Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

এই গরমে ওষুধে কি ওষুধের গুণ থাকছে

বগুড়ার সাত মাথার একটি ফার্মেসিতে থরে থরে সাজানো ওষুধ।
বগুড়ার সাত মাথার একটি ফার্মেসিতে থরে থরে সাজানো ওষুধ।
Picture of আসাফ-উদ-দৌলা নিওন

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন

বগুড়া শহরের সাত মাথার নদীবাংলা মেরিনা মার্কেট। আটতলা এই ভবনের ওপর থেকে নিচের তিনটি তলা পুরোপুরি ওষুধের গুদাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। দেশের উত্তর অঞ্চলের ওষুধের পাইকারি বাজারও নিয়ন্ত্রণ হয় এখানে থেকে। দিনে শত কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে।

জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবার এপ্রিলের দাবদাহে বগুড়ায় তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামেইনি। বরং ৪১ ডিগ্রি পর্যন্তও উঠেছিল।

এদিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, জীবন বাঁচানো পথ্যের গুণগত মান ঠিক রাখতে হলে এগুলো অন্তত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচের তাপমাত্রায় রাখতে হবে। এই বিষয়ে তারা বাংলাদেশ কেমিস্টস ও ড্রাগিস্টস সমিতিকে চিঠিও দিয়েছে।

গত ২২ এপ্রিল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ না করলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। রোগের চিকিৎসায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায় না। এ জন্য ওষুধ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে ওষুধ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনে এয়ার কন্ডিশনার, ক্রস ভেন্টিলেশন বা ফ্যান ব্যবহার করতে বলা হয়। তবে বগুড়ার মেরিনা মার্কেটের গুদামে তার বালাই নেই।

নদীবাংলা মার্কেটের পশ্চিম পাশেই খান মার্কেট। এই মার্কেটে রয়েছে ওষুধের বহু দোকান। নদীবাংলার গুদামে রেখে খান মার্কেটে পাইকারি ওষুধের ব্যবসা করেন তারা। একই অবস্থা এখানেও। সব ওষুধের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই কোনও দোকানেই। অথচ এসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারাও কিনছেন প্রয়োজনের তাগিদেই।

বগুড়ার সাত মাথার খান মার্কেটে ওষুধের অনেক দোকান, যেখানে ক্রেতার ভিড় লেগেই থাকে।

সম্প্রতি খান মার্কেটে ওষুধ কিনতে আসেন শহরের চেলোপাড়ার বাসিন্দা শাহাজাহান আলী। তিনি নিয়মিত ডায়াবেটিস, অ্যাসিডিটির সমস্যার ওষুধ কেনেন।

তাপমাত্রার কারণে ওষুধের গুণগত মান নষ্ট হওয়ার বিষয়ে কোনও ধারণা আছে কি না- জানতে চাইলে শাহাজাহান বলেন, তিনি জানেন না।

“দু-একটি দোকানে ফ্রিজ (রেফ্রিজারেটর) দেখা যায়। কিন্তু তারা এই ওষুধগুলো ফ্রিজে রাখে না। গরমের কারণে ওষুধের কী অবস্থা হয়, তাও জানি না। কিন্তু জরুরি দরকারে ওষুধ তো কিনতেই হয়।”

চার মাথা এলাকার বাসিন্দা ও জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা শমসের আলী হৃদরোগী। তিনিও নিয়মিতই ওষুধ কেনেন বগুড়ার কোনও কোনও ফার্মেসি থেকেই।

শমসের বলেন, “এই গরমের মধ্যে দোকান তো দূরের কথা, গোডাউনে ওষুধ কীভাবে থাকে, তার কোনও খবর কি কেউ রাখে? এসব ওষুধ খেয়ে আমাদের শরীরে নেগেটিভ প্রভাব পড়ছে কি না, তার খবর নেওয়ারও তো উপায় নেই।”

শহরের মালতিনগরের বাসিন্দা নার্গিস বেগমকেও নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। তিনিও বলেন, কিনতে গিয়ে কোনও ওষুধই নিম্ন তাপমাত্রায় রাখার কোনও ব্যবস্থা দেখেননি তিনি।

তার ভাষ্যে, সঠিক তাপমাত্রায় রাখতে হলে তো দোকানিদের আলাদা খরচ করতে হবে। এসি কিংবা ফ্রিজ কিনতে হবে। দোকানিরা এই বাড়তি খরচ করতে চাইবে না।

ওষুধ বিক্রেতাদের কয়েকজনই স্বীকার করছেন, সব ওষুধ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় সংরক্ষণের নির্দেশনা মানা সম্ভবপর হয় না। তবে ইঞ্জেকশন, চোখের ড্রপ এই ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রে তা মানা হয়।

সাত মাথার খান মার্কেটের আলম মেডিকেল স্টোরের মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, “আমরা মার্কেটে একাধিক ফ্যান রেখেছি। এটি (৩০ ডিগ্রি) ইঞ্জেকটেবল ওষুধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি এই আইটেমগুলো রাখি না। কারণ ইঞ্জেকশন টাইপ ওষুধে রিস্ক বেশি। তাপমাত্রার কমবেশি হলে কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।”

নদীবাংলা মার্কেটের ওষুধ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানও দাবি করেন, ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের বিষয়টি সব ওষুধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

“এটা তো সব ওষুধের জন্য না। ইঞ্জেকটেবল আইটেমের জন্য। এগুলো আমরা সবসময় ফ্রিজিং করে রাখি। অন্য ওষুধের ক্ষেত্রে (৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা) মেইনটেইন করার প্রয়োজন হয় না।”

সব ওষুধ সংরক্ষণে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রাখা ব্যয়বহুল হয়ে যাবে বলে তা মানা কঠিন বলে দাবি করেন রবিউল। পাশাপাশি বিদ্যুতের লোড শেডিংকেও সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেন তিনি।

“বিদ্যুৎ দুই-তিন ঘণ্টা ধরে না থাকলে ওষুধ ভালো থাকবে না। কারণ আইপিএস, জেনারেটর দিয়ে ফ্রিজ, এসি চালু করা সম্ভব না। আমাদের মার্কেটে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকলে এই নির্দেশনার কোনও কাজে আসবে না।”

অধিদপ্তরের কোনও নির্দেশনা তিনি পাননি বলেও জানান রবিউল। একই মার্কেটের কে আর মেডিকেল স্টোরের কর্মচারী মো. আরমানও বলেন, “এমন কোনও নির্দেশনা আমরা পাইনি।”

সাত মাথা এলাকার আরও ১০টি দোকানে খোঁজ নিয়েও জানা যায়, অধিদপ্তরের কোনও নির্দেশনার বিষয়ে কিছুই তারা জানে না।

জেলা ওষুধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই ওষুধের মার্কেট ছাড়া বগুড়ায় ১২ উপজেলায় অন্তত সাড়ে ৬ হাজার ওষুধের দোকান আছে।

বগুড়া ঠনঠনিয়া এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী আরিফ হাসান বলেন, তারাও এ রকম নির্দেশনা পাননি।

তাহলে কোন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা সাধারণত ওষুধের তাপমাত্রার লেবেল বুঝে দোকানে সংরক্ষণ করি। মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সেটি আলাদা করে রাখি।”

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার সিও অফিস বাসস্ট্যান্ড এলাকার মাহিন ফার্মেসির মালিক দেলোয়ার হোসেনও একই কথা বলেন।

“দরকারি ইঞ্জেকশন ধরনের ওষুধ সেগুলো রাখি (৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়) । অন্যগুলো আর সবাই যেভাবে বাইরে ডিসপ্লেতে রাখে, আমিও সেভাবে রাখি।”

বগুড়ার খান মার্কেটে ওষুধের পাইকারি দোকান থেকে অনেকে কেনেন ওষুধ। কিন্তু সেগুলো যথাযথ তাপমাত্রায় থাকে কি না, তা জানেন না।

ওষুধের বাজার তদারকি করার দায়িত্ব জেলা ঔষধ তত্ত্বাবধায়কের। কিন্তু তিনি সম্প্রতি বাজার পরিদর্শনে গেছেন, এমন কোনও খবর পাওয়া যায়নি।

জেলা ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বীকার করেন, জেলা সব ফার্মেসিতে ওষুধ সংরক্ষণের নির্দেশনা এখনও পৌঁছায়নি।

“এই নির্দেশনা বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির মাধ্যমে ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে।”

নদীবাংলা মার্কেটের ওষুধ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতা মিজানুর বলেন, জেলা ড্রাগিস্ট অ্যান্ড কেমিস্ট সমিতি থেকে ওষুধ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।

নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ করা না গেলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কতটা, জানতে চাওয়া হয়েছিল বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পল্লব কুমার সেনের কাছে।

তিনি বলেন, “চোখের অধিকাংশ ড্রপ অবশ্যই ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনও ড্রপের দাম ৩০ টাকার নিচে হলে ফার্মেসি মালিকরা তা আর ফ্রিজে রাখে না। এতে ড্রপের গুণাগুন নষ্ট হয়ে যায়।

“এছাড়া যত ধরনের ওষুধ আছে তার কোনওটিই ৩০ ডিগ্রির উপরের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে গুণগত মান ঠিক থাকবে না। তখন ওই ওষুধ সেবনে রোগীর কোনও লাভ হবে না। এই বিষয়ে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে, জনস্বার্থে।”

গরমে রাতারাতি ওষুধ নষ্ট হয়ে যাবে, তেমনটা নয় দাবি করে তিনি বলেন, “এই বিষয়টা এমন না যে গরমে থাকার জন্য রাতারাতি ওষুধ নষ্ট হয়ে যাবে। তার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। তারপরও আমরা ফার্মেসি মালিকদের কাছে চিঠি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছি, যাতে করে তাদের মাঝে সচেতনতা বাড়ে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত