Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

‘ক্রলিং পেগ’ চালুর দিনে খোলা বাজারে ডলার ১২৫ টাকা

ঢাকার মতিঝিলে মুদ্রা বিনিময়ের খোলা বাজার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঢাকার মতিঝিলে মুদ্রা বিনিময়ের খোলা বাজার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of আবদুর রহিম হারমাছি

আবদুর রহিম হারমাছি

নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্য দিয়ে একদিনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়ন হয়েছে; ডলারের দাম বেড়েছে ৭ টাকা। অর্থাৎ একদিনেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

ক্রলিং পেগ বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার থেকে ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এরসঙ্গে ১ টাকা যোগ ও ১ টাকা বিয়োগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ডলারের সর্বোচ্চ দর হবে ১১৮ টাকা।

এই দর অনুসরণ করেই বৃহস্পতিবার ডলার কেনাবেচা করেছে ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। কিনেছে ১১৬ টাকা ৫০ পয়সায়। অন্যদিকে বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) ও সিটি ব্যাংক ১১৮ টাকায় ডলার বিক্রি করেছে।

তবে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর এক লাফে বেড়ে ১২৫ টাকায় উঠেছে। বুধবার এই বাজারে ১১৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে প্রতি ডলার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিলের একটি মানি চেঞ্জারের মালিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বৃহস্পতিবার আসলে কোনও ডলার কেনাবেচা হয়নি। কেউ ডলার কিনতেও আসেনি, আবার বিক্রি করেনি। একেবারে খুব প্রয়োজন যাদের ছিল, তাদের দু-একজন ১২৫ টাকায় ডলার কিনেছে।”

তিনি বলেন, “এখন একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ ডলার কিনছেন না। ডলার কত টাকায় স্থির হবে, এটা বোঝার জন্য আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করেই বৃহস্পতিবার আমরা ডলার কেনাবেচা করেছি। সব ব্যাংকই এটা অনুসরণ করেছে।”

এর মধ্য দিয়ে ডলারের বাজার স্থিতিশীল হবে বলে আশা করেন তিনি।

২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় এক দশক দেশে মুদ্রার বিনিময় দর একটি স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তার সুবিধা পেয়েছে। তার ইতিবাচক প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতেও পড়েছে।

কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে দ্রুত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫/৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। রপ্তানিকারক, আমদানিকারক ও রেমিটেন্স প্রেরকদের মতো বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন সত্ত্বেও ডলারের বিপরীতে টাকার পতন অব্যাহত থাকে।

২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে দেশের মুদ্রাবাজারের বিনিময় দরে নজিরবিহীন অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দর ১১১ টাকায় উঠে যায়। ব্যাংকগুলো ১১৫/১১৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করে। ১২৩/১২৩ টাকা দরে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহ করে। এলসি (আমদানি ঋণপত্র) খুলতে নেয় ১২৪/১২৫ টাকা। অন্যদিকে খোলা বাজারে ডলারের দর ১২৭ টাকায় ওঠে।

তবে গত মার্চ মাস থেকে ডলারের তেজ কিছুটা কমতে থাকে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে তিন দফায় ডলারের দর কমিয়ে ১১১ টাকা থেকে ১১০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ক্রলিং পেগ চালুর আগ পর্যন্ত এই দরেই লেনদেন হয়েছে।

ব্যাংকগুলো রেমিটেন্স সংগ্রহ করছিল ১১৫/১১৬ টাকায়। আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম নেওয়া হচ্ছিল ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা। নগদ ডলার বিক্রি হচ্ছিল ১১৪/১১৫ টাকায়। খোলা বাজারে ছিল ১১৮ টাকা।

একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণ করে দিত। কিন্তু বাজার অস্থির হয়ে উঠলে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের দাম ঠিক করে আসছিল।

সর্বশেষ তারা ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকায় নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বাফেদা ও এবিবির বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা হয়েছে।

ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কী

চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কীভাবে এই পদ্ধতি চালু হবে—তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মার্চের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু করার কথা বললেও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দিল।

এখন প্রশ্ন এই ক্রলিং পেগ কী? কিছুদিন ধরেই এটা আলোচনা হচ্ছিল। বুধবার (৮ মে) এই পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সেই আলোচনা আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার থেকে টাকা-ডলারের যে বিনিময় হার পদ্ধতি ঠিক করেছে, তার নাম দিয়েছে ক্রলিং পেগ। সহজ করে বলা যায়, এখন থেকে দেশের মধ্যে ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিতে পারবে। আর সেই হামাগুড়ি দিতে হবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না।

সীমাটা কী? আপাতত সেই সীমা হচ্ছে ১১৭ টাকা। এর নাম হচ্ছে ক্রলিং পেগ মিড-রেট বা মধ্যদর। ডলারের বিনিময়মূল্য এর আশপাশেই থাকতে হবে। অর্থাৎ বিনিময় হারের আর কোনও উচ্চসীমা বা নিম্নসীমা নেই, কিন্তু মধ্যসীমা আছে। এটাই মেনে চলতে হবে। বলা যায়, স্বাধীনতা আছে, তবে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রিত।

এতে অবশ্য ডলারের দর একবারেই লাফ দিয়েছে ৭ টাকা। গত মঙ্গলবার এই ডলারের দর ছিল ১১০ টাকা। ২০২২ সালে ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা। সুতরাং প্রায় আড়াই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বা লাফ দেওয়ার হার ৩৬ শতাংশ। আরও বেশি লাফ দেওয়া ঠেকাতেই এল নতুন এই ক্রলিং পেগ পদ্ধতি।

বিদেশি মুদ্রার বিনিময়ের বাজারে কোনও সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না, এমনটাই আদর্শ মনে করা হয়। উন্নত দেশগুলো এই আদর্শ মেনে চললেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তা মানা সম্ভব হয় না। বিনিময় হারে কোনও হস্তক্ষেপ থাকবে না, এটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ভাসমান বিনিময় হার বা ফ্রি ফ্লোটিং। অর্থাৎ বিনিময় হার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক। বাজার ঠিক করে দেবে, বিনিময় হার কত হবে। চাহিদা আর জোগানই এখানে আসল নির্ধারক।

এখন সরকার যদি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে কী হবে? তখন চিত্রটি হবে অন্য রকম। তখন বিনিময় হারের পদ্ধতিকে কয়েকটি ভাগ করা যায়। যেমন- বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট মানে আটকে রাখলে তাকে বলা হয় স্থির বিনিময় হার। একে পেগড বিনিময় হারও বলা যায়। প্রয়োজন অনুসারে এই হারকে পুনর্বিন্যস্ত বা সমন্বয় করে নতুন একটি হার ঠিক করা হয়। যাকে বলা হয় অ্যাডজাস্টেবল বিনিময় হার।

আরেকটি হচ্ছে পরিচালিত বা ম্যানেজড বিনিময় হার। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুসারে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার ঠিক করে দেয়। এই পদ্ধতিকে অনেকে নোংরা বা ডার্টি ফ্লোটিং রেটও বলে। কারণ, এর মাধ্যমে দেশগুলো নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে বিনিময় হারকে অপব্যবহার করে।

ক্রলিং পেগ আসলে স্থির বিনিময় হারেরই আরেকটি রূপ। অর্থাৎ বিনিময় হার স্থির করা আছে, সেই স্থির করা হারের আশপাশে ডলার বিনিময় করতে হবে সব পক্ষকে। এই যে মধ্যদর ১১৭ টাকা, এটি বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনও সময় বদল করতে পারবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তা নির্ভর করবে।

সাধারণত, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনও দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই এই পদ্ধতি বেশি দেখা যায়।

বাংলাদেশ গত দুই বছরে বিনিময় হার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হলে ডলারের সরবরাহ কমে যায়। ফলে বাড়তে থাকে এর দর। দরের লাফ দেওয়া ঠেকাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েও লাভ হয়নি। এমনকি চারটি দরও ঠিক করা হয়েছিল। এতে সংকট আরও বেড়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত আইএমএফের শর্ত মেনেই বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ঠিক করতে হলো।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত