গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঢাকার গুলশান-বনানীতে জেঁকে বসেছিল ‘পার্টি কালচার’। বনানী আবেদীন টাওয়ারের অষ্টম তলায় ট্রাম্পস ক্লাব তখন ছিল বেশ আলোচিত। শিল্পপতি, রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সেখানে বিনোদন জগতের অনেকের মেলা বসত। চমক দিতে হাজির করা হতো বলিউডের নায়ক-নায়িকাদেরও।
ক্লাবের ঠিক পাশেই ছিল বনানী জামে মসজিদ। তার কাছেই একটি আবাসিক ভবনে থাকতেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। বাড়ির কাছে ট্রাম্পস ক্লাবের সামনেই ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তাকে।
এই হত্যামামলার তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, মধ্যরাতে ট্রাম্পস ক্লাবে গান-বাজনা বন্ধ করতে বনানী মসজিদ কমিটির কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন সোহেল চৌধুরী। আর সেই কারণেই তাকে খুন হতে হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের ২৬ বছর পর বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতের দেওয়া রায়ে তিনজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। তাদের একজন ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, আরেকজন ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, অন্যজন হলেন সেদিন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালানোর সময় হাতেনাতে ধরা পড়া আদনান সিদ্দিকী।
হত্যাকাণ্ডের পর আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও বেশিদিন কারাগারে রাখতে পারেনি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আর দেশেই নেই।
এই হত্যাকাণ্ডে ভাড়াটে খুনি ব্যবহার হয়েছিল বলে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে। খুনি হিসাবে সানজিদুল ইমন, লেদার লিটন, কিলার আব্বাস, মামুনসহ অনেকের নাম এলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাক্ষী জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়, যার ছাপ রায়েও পড়ে।
চলচ্চিত্র জগতে আলোচিত প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইর সঙ্গে ট্রাম্পস ক্লাবে সোহেল চৌধুরীর একবার তর্কাতর্কি হয়েছিল বলে আদালতে জানিয়েছিলেন ক্লাবটির তৎকালীন ব্যবস্থাপক এনামুল হাফিজ খান। সেই ঘটনাটি ছিল খুনের আরও আগের।
তিনি বলেছিলেন, তার সামনেই সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইর কথা কাটাকাটি হলে তিনি তখন সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
পরে ১৭ ডিসেম্বর রাতে সোহেল চৌধুরী দুই দফায় ট্রাম্পস ক্লাবে গিয়েছিলেন। প্রথমবার রাত ৯টার দিকে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়ে ফিরে আসেন। পরে রাত ২টার দিকে পুনরায় গিয়ে ক্লাবের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তখন আহত হন সোহেল চৌধুরীর বন্ধু আবুল কালাম আজাদ, ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মচারী নিরব ও দাইয়ান। ঘটনার পরপরই স্থানীয়রা আদনান সিদ্দিকীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিল।
যখন খুন হয়েছিলেন, তখন স্ত্রী চিত্রনায়িকা পারভিন সুলতানা দিতির সঙ্গে সোহেল চৌধুরী থাকতেন না। তিনি বনানীতে বাবা-মার সঙ্গে থাকতেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা দিয়ে তখন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, ঘটনার রাতে সোহেল চৌধুরী বাসা থেকে প্রথমে বের হন আনুমানিক ৯টায়। তখন তার সঙ্গে ছিলেন শহীদ, আবুল কালাম আজাদ, হেলাল ও হাফিজ নামের চার বন্ধু। মধ্যরাতে তারা বাসায় ফিরে এসেছিলেন। তারপর আবার বের হন।
সোহেল চৌধুরীর বাসা থেকে ট্রাম্পস ক্লাবের দূরত্ব একশ গজেরও কম। রাত আড়াইটার দিকে তারা পুনরায় গিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবে যান। ক্লাবের নিচতলার কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাদের আটকে দিলে শুরু হয় তর্কাতর্কি। তখন এক যুবক রিভলবার বের করে আবুল কালামকে প্রথমে গুলি করেন। এরপর সোহেল চৌধুরীর বুকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
পরে জানা যায়, সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করে ৫/৬ জন প্রাইভেটকারে পালিয়ে যায়। আদনান সিদ্দিকী পালাতে না পেরে পাশের একটি ভবনে লুকাতে চেষ্টা করেন। তবে স্থানীয়রা তাকে ধরে পুলিশে দেয়।
ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর আদনান সিদ্দিকী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি বলেন, এক শিল্পপতির ফোন পেয়ে তিনি ঢাকা ক্লাব থেকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। সোহেল চৌধুরী হত্যায় তার বন্ধু নিরবসহ আটজন জড়িত ছিলেন।
ঘটনার পর সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম, আশীষ রায় চৌধুরী, তারিক সাইদ মামুন, আদনান সিদ্দিকী, ফারুক আব্বাসী, সানজিদুল হাসান ইমন, মো. সেলিম খান ও হারুনুর রশীদ লিটনকে (লেদার লিটন) আসামি করা হয়। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করলে তারা জামিনে বেরিয়ে আসেন।
২০০১ সালে হত্যামামলার বিচার শুরু হলেও এক আসামির আবেদনে হাইকোর্টের আদেশে তা ঝুলে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর আইনি জটিলতার অবসান ঘটলে ২০২২ সালে পুনরায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
তখনই ২০২২ সালের এপ্রিলে র্যাব গ্রেপ্তার করে আশীষ রায় চৌধুরীকে। তাকে সোহেল চৌধুরীর খুনের ঘটনাটি আবার আলোচনায় আসে।
আশীষকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক তৎকালীন খন্দকার আল মঈন বলেছিলেন, “বনানী ট্রাম্পস ক্লাব নিয়ে সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে ক্লাবটির মালিক বান্টি ইসলাম ও আশিষ চৌধুরীর ঝামেলা ছিল। এছাড়া আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। এরপর তিনজন মিলে সোহেলকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।”
আজিজ মোহাম্মদ ভাই তখনকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে দায়িত্ব দিলে তারাই সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করে বলে আশিষ রায় দাবি করেন।
তিনি বলেন, সেই রাতে সোহেল চৌধুরী ক্লাবে না এলে পরে অন্যত্র খুনের শিকারই হতেন।