Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

ভূমিকম্প কীভাবে পরিমাপ করা হয়

Earth_Quake

ভূমিকম্প পৃথিবীর স্বাভাবিক আচরণের অংশ। প্রাকৃতিক এই ঘটনা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে কৌতুহলী এবং আতঙ্কিত করে আসছে। ভূমিকম্প হলো পৃথিবীর পৃষ্ঠের আকস্মিক কম্পন, যা পৃথিবীর বাইরের স্তর বা ভূত্বকের মধ্যে সঞ্চিত শক্তির মুক্তির ফলে ঘটে। শক্তির এই মুক্তির ফলে কম্পন তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, যার ফলে ভূমি কেঁপে ওঠে। এই কম্পনের তীব্রতা কমবেশি হতে পারে। নজরে না পড়া ছোটোখাটো কম্পন থেকে শুরু করে বিধ্বংসী কম্পন সৃষ্টি হতে পারে এবং মানুষের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসতে পারে।

ভূমিকম্পের কারণ বোঝার জন্য আমাদেরকে প্রথমে পৃথিবীর গঠনের দিকে নজর দিতে হবে। পৃথিবীর ভূগোলক প্রধানত তিনটি স্তরে বিভক্ত। একেবারে ভেতরের স্তরকে বলা হয় কোর, যা উত্তপ্ত গলিত লাভার স্তর। তার পরের স্তরের নাম ম্যান্টেল, যা পাথর দিয়ে গঠিত। আর আমাদের পায়ের নিচের স্তরকে বলা হয় ক্রাস্ট বা ভূত্বক। বাইরের এই স্তরটি অনেক ভাগে বিভক্ত। এই ভাগগুলোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। টেকটোনিক প্লেটগুলোর ফাঁক দিয়েই পৃথিবী তার ভেতরের তাপ ছাড়ে। এই প্লেটগুলোর ওপরেই মহাদেশ ও মহাসাগরগুলো অবস্থিত।

এই প্লেটগুলো ধীর গতিতে চলমান এবং প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, দূরে সরে যায় বা পরস্পরের ভেতরে ঢুকে যায়। সংঘর্ষের ফলে যে শক্তি উৎপাদন হয় তা জমা হতে হতে একসময় বিস্ফোরিত হয়ে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে। আর তখনই ঘটে ভূমিকম্প। টেকটোনিক প্লেটগুলোর বাউন্ডারি বা সীমানাতেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়।

এ ছাড়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস এবং এমনকি উল্কার আঘাতসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভূমিকম্পের সূত্রপাত হয়।

প্রধানত তিন ধরণের প্লেট বাউন্ডারি বা সীমানা রয়েছে যেখানে সাধারণত ভূমিকম্প তৈরি হয়:

ভিনমুখী সীমানা

ভিনমুখী বা অপসারী সীমানায় দুটি টেকটোনিক প্লেট একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। এর ফলে মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয় সেখানে নিচে থেকে ম্যাগমা এসে নতুন ভূত্বক তৈরি হয়। এই প্লেটগুলোর নড়াচড়া এবং মিথস্ক্রিয়া ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।

অভিসারী বা পরস্পরমুখী সীমানা

অভিসারী সীমানায় দুটি প্লেট একে অপরের দিকে এগিয়ে যায় এবং সংঘর্ষ হয়। যখন দুটি প্লেট মিলিত হয়, প্রচুর চাপ তৈরি হতে পারে। আর যখন সেই চাপ নির্গত হয়, তা একটি শক্তিশালি ভূমিকম্প তৈরি করে।

রূপান্তর সীমানা

এই সীমানায় টেকটোনিক প্লেটগুলো আনুভূমিকভাবে একে অপরকে অতিক্রম করে; একটি আরেকটির নিচে ঢুকে যায়। এই প্লেটগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ তাদের মসৃণভাবে চলতে বাধা দিতে পারে, যার ফলে চাপ তৈরি হয়। অবশেষে, এই চাপ ভূমিকম্প আকারে মুক্তি পায়।

প্রধান কয়েকটি টেকটোনিক প্লেটের সীমানা।

ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ

ভূমিকম্প পরিমাপ করা সহজ কাজ নয়, কারণ তারা হঠাৎ এবং কখনও কখনও বিশ্বব্যাপী আঘাত হানে। কম্পন তরঙ্গ এবং স্থানান্তরিত ভূমির সঙ্গে সম্পর্কিত উপাদানগুলো ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ করে, যা ১০ মাত্রার স্কেলের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়।

ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণের দুটি স্কেল তথা গাণিতিক মডেল ও হিসাব-নিকাশ ব্যবহৃত হয়। রিখটার স্কেল ও মোমেন্ট ম্যাগনিচিউড স্কেল। ১৯৩৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রিখটার স্কেল বেশি ব্যবহৃত হত। এরপর আসে মোমেন্ট ম্যাগনিচুড স্কেল। বর্তমানে মোমেন্ট ম্যাগনিচুড স্কেলই বেশি ব্যবহৃত হয়। এই স্কেলে অনেক বেশি নির্ভুলভাবে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা যায়।

প্রথমে সিসমোগ্রাফ নামের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে ভূমিকম্পের কম্পন তরঙ্গগুলো শনাক্ত, পরিমাপ ও রেকর্ড করা হয়। এরপর এই দুটির যে কোনও একটি স্কেল ব্যবহার করে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

ভূমিকম্পের সময় সিসমোগ্রাফ আকা-বাকা লাইন বা ‘সিসমোগ্রাম’ তৈরি করে কম্পনের তীব্রতা প্রকাশ করে। সিসমোগ্রামে প্রকাশিত তথ্য থেকে, বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের সময়, উৎপত্তিস্থল, কেন্দ্রের গভীরতা এবং চ্যুতির ধরন নির্ণয় করতে পারেন এবং কত শক্তি নির্গত হয়েছিল তা অনুমান করতে পারেন।

ভূমিকম্প রেকর্ডিং যন্ত্র সিসমোগ্রাফের একটি ভিত্তি থাকে যা মাটিতে দৃঢ়ভাবে বসানো থাকে এবং এতে একটি ভারী বস্তু ঝোলানো থাকে। ভূমিকম্পের সময় সিসমোগ্রাফের ভিত্তিসহ পুরো ফ্রেম বা কাঠামো নড়ে ওঠে, কিন্তু ঝুলন্ত বস্তুটি নড়ে না। ভারী বস্তুটি স্প্রিং বা পেণ্ডুলামে ঝুলানো থাকে, যা সেটিকে স্থির রাখে। তবে এতেও কম্পন তৈরি হয়। পেণ্ডুলামের আগায় একটি কলম থাকে, যা দিয়ে কম্পনের সময় আঁকাবাকা রেখা তৈরি হয়।

রিখটার স্কেল

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির চার্লস এফ রিখটার ১৯৩৫ সালে ভূমিকম্পের আকার বা মাত্রা নির্ণয় করার জন্য একটি গাণিতিক কৌশল উদ্ভাবন করেন। পরে এর নাম হয় রিখটার স্কেল। এর মাধ্যমে সিসমোগ্রাফ দিয়ে রেকর্ড করা কম্পন তরঙ্গের প্রশস্ততার লগারিদম বা ঘাতাঙ্কগণন থেকে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

রিখটার স্কেলের নির্ভুলতা দূরত্বের ওপরও নির্ভর করে। সাধারণত কম দূরত্বের ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিক রিডিং দিতে পারে এই স্কেল। এ ছাড়া সিসমোগ্রাফের ধরনও নির্ভুলতার পেছনে ভুমিকা রাখে। রিখটার স্কেল ৬.৫ মাত্রার বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য কম সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই কারণে, উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য রিখটার স্কেল ব্যবহার করার সময় নির্গত শক্তির পরিমাপ সঠিক হয় না।

রিখটার স্কেলের প্রতি বাড়তি মাত্রায় ভূমিকম্পের শক্তি ১০ গুণ বেড়ে যায়। যেমন ৪ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প ১০ গুন বেশি শক্তিশালি।

মোমেন্ট ম্যাগনিচুড স্কেল

মাঝারি আকারের ভূমিকম্প (৩-৭ মাত্রা) পরিমাপ করার জন্য রিখটার স্কেল কার্যকর। এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য ১৯৭৯ সালে মোমেন্ট ম্যাগনিচুড স্কেল উদ্ভাবন করা হয়। এই স্কেলে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায়।

ছোট থেকে মাঝারি আকারের ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য রিখটার স্কেল আর মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য মোমেন্ট ম্যাগনিচুড স্কেল সঠিক। সর্বোচ্চ ভূমিকম্প তরঙ্গের প্রশস্ততা ব্যবহার করার পরিবর্তে, মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেলে সিসমিক মোমেন্ট বা কম্পন মূহূর্ত ব্যবহার করা হয়। সিসমিক মোমেন্ট বা কম্পন মূহূর্ত হলো ভূমিকম্পের সময় নির্গত শক্তির পরিমাপ।

মোমেন্ট ম্যাগনিচুড স্কেল ভূমিকম্পে নির্গত শক্তির মোট মুহূর্তের উপর ভিত্তি করে এর মাত্রা নির্ধারণ করে। মুহূর্ত হল একটি চ্যুতি সরে যাওয়ার দূরত্ব এবং সরানোর জন্য প্রয়োজনীয় বল।

মডিফাইড মার্কালি ইনটেনসিটি বা এমএমআই স্কেল

ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য মডিফাইড মার্কালি ইনটেনসিটি বা এমএমআই স্কেলও ব্যবহার করা হয় । এর মাধ্যমে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের চারপাশে নির্দিষ্ট স্থানের কম্পনের শক্তির পরিমাপ করে এর তীব্রতা নির্ধারণ করা হয়। ভূমিকম্পের ভূগর্ভস্থ উৎস বরাবর ভূপৃষ্ঠে এই স্কেল দিয়ে কম্পন পরিমাপ করা হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত