এই তো মাস তিনেক আগেও মমতা শঙ্কর আর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় এক সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকায় নতুন সিনেমা ‘বিজয়ার পরে’ নিয়ে আড্ডায় মেতেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে স্বস্তিকা হাতাকাটা ব্লাউজের সঙ্গে শাড়ি পরেছিলেন। শাড়ির আঁচল বাম কাঁধে ফেলেছিলেন; ডান দিকে আঁচল টানার সময় খানিক নামিয়ে পরেছিলেন।
ফ্যাশন নিয়ে সব সময় সাহসী স্বস্তিকার এভাবে শাড়ি পরা নতুন কিছু নয়। বলিউড, টালিউড এবং ঢালিউডেও আর সব মডেল ও নায়িকারাও এমন করে শাড়ি পরছেন হরদম।
‘মম পিসির’ হাত ধরে সেদিন আড্ডাতে অনেক বিষয় নিয়ে অনেক কথা বললেও হালে দুজনের মন কষাকষি হয়েছে শাড়ির আঁচল নামিয়ে পরা নিয়েই।
আঁচল নামিয়ে পরায় আপত্তি মমতার
গত মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে এক ফ্যাশন শোতে দেখা গেল বিবি রাসেল, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দোপাধ্যায়কে।
আনন্দবাজার অনলাইনকে ব্রততী বলেছিলেন, ফ্যাশন মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা।
অভিনয় শিল্পী মমতা শঙ্করের কাছে প্রশ্ন ছিল, নতুন প্রজন্মের সাজ নিয়ে কী ভাবনা?
৭০ ছুঁই ছুঁই মমতা শঙ্কর বলেন, “আজকাল যেরম হয়েছে যে আমি শাড়ি পরব কিন্তু আমার আঁচলটা প্রপারলি থাকবে না… আমার আঁচলটা এখান থেকে যাবে। এটা না আমি বুঝতে পারি না।
“যাদের আমরা রাস্তার মেয়ে বলতাম, যারা ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে থাকে, তারা ওইরকম ভাবে দাঁড়াতো। কিংবা যদি গ্রামে কাজ করতে করতে তার হয়তো সরে যেত। সেটা কোনো দোষের ছিল না। মানুষকে এট্রাক্ট করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের আমি শ্রদ্ধা করছি; তারা তাদের প্রফেশনের জন্য এটা করছে।”
“কিন্তু আজকাল যারা বিনা কারণে ওইরকম ভাবে শাড়ি পরেন এবং তারপর লোকে কিছু বললে তারা রেগে যান … মেয়েদের নিচু করা হচ্ছে … মেয়েরাই তো মেয়েদের নিচু করছি আমরা। আমি এটার প্রোটেস্ট করি। কারণ আমাদের একটা শালীনতা … একটা জায়গা আছে যেখানে ছেলেরা আমাদের রেসপেক্ট করবে। তো ছেলেরা-পুরুষ রেসপেক্ট করবে কী করে যদি আমার এরকম ডিগনিটি না থাকে ।”
কিন্তু মান-সম্মান কি পোশাকের উপর নির্ভর করে? আনন্দবাজার প্রতিনিধি এই প্রশ্ন রেখেছিলেন এরপর।
জবাবে মমতা বলেন, “প্রথমে আমরা চোখে দেখে একটা ইমপ্রেশন ক্রিয়েট করি। আমরা প্রত্যেকেই জাজমেন্টাল। আমার কথা হচ্ছে, আমরা মেয়েরা এরকম ইমপ্রেশন দেব কেন? আমি হয়তো খুব ভালো মেয়ে, ভীষণ ভালো মেয়ে। কিন্তু আমি ওইভাবে পোশাকটা পরব কেন তাহলে?”
বুকের আঁচল নিয়ে যত বিতর্ক
শাড়ির আঁচল পরার ধরন নিয়ে মমতা শঙ্করের মন্তব্যে দুই বাংলা থেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় ওঠে। সাধারণ মানুষ থেকে সিনেপাড়ার তারকারাও পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে যান।
বর্ষীয়ান মমতা শঙ্করের সিনেপাড়ায় যে অবস্থান সেই সম্মানবোধ থেকে বহুজন তার সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেইসবুক প্রোফাইল অনুসারে তিনি একজন সাংবাদিক এবং সিনেমা গবেষক।
মমতা শঙ্করের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে তিনি মনে করিয়ে দেন, এই অভিনেত্রী ‘পিছিয়ে থাকা’ মন-মানসিকতার কেউ নন।
নিজের ফেইসবুক টাইমলাইনে গত ২১ মার্চ শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যারা ওঁনাকে পিছিয়ে থাকা বলছেন তারা জানেন কি মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ উনি ব্লাউজ ছাড়াই দিনের পর দিন শ্যুট করেন।”
নৃত্যশিল্পী, নৃত্য পরিকল্পক ও অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর এবং মিঠুন চক্রবর্তীর অভিনয় গুণে মৃগয়া সিনেমা অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
মৃণাল সেন পরিচালিত ১৯৭৬ সালের এই সিনেমায় আদিবাসী মেয়ের চরিত্র করেছিলেন মমতা শঙ্কর। সিনেমায় তাকে শুধু গামছা গায়ে জড়িয়ে দেখা গেছে।
এই সিনেমা নিয়ে ২০১৬ সালে আনন্দবাজারের কাছে তিনি বলেছিলেন, ”সিনেমায় গ্রাম্য চরিত্র করতে গেলে মেয়েরা ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরলেও সেফটিপিন দিয়ে লুকিয়ে অন্তর্বাস পরে। যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায়। আমি সেই সময় গামছা জড়িয়ে নিয়েছিলাম। কারণ মৃণাল সেন বলেছিলেন কোনও সেফটিপিন ব্যবহার করা যাবে না।
“গায়ে শুধু গামছা আর নিচে লুঙ্গি, সেটা পরেই আমি জল তুলেছি, কাঠের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে হেঁটেছি। আর সেটা করতে আমার কোনও অস্বস্তি হয়নি। আমার বাড়ির লোকও সাপোর্ট করেছিল। কারণ আদিবাসী মেয়ের চরিত্রটা সেটাই ডিমান্ড করে। ওরা ও রকম পোশাকই পরে। সেটাকে সম্মান জানানোর জন্যই আমার ও রকম পোশাক পরা।”
তবে যারা মমতার পক্ষে উঠেছেন তাদের অনেকে এও বলেছেন, ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের কথা তোলাটা তার ভুল ছিল। পরে মমতা শঙ্কর ওই পেশার নারীদের শ্রদ্ধা-সম্মান জানালেও, এই প্রসঙ্গে তাদের টেনে আনাটা অযাচিত ছিল।
আর সমালোচনাকারীদের মধ্যে কেউ কেউ আনন্দ শঙ্কর ও তনুশ্রী শঙ্করের মেয়ে শ্রীনন্দা শঙ্করের প্রায় খোলামেলা বুকের ছবি শেয়ার করে ফেইসবুকে কেউ কেউ জানান, মমতা শঙ্কর সম্পর্কে তার পিসি হন।
নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন গত ২১ মার্চ ফেইসবুকে মমতা শঙ্করের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে গিয়ে বলেন, “ …আকৃষ্ট হলেই যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় না কারও ওপর, এই শিক্ষাটা দিতে হয় সবাইকে। ঘরে বাইরে, পত্র পত্রিকায়, স্কুলে-কলেজে, রেডিও-টেলিভিশনে। সেটা না করে মেয়েদের শরীরে ঘুংঘট আর ঘোমটা চড়ানোটাই চূড়ান্ত অশালীনতা, অশ্লীলতা।
“…বাংলার নামী নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর মেয়েদের শালীনতা বজায় রাখতে বলেছেন, তা না হলে পুরুষেরা মেয়েদের খারাপ ভাববে- এই যুক্তি দিয়ে। যে পুরুষেরা মনে করে মেয়েদের শালীনতা নির্ভর করে মেয়েরা কাপড়চোপড় দিয়ে শরীর কতটা ঢাকলো তার ওপর, সেই পুরুষদের তিরস্কার না করে মমতা শঙ্কর তিরস্কার করছেন মেয়েদের। তিরস্কার করে তিনি যে পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক–সেটাই আবার প্রমাণ করলেন। ”
আঁচল নামিয়ে স্বস্তিকার ছবি
স্বস্তিকাকে শিশু বয়স থেকেই চেনেন মমতা শঙ্কর। জাতিশ্বর থেকে শুরু করে দুজন এক সঙ্গে চতুর্থবারের মতো কাজ করেছেন ‘বিজয়ার পরে’ সিনেমায়।
দুই প্রজন্মের দুই অভিনয়শিল্পী শাড়ির আঁচল পরার ধরন নিয়ে বিতর্কে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন।
মমতা শঙ্করের ওই মন্তব্যের নানা ভাবে বিরোধিতা করে চলেছেন স্বস্তিকা।
২১ এপ্রিল এই নায়িকা আরও দুজন নারীর সঙ্গে শাড়ি পরা ছবি ফেইসবুকে শেয়ার করেন। ছবিতে তিনজনেই বুকের আঁচল এক দিকে বেশ নামিয়ে পরেছেন।
এর আগের দিন কলকাতার অংশুমান দে তার আঁকা একটি ডিজিটাল স্কেচ ফেসবুকে শেয়ার করেন; যার শিরোনাম হলো – ‘লেডি ইন শাড়ি, আন্ডার দ্য ল্যাম্প পোস্ট’ অর্থ্যাৎ সড়কবাতির তলে শাড়িতে নারী।
এই ছবি শেয়ার করে স্বস্তিকা বলেন, “আমিও এরকম একটা ছবি তুলব, ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়ানো খারাপ মেয়েগুলোকে উৎসর্গ করে। শাড়ির আঁচলেই কি না সব সম্মান লুকিয়ে আছে যদি ওরা জানতো।”
মমতা কি মত পাল্টাবেন?
কিছুদিন আগে প্রধান সিনেমার ১০০ দিন পূর্তিতে এসেছিলেন মমতা শঙ্কর। চারিদিকে আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে এবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমার কিচ্ছু গায়ে লাগছে না।
“এত লোক আমাকে সাপোর্ট করেছেন, তাই আমি ওসব ভাবছি না। যারা ওইরকম ভাষা দিয়ে ওইরকম ভাবে আমাকে ট্রোল করেছেন। তারা নিজেদের ছোট করলেন আর কিছু নয়।”
আঁচল নামিয়ে পরা নিয়ে বিতর্ক এখনও চাঙ্গা রয়েছে তা বোঝা গেলো টালিউডের অভিনয়শিল্পী শ্রীলেখা মিত্রের পোস্টে।
রোটারি বেনেভোলেন্স এক্সিলেন্সি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে গিয়ে মমতা শঙ্করের পাশে বসে ছবি তুলে ২১ এপ্রিল ফেইসবুকে পোস্ট করে তিনি বলেন, “আমরা এভাবেই শাড়ি পরি।”
শ্রীলেখাকে পাশে পেলেও স্বস্তিকার সমালোচনা নিয়ে কী বলবেন ‘মম পিসি’?
মমতা শঙ্কর বলেন, “আজকে স্বস্তিকা যেরকমভাবে বলেছে, ও আমার মেয়ের মতো। ওকে আমি এতো ভালোবাসি। ও এতো ভালো অভিনেত্রী।
“ও সোজাসুজি আমার সামনে এসে কথাটা বললে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু ও যেভাবে একটা ছবি দিয়ে নিজের অবস্থান জানালো, তাতে ও নিজেকে ছোট করল। আমি যেটা বলেছি আমি তাতে অনড়, আমার কথা এদিক ওদিক হবে না।”
আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “শাড়ি পরার নানা ধরন নিয়ে আমি কিছু বলিনি। আমি আঁচল নিয়ে বলেছি। আমি সেটা এখনও বলছি। আমি সেটা বলে যাবো।”
আঁচল নামিয়ে শাড়ি
১২ হাতের শাড়ি পরার একশ রকমের ধরন আছে।
ভারতের এক নম্বর ড্রেপিং আর্টিস্ট হয়ে উঠেছেন ডলি জৈন। ৩২৫ ধরনের ভিন্ন স্টাইলেও শাড়ি পরাতে জানেন এই ড্রেপিং তারকা। শাড়ি পরিয়েই কামিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
আঁচলের ভাঁজে একটু বদল করলে, আঁচল একটু ঘুরিয়ে পরলেই শাড়ি পরার ধরন আলাদা হয়ে ওঠে।
ফ্যাশন জগত হোক অথবা বিয়েবাড়ি আজকাল অনেকেই শাড়ির আঁচল এক দিকে নামিয়ে পরেন।
এভাবে শাড়ি পরলে ফ্যাশন ডিজাইনারদের সাধারণ পরামর্শ হচ্ছে, নজর দিতে হবে ব্লাউজ এবং অন্তর্বাসে।
শরীরের গড়ন অনুসারে বেছে নিতে হবে সঠিক মাপের ব্লাউজ। ব্লাউজ বেশি আঁটোসাঁটো হওয়া যাবে না; আবার খুব ঢিলেঢালাও নয়। চোখা সেলাইয়ের অন্তর্বাসও এড়িয়ে যাওয়া যায় শাড়ির আঁচল নামিয়ে পরলে।