Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ভারত কেন পাকিস্তানকে রাভি নদীর পানি দেবে না

ভারতের জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাব প্রদেশের সীমান্তে রাভি নদীর উপর শাহপুরকান্দি বাঁধ। ছবি: এনডিটিভি।
ভারতের জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাব প্রদেশের সীমান্তে রাভি নদীর উপর শাহপুরকান্দি বাঁধ। ছবি: এনডিটিভি।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

৪৫ বছর পর ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী পাঞ্জাবের রাভি নদীর উপর শাহপুর কান্দি বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হতে চলেছে। একইসঙ্গে রাভি নদী থেকে পাকিস্তানে পানি প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণাও দিল ভারত।

ভারতের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি ব্যবস্থাপনায় এই কৌশলগত পদক্ষেপের ফলে ভারত বাড়তি ১১৫০ কিউসেক পানি ধরে রাখতে পারবে, যা আগে পাকিস্তানের দিকে যেত। এই বাড়তি পানি এখন জম্মু ও কাশ্মীরে কৃষি কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

শাহপুর কান্দি বাঁধের গুরুত্ব এবং এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তির সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত?

শাহপুরকান্দি বাঁধ বিত্তান্ত

দীর্ঘ ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে শাহপুর কান্দি বাঁধের কাজ আটকে ছিল। এই বাঁধ নির্মাণে প্রথম উদ্যোগটি নেওয়া হয় ১৯৭৯ সালে। সে বছর পাঞ্জাব এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল ও শেখ আবদুল্লাহ একটি চুক্তি করেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তিতে দুই রাজ্যের সীমান্তে রাভি নদীতে রঞ্জিত সাগর (থেইন) নামে একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। আর পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার শাহপুরকান্দিতে আরেকটি ব্যারেজ তৈরির কথা বলা হয়।

১৯৮২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রঞ্জিত সাগর বাঁধ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন, যার কাজ ১৯৯৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা শেষ হতে সময় লাগে ২০০১ সাল পর্যন্ত।

অন্যদিকে, শাহপুরকান্দি বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। কংগ্রেস পার্টির প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু, ভারতের জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিরোধের জেরে প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়েছিল।

২০০১ সালে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী দেশজুড়ে ত্বরিত সেচ সুবিধা প্রকল্পের অধীনে শাহপুরকান্দি বাঁধ প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু তিনিও এর কাজ শুরু করতে পারেননি।

এরপর ২০০৮ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সময় শাহপুরকান্দিকে একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারপরও এর কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। কিন্তু ফের দুই প্রদেশের বিরোধে ২০১৪ সালে প্রকল্পটির কাজ স্থগিত হয়ে যায়।

অবশেষে ২০১৮ সালে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে পাঞ্জাব প্রদেশ এবং জম্মু-কাশ্মীর একটি সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছায়। ওই চুক্তিতে তিন বছরের মধ্যে শাহপুরকান্দি বাঁধের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

কিন্তু তাও বাঁধের কাজ ধীর গতিতে এগোয় এবং শেষ করতে প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগে যায়। অবশেষে তা এবছর সমাপ্ত হতে চলেছে। বাঁধটির ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, বাকি কাজ শেষ হতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে। ৫.৫ মিটার উচ্চতার বাঁধটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৩০০ কোটি রুপি।

এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি একটি বহুমুখী নদী উপত্যকা প্রকল্পের অংশ, যার মধ্যে ২০৬ মেগাওয়াট ইনস্টল ক্ষমতাসহ দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও রয়েছে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটির কাজ ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাঁধের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী শাহপুরকান্দি বাঁধ প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন, কারণ এতে জম্মু ও কাশ্মীরের হাজার হাজার একর কৃষি জমিতে প্রয়োজনীয় পানি সেচ দেওয়া সম্ভব হবে।

রবিবার তিনি তার উধমপুর সংসদীয় আসনের কাথুয়া জেলার বাসোহলিতে এক জনসভায় বলেন, “২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী না হলে শাহপুরকান্দি বাঁধ প্রকল্প– যা ৭০ বছর ধরে বন্ধ ছিল– ফের শুরু হতো না।”

শাহপুর বাঁধের গুরুত্ব

বাঁধটি জম্মু ও কাশ্মীরের পাশাপাশি পাঞ্জাবের মানুষদের জন্যও বেশ উপকারী হবে। প্রকল্পের একজন মুখপাত্র বলেন, এই বাঁধের ফলে সাম্বা ও কাথুয়া জেলার জম্মু-পাঠানকোট জাতীয় সড়কের পাশের কান্দি এলাকায় ৩২ হাজার হেক্টর আর পাঞ্জাবের ৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে পানি সেচ দেওয়া সম্ভব হবে।

প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা দ্য প্রিন্টকে বলেন, “শাহপুর কান্দি বাঁধটি চালু হলে পাকিস্তানের দিকে যাওয়া পানি আটকে রঞ্জিত সাগর বাঁধটিকে পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এই পানি শাহপুর কান্দির ভাটিতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ছেড়ে দেওয়া হবে। এতে মাধোপুর ব্যারেজের পানি আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে।”

এই বাঁধের ফলে জম্মু-কাশ্মীর কমপক্ষে ১,১৫০ কিউসেক পানি বেশি পাবে। আগে এই পানি ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তির অধীনে পাকিস্তানকে দেওয়া হতো। এ ছাড়া বাঁধ থেকে উৎপাদিত জলবিদ্যুতের ২০ শতাংশও পাবে জম্মু ও কাশ্মীর।

সিন্ধু পানি চুক্তি

সিন্ধু পানি চুক্তিতে ভারতকে সিন্ধু উপত্যকার পূর্বাঞ্চলের সুতলেজ, বিয়াস ও রাভি নদীর পানির ওপর একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়, যার পরিমাণ বার্ষিক ৩৩ মিলিয়ন একর-ফুট (এমএএফ)। আর পাকিস্তানকে দেওয়া হয় পশ্চিমের সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পানির অধিকার, যার পরিমাণ ১৩৫ মিলিয়ন একর-ফুট (এমএএফ)।

১৯৬০ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই চুক্তি সই করেছিলেন। বিশ্ব ব্যাংকও এই চুক্তির একটি পক্ষ। চুক্তি অনুসারে, ভারত তার নদীগুলোর পানি নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবে। তবে পাকিস্তানের নদীগুলোতে স্টোরেজ সিস্টেম বা বাঁধ তৈরিতে বিধি-নিষেধ রয়েছে।

এছাড়া ভারতকে নদীগুলো ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অধিকার দেওয়া হয়। তবে তা নির্দিষ্ট নকশা ও পারিচালন পদ্ধতি মেনেই করতে হবে। অন্যদিকে, পাকিস্তানকেও ভারতীয় প্রকল্পের নকশা নিয়ে আপত্তি করার অধিকার দেওয়া হয়।

কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি হলো, পাকিস্তানের আপত্তির কারণে তারা সুতলেজ, বিয়াস ও রাভিতে স্টোরেজ সিস্টেম বা বাঁধ তৈরি করতে পারছে না। অথচ চুক্তিতে বলা আছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারত চাইলে তার নদীগুলোতে বাঁধ তৈরি করতে পারবে।

কিন্তু ভারতের অভিযোগ, এই ধরনের যে কোনও প্রচেষ্টায় পাকিস্তান বাধা দেয়। এই নদীগুলো জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত হওয়া সত্বেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবেই রয়ে গেছে।

গত বছরের জানুয়ারিতে ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি সংশোধনের জন্য পাকিস্তানকে নোটিস দিয়েছিল। নোটিসটি সিন্ধু পানি কমিশনারের মাধ্যমে পাঠানো হয়, কারণ ইসলামাবাদ নয়াদিল্লির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছর ধরে ভারতের কিষেণগঙ্গা ও রটল হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রকল্পের সমস্যা সমাধানে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ভারত ইতোমধ্যে সুতলেজ, বিয়াস ও রাভি নদীতে বেশ কয়েকটি বাঁধ ও পানি সংরক্ষণ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুতলেজ নদীতে ভাকরা বাঁধ, বিয়াস নদীতে পং ও পান্ডোহ বাঁধ, বিয়াস-সুতলেজ সংযোগ এবং ইন্দিরা গান্ধী নহর প্রকল্প।

এসব প্রকল্পের মাধ্যমে সিন্ধু উপত্যকার পূর্বাঞ্চলের নদী তিনটির প্রায় ৯৫ শতাংশ পানি ভারত ব্যবহার করছে। শুধু রাভি নদীর আনুমানিক ২ মিলিয়ন একর ফুট পানি পাকিস্তানে যেত। শাহপুর কান্দি বাঁধের কাজ শেষ হওয়ায় ভারত এখন রাভি নদীর পানিও পুরোপুরি নিজের কাজে লাগাতে পারবে।

তথ্যসূত্র: ফার্স্টপোস্ট, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত