্দার।

এসব বিষয়ে কথা বলতে আশ্রমের ভেতরে যেতে চাইলে বাধা দেন ফটকে থাকা নিরাপত্তাকর্মী মনির হোসেন।

সকাল সন্ধ্যকে তিনি বলেন, বুধবার পুলিশ অভিযান চালানোর পর থেকেই কাউকে আর ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

নিরাপত্তাকর্মী মনিরের দাবি, বর্তমানে দক্ষিণ পাইকপাড়ার এই আশ্রমে ১৫ জন বৃদ্ধ মানুষ এবং ৫ জন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী ও তাদের সন্তানসহ ২৫ জন আছেন। মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার হলেও আশ্রমে থাকা মানুষের সেবায় কোনও ত্রুটি হচ্ছে না। সকালে তাদের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা ছিল। দুপুরে খাওয়ানো হয়েছে মাছ ভাত। রাতেও একই খাবার পাবে তারা।

আশ্রমে বর্তমানে ১৮ জন কর্মী আছে বলেও দাবি করেন নিরাপত্তাকর্মী মনির।

এ সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে দীপক সমাদ্দার নামে এক যুবককে ডেকে আনেন তিনি।

নিজেকে ওয়ার্ড বয় পরিচয় দিয়ে দীপক সমাদ্দার বলেন, “সবকিছু ঠিকভাবেই চলছে। পুলিশের নির্দেশের কারণেই কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিতে পারছি না।”

তখন আশ্রমের ম্যানেজার কিশোর বালা মিল্টন সমাদ্দারের আইনি বিষয় নিয়ে আদালতে ব্যস্ত ছিলেন বলেও দাবি করেন ওয়ার্ড বয় দীপক সমাদ্দার।

দীপক সমাদ্দার জানান, তার বাড়িও বরিশালের উজিরপুরে মিল্টন সমাদ্দারের গ্রামেই।

কল্যাণপুর প্রধান সড়কে ৬২/২ নম্বর বাড়িতে মিল্টন সমাদ্দারের আরেক অফিস। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

কল্যাণপুরে মিল্টনের আরেক অফিস

কল্যাণপুর প্রধান সড়কে ৬২/২ নম্বর বাড়িতে মিল্টন সমাদ্দারের আরেকটি অফিস আছে বলে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের ফটকে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় জানান স্থানীয়রা। তবে নিরাপত্তাকর্মী মনির প্রথমে বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি। এক পর্যায়ে এরপর সেখানে থাকা আনোয়ার হোসেন নামে যুবক দাবি করে, তিনি নিজেই ওই অফিস দেখেছেন।

এরপর সুর পাল্টে ফেলেন নিরাপত্তাকর্মী মনির।

তিনি বলেন, “সেখানে যে অফিস আছে সেটা চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার এর নয়। সেটি মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান মিল্টন হোম কেয়ার লিমিটেড এর কার্যালয়। সেখানে আশ্রমের কাউকে আশ্রয় দেওয়া হয়নি।”

পরে কল্যাণপুরের ওই ঠিকানায় গিয়ে ভবনের দেয়ালে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ এর সাইন বোর্ড পাওয়া যায়। চারতলা ভবনটির নিচতলায় অফিসের দরজায়ও ছিল একই সাইন বোর্ড। অফিসের সব জানালাই কালো থাই গ্লাসে ঘেরা। বুধবার থেকে এই অফিস তালা দেওয়া বলে জানান ভবনের তিন তালার ভাড়াটিয়া মোক্তার হোসেন।

স্থানীয়রা জানান, এই ভবনের মালিক আলতাফুর রহমান। দুই বছর আগে তিনি মারা গেছেন। ভবনের সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া, দেখাশোনার জন্য ম্যানেজার আছে। তিনি থাকেন পাশের ভবনে। আর আলতাফুর রহমানের ছেলে শাহেদ পরিবার নিয়ে লালমাটিয়ায় থাকেন। মাঝেমধ্যে এসে ভাড়া নিয়ে যান।

পাশের ভবনের ফটকে টোকা দিতেই বেরিয়ে আসেন এক নারী। নিজের নাম সবেদা ইয়াসমীন বিউটি জানিয়ে বলেন, তিনিই ১০ বছর ধরে ৬২/২ নম্বর বাড়ি দেখাশুনা করছেন। 

বিউটি বলেন, “বছর পাঁচেক আগে আলতাফুর রহমানের কাছ থেকে নিচতলার দুই রুমের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন মিল্টন সমাদ্দার। আবাসিক ভবনে অফিস করা নিয়ে প্রথমেই আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম।

“কিন্তু অসহায় মানুষদের সেবা করার কথা বলায় আমরাও মানবিক কারণে আর কিছু বলিনি। এই অফিসে নিয়মিতই আসতেন মিল্টন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন আসতেন। আমি কয়েকবার ভিতরে ঢুকে দেখেছি তারা কম্পিউটার, ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। আর কিছুই জানি না আমরা।”

চারতলা ভবনটির নিচতলায় অফিসের দরজায়ও ছিল একই সাইন বোর্ড। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত