Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

যৌনকর্মী থেকে পাচারকারী, জাল তার বাংলাদেশেও

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা মায়মুনা ওরফে সালমা ভারত-বাংলাদেশের তিন হাজার নারীকে পাচার করে। ছবি: ফার্স্টপোস্ট।
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা মায়মুনা ওরফে সালমা ভারত-বাংলাদেশের তিন হাজার নারীকে পাচার করে। ছবি: ফার্স্টপোস্ট।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় ৩ হাজার নারীকে পাচার করা মায়মুনা ওরফে সালমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, ৫০ বছর বয়সী সালমার শিকারের প্রিয় জায়গা ছিল তার নিজ রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকেও অনেক নারীকে পাচারে তিনি জড়িত।

সালমা নিজেও যৌনকর্মী, তাকে এক সময় দিল্লির রেড-লাইট এলাকায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে তিনি নিজেও যৌন ব্যবসা ও মানব পাচারে জড়িয়ে পড়েন।

সালমা ছিলেন জিবি রোডের ৭০ নম্বর কোঠার (যৌনপল্লী) মালিক, সেখানে তার পরিচয় ‘বড় ম্যাডাম’। এই আস্তানাটি কেনার আগে তিনি ৫৬ নম্বর কোঠার ‘ম্যাডাম’ বা ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন। পরে ধীরে ধীরে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। গত মঙ্গলবার তাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে তার সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটল।

পুলিশ ছাড়াও নারীপাচার রোধে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে সালমাকে চোখে চোখে রাখছিল।

তেমনই একটি সংগঠন মিশন মুক্তি ফাউন্ডেশনের পরিচালক বীরেন্দ্র সিং ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টকে বলেন, “আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই সালমার ওপর নজর রাখছিলাম। একাধিক সূত্রে আমরা অভিযোগ পেয়েছি, সালমা ভারতজুড়ে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অল্পবয়সী মেয়েদের (যাদের বেশিরভাগই নাবালিকা) পাচার ও যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর হোতাদের একজন। তার বিশাল নেটওয়ার্ক দেখে আমাদের অনুমান, তিনি তার ২০ বছরের কর্মজীবনে প্রায় ৩ হাজার তরুণী ও নারীকে যৌন বাণিজ্যে ঠেলে দিয়েছেন।”

সালমাকে গ্রেপ্তারের সময় মুক্তি ফাউন্ডেশনও পুলিশের সঙ্গে ছিল। এর আগে পুলিশ সালমার শিকার পশ্চিমবঙ্গের এক নারীকে উদ্ধারে ফাউন্ডেশনটির সহায়তা চেয়েছিল। এরপর ফাউন্ডেশনটিই সালমাকে শনাক্ত করে এবং পুলিশ তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেপ্তার করে।

বীরেন্দ্র সিং করেন, “আমাদের সন্দেহ, বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারের নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গেও সালমার যোগসাজশ আছে।”

কাকতালীয়!

গত বছরের ২৬ জুলাই ফরিদা (১৯, ছদ্মনাম) দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুর থানার বলবালিয়া গ্রামে তার বাবা-মার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আর তিনি পৌঁছাননি। তার সঙ্গে তার ৪ বছরের ছেলেটিও ছিল।

ফরিদা নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন পর তার ভাই থানায় অভিযোগ করেন। তাতে তিনি লেখেন, “আমার বোনকে (২৬ জুলাই, ২০২৩ সাল থেকে নিখোঁজ) ২৫ আগস্ট, ২০২৩-এ দিল্লির জিবি রোডে দেখেছে আমাদেরই এক আত্মীয়।”

ফরিদার আত্মীয় বিল্লু (ছদ্মনাম) দিল্লিতে তাকে এক ঝলক দেখেছিলেন। তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই অভিযোগটি ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ মামলায় রূপান্তরিত করে পুলিশ।

এরপর ৩০ অক্টোবর ২০২৩-এ বারুইপুর পুলিশ মিশন মুক্তি ফাউন্ডেশনের বীরেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই নারীকে খুঁজে বের করতে এবং উদ্ধারে সাহায্য চায়।

বীরেন্দ্র সিং ফার্স্টপোস্টকে বলেন, “আমরা ছদ্মবেশে আমাদের লোককে জিবি রোডে পাঠাই এবং দুবার জায়গাটিতে অনুসন্ধান চালাই। কিন্তু ভিকটিমকে খুঁজে পাইনি। তারপর, একদিন সেখানে থাকা আমাদের এক লোক ওই নারীকে দেখতে পায় এবং আমরা বিষয়টি পুলিশকে জানাই। ২৪ নভেম্বর দিল্লি পুলিশের একটি যৌথ দলসহ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আমাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে যৌনপল্লীতে অভিযান চালিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করে।”

উদ্ধার হওয়ার পর ফরিদা প্রথমে লজ্জায় ও সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে বাড়ি ফিরতে চাননি। কিন্তু অনেক বোঝানোর পর তিনি রাজি হন। তিনি মুখ খোলার পর মামলাটি পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অভিযান

অপহরণের অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সিআইডি সালমার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আনে। পুলিশের অ্যান্টি-হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিটের (এএইচটিইউ) একজন নারী উপ-পরিদর্শক সালমাকে গ্রেপ্তারে সহায়তার জন্য বীরেন্দ্র সিংকে চিঠি লেখেন। বীরেন্দ্র সিং এবারও রাজি হন।

সিং ফার্স্টপোস্টকে বলেন, “আমাদের তথ্যদাতারা গত মঙ্গলবার ৭০ নম্বর কোঠায় সালমার অবস্থান নিশ্চিত করে। এরপর আমরা দিল্লি পুলিশকে জানাই। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি ও দিল্লি পুলিশের অভিযানে আমরাও যোগ দিই। অবেশেষে আমরা তাকে আটক করেছি।”

সালমার অন্ধকার সাম্রাজ্য

সালমা ২০১৬ সালের দিকে জিবি রোডের ৭০ নম্বর কোঠাটি কেনার আগে ৫৬ নম্বর কোঠায় ছিলেন।

বীরেন্দ্র সিং জানান, যৌন ব্যবসায়ী আফাক হোসেন ও তার স্ত্রী সায়রা বেগমের ৫৬ নম্বর কোঠার নায়িকা বা ম্যানেজার ছিলেন সালমা। তাদেরও কয়েক বছর আগে হাজার হাজার নারী ও শিশুকে পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।

ওই জুটি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশসহ সমগ্র ভারত ও নেপাল থেকেও মেয়েদের নিয়ে আসত। চাকরি, বিয়ে ইত্যাদির অজুহাতে তাদের দিল্লিতে নিয়ে এসে যৌন পল্লীতে ঠেলে দিত। ভুক্তভোগীরা তাদের আয় থেকে ওই দম্পতিকে বিশাল পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকতো।

বীরেন্দ্র সিং জানান, ওই দম্পতির গ্রেপ্তারের পর সালমা তাদের জমানো বিশাল পরিমাণ অর্থ চুরি করে পালিয়ে যান। কয়েকবছর গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর জিবি রোডে ফিরে এসে ৭০ নম্বর কোঠাটি কিনে নিজের সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু করেন।

ভুক্তভোগীরা লজ্জায় বাড়ি ফিরতে চায় না

অনিচ্ছাকৃত ও জোরপূর্বক যৌন ব্যবসায় নামা নারীরা উদ্ধারের পর লজ্জায় বাড়ি ফিরে যেতে চান না।

উদ্ধারের পর বীরেন্দ্র সিং ফরিদার সাক্ষাৎকার নেন। ফরিদা জানান, এমনকি তিনি নিজেও জানেন না যে, তাকে কত টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, “আমি আমার ছেলেকে মাসে মাত্র একবার দেখতে পেতাম। তারা আমাকে একটি বাড়িতে কাজের বুয়া হিসেবে কাজ করার এবং ভালো বেতনের লোভ দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসে।”

বীরেন্দ্র সিং তাকে তার বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিলে ফরিদা ‘আমি বাড়িতে আসতে চাই’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে তার পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন এবং একটি স্থানীয় এনজিও তাকে কাউন্সেলিং করছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত