সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ এ অভিযান চালায় বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলে বসে এই পরীক্ষার প্রশ্নের সমাধান করেন তাদের দুইজন। পরীক্ষা শুরুর আগেই পরীক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হতো উত্তরপত্র।
ডিএমপির ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গত ২৯ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষা হয়। এই ধাপে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২১ জেলার সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেন। পরীক্ষা চলাকালে প্রশ্নের উত্তরপত্র ও ডিভাইসসহ মাদারীপুরে সাতজন ও রাজবাড়ীতে একজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় দুই জেলায় মামলা হয়। রাজবাড়ীতে গ্রেপ্তার পরীক্ষার্থী আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে দুইজন ঢাবির শিক্ষার্থী, তিনজন পরীক্ষার্থী। তারা হলেন- ঢাবির জ্যোতির্ময় গাইন (২৬) ও সুজন চন্দ্র রায় (২৫) এবং পরীক্ষার্থী মনিষ গাইন (৩৯), পংকজ গাইন (৩০) ও লাভলী মন্ডল (৩০)।
জবানবন্দিতে রাজবাড়ীতে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থী কীভাবে, কখন তার মোবাইলে উত্তরপত্র এসেছে তা জানান। মাদারীপুরে গ্রেপ্তার পরীক্ষার্থীদের বেশিরভাগই জামিনে বের হয়ে যান। এরপর মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাসুদ আলমের অনুরোধে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম দক্ষিণ বিভাগ তদন্তে নামে। গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জ্যোতির্ময় গাইন ও সুজন চন্দ্রকে। তারা দুজনেই ঢাবির জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, জ্যোতির্ময় ও সুজন গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, পরীক্ষার আগেই তারা প্রশ্ন পেয়েছেন সমাধানের জন্য। এই প্রশ্ন সমাধানের দায়িত্ব পেয়েছেন জ্যোতির্ময় গাইনের চাচা অসিম গাইনের মাধ্যমে। প্রশ্নপ্রতি ১২-১৫ হাজার টাকার আশ্বাসে তাদের দিয়ে প্রশ্ন সমাধান করান অসিম। এই প্রস্তাবে জ্যোতির্ময় ও সুজনসহ সাতজন ঢাবির জগন্নাথ হলের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনের ২২৪ রুমে বসে প্রশ্নের সমাধান করে পাঠান।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন জানান, অসিম তার ভাতিজা জ্যোতির্ময় গাইনকে প্রশ্ন সামাধানের দায়িত্ব দেন। অসিম নিজে পরীক্ষার দুই থেকে তিন মাস আগে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বিশেষ করে যাদের চাকরির বয়স শেষের পথে, এমন পরীক্ষার্থীদের টার্গেট করতেন অসিম। তাদের পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকায় চুক্তি করতেন। পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগেই প্রশ্নের উত্তরপত্র পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন অসিম। তাদের সমাধান করে দেওয়া প্রশ্নের মধ্যে ৭২ থেকে ৭৫টিই মিলেছে।
ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, “আমাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত যে প্রমাণ পেয়েছি, তাতে এই চক্রের মূলহোতা অসিম গাইন। তার বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। তিনি আগেও বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। তিনি অল্পদিনে কয়েকশ’ কোটি টাকা আয় করেছেন।
“এই টাকা দিয়ে গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকা অসিমের মানবপাচার, হুন্ডি ও ডিশের ব্যবসা রয়েছে। যেখানে তিনি প্রশ্নফাঁস করে আয় করা টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। তাকে গ্রেপ্তার করলে কীভাবে প্রশ্নগুলো পান, সেই বিষয়ে পরিষ্কার হতে পারব।”
তিনি জানান, এই ঘটনায় দুজনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যারা প্রশ্নের সমাধান করেছেন, আদালতে তারাও স্বীকার করেছেন। যারা প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন, তারাও স্বীকার করেছেন। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। কেউ ছাড় পাবে না।
সংশ্লিষ্টদের পরীক্ষা বাতিলের অনুরোধ জানানো হবে কি না- এ প্রশ্নে মোহাম্মদ হারুন বলেন, “আমরা এই মামলার তদন্তে নেমে যা যা পেয়েছি সবকিছুই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন পরীক্ষা বাতিল করবেন, না কি বহাল রাখবেন। তারা তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”