রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর গড়ালেও হত্যা মামলার বিচারকাজ চলছে ধীর গতিতে। মামলাটিতে সাক্ষী প্রায় ছয়শ, তার মধ্যে শতাধিক জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় কবে নাগাদ মামলার বিচারের প্রাথমিক ধাপ শেষ হবে, তার দিনক্ষণের ধারণাও দিতে পারছে না কেউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার মঙ্গরবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ৫৯৬ জন সাক্ষীর মধ্যে এপর্যন্ত ৮৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। বাকি সাক্ষীদের মধ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
এত সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নানা কারণেই মামলাটির বিচার এগোয়নি। তদন্ত কাজ চলেছে দুই বছর। এরপর অভিযোগপত্র দাখিলে কেটে যায় আরও কয়েক বছর। তারপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিল কয়েক বছর।
সব বাধা পেরিয়ে ২০২২ সাল থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছিল আলোচিত এই মামলার।
এবছরের ১৫ জানুয়ারি মূল আসামি সোহেল রানার জামিনের আদেশ স্থগিত করে দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তখন ছয় মাসের মধ্যে এই মামলার বিচার শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
“আমরা চেষ্টা করছি, এ সময়ের মধ্যে মামলাটি শেষ করতে,” বলার পাশাপাশি কিছু জটিলতার কথাও বলেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বিমল সমাদ্দার।
রানা প্লাজা ধসে আহত যাদের সাক্ষী করা হয়েছিল, তারা দেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। এই সব সাক্ষীদের আদালতে আনতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান এই আইনজীবী।
“এখন সাক্ষ্য গ্রহণ যে গতিতে চলছে, তাতে যদি নতুন করে কোনও বাধা না আসে, তাহলে দ্রুত মামলা শেষ হবে,” বলেন তিনি।
প্রায় এক যুগেও ভয়াবহ সেই ঘটনার বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি জলি তালুকদার।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথমত, এই মামলায় সোহেল রানা ছাড়া আর কেউ জেলে নাই। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনার জন্য অনেকেই দায়ী। রাজউক থেকে শুরু করে প্রায় ১৮টি প্রতিষ্ঠান জড়িত। এখনও বিচারের প্রথম ধাপই পেরোতে পারল না!”
তিনি বলেন, “শ্রমিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে দিন কারখানায় নিয়ে এ ঘটনার শিকার করা হয়। এটা নিঃসন্দেহে হত্যাকাণ্ড। এটির অবশ্যই বিচার হওয়া উচিৎ। ১১ বছর ধরে আমরা সেই দাবি জানিয়ে আসছি।”
সাক্ষী হাজিরে জটিলতার বিষয়ে জলি বলেন, “আমরা কিন্তু বলেছি, সাক্ষী আমরা হাজির করে দেব। রাষ্ট্রপক্ষ সেটি নিচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতির কারণে মূলত মালিকপক্ষ সুযোগ পাচ্ছে। তারা আসলে মালিক পক্ষকে বাঁচাতে চাইছে।”
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার বিচার নিষ্পন্ন না হওয়া এবং কারখানার মালিকের জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন এই শ্রমিক নেতা।
রানা প্লাজায় থাকা কারখানাগুলোর শ্রমিকরা প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পায়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
সে দিন যা ঘটেছিল
ঢাকার সাভারের বাস স্ট্যান্ড এলাকার বহুতল ভবন রানা প্লাজা ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে। এতে চাপা পড়ে মারা যাওয়া ১ হাজার ১৩৫ জনের লাশ উদ্ধার করা গিয়েছিল। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আরও ১ হাজার ১৬৯ জন।
বাংলাদেেশ ভয়াবহ এই ভবন ধস তখন বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। ধসের পর ভবন নির্মােণ অনিয়ম, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পোশাক শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করার বিষয়গুলো উঠে আসে।
এঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে একটি মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে।
হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে যা ছিল
হত্যামামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ধসের আগের দিন সকাল সাড়ে ৯টায় রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দিেয়ছিল। খবর পেয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কর্মকর্তারা সেখানে গিয়েছিেলন। তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত ভবনের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলেছিলেন।
কিন্তু পাঁচ পোশাক কারখানার মালিক ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন (২৪ এপ্রিল) শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকেও দোষি করা হয় একই অভিযোগে। সোহেল রানা সেদিন বলেছিলেন, “আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।”
পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয় মামলাটিতে।
ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে অন্য মামলার অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।
দুই অভিযোগপত্রে মোট আসামি ছিলেন ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। আসামিদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। বর্তমান আসামির সংখ্যা ৩৯। এরমধ্যে কারাগারে আছেন কেবল সোহেল রানা। পলাতক আছেন সাতজন। জামিনে আছেন ৩১ জন।
এ অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে ২০১৬ সালে বিচারিক আদালত মামলায় বিচার শুরু করে।
ইমারত নির্মাণে বিধি না মানার অভিযোগের মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে আছে।
অন্যদিকে দুদকের মামলায় ২০১৭ সালে তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে রায় দেয় বিচারিক আদালত।
তবে হত্যামামলায় হাইকোর্ট থেকে সোহেল রানার জামিন মিললেও আটকে যায় আপিল বিভাগে। গত ১৫ জানুয়ারি আপিল সেই আদেশ দেওয়ার সঙ্গে বিচার শেষ করার সময় বেঁধে দেয়।