এখন বিস্মৃত একটি নাম হলেও এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও মডেলিং জগতে চেনামুখ ছিলেন সোহেল চৌধুরী। তিন যুগ আগের সেই সোহেল চৌধুরী এখন আলোচনায় শুধু হত্যামামলার রায়কে কেন্দ্র করে।
এই চিত্রনায়ক হত্যাকাণ্ডের ২৬ বছর পর বৃহস্পতিবার মামলার রায় হয়। তাতে যে তিনজনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে, তার একজন হলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই। হুলিয়া নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশে পালিয়ে।
ঢাকার বনানীর এক অবস্থাপন্ন ঘরে সোহেল চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৩ সালের ১৯ অক্টোবর। তার বাবার নাম তারেক আহমেদ চৌধুরী, মা নূরজাহান বেগম। তাদের ছোট সন্তান ছিলেন সোহেল।
পুরনো নায়ক-নায়িকাদের দেখে দর্শক যখন ক্লান্ত, তখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন-এফডিসির এক উদ্যোগে চলচ্চিত্র জগতে আসা সোহেল চৌধুরীর।
১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ নামে সেই মেধা অনুসন্ধান প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়ে নির্মাতা এফ কবির চৌধুরীর ‘পর্বত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটে সোহেল চৌধুরীর।
৩০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সবক’টিতেই অবশ্য তিনি মূল নায়ক ছিলেন না। কয়েকটিতে পার্শ্ব-চরিত্রেও অভিনয় করেন। চেহারা নায়কোচিত হলেও অভিনয়ে অপারদর্শিতা তার এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে তখনকার চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলতেন।
চলচ্চিত্রে ভিত মজবুত করতে না পারলেও মডেল হিসাবে জনপ্রিয়তা কুড়ান সোহেল চৌধুরী। সেঞ্চুরি আর্কেডের বিজ্ঞাপনে তার মুখ ঘরে ঘরে চেনা হয়ে গিয়েছিল।
১৯৮৬ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘হীরামতি’ সিনেমায় সোহেল চৌধুরীর অভিনয় কিছুটা প্রশংসিত হয়। ওই চলচ্চিত্রে তার নায়িকা ছিলেন পারভীন সুলতানা দিতি, তারও চলচ্চিত্রে আসা নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে।
হীরামতি থেকে সখ্য, তারপর ওই বছরই সোহেল চৌধুরী ও দিতি বিয়ে করেন। তাদের দুটি ছেলে-মেয়েও হয়, লামিয়া চৌধুরী ও দীপ্ত চৌধুরী।
দিতির ক্যারিয়ার তরতরিয়ে এগিয়ে চললেও সোহেল চৌধুরী পড়ে যান পেছনে। তখন খবর বেরিয়েছিল, দিতি কোন কোন নায়কের সঙ্গে কাজ করবেন, তাতে সোহেল হস্তক্ষেপ করলে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়।
১৯৯৬ সালে এই দম্পতির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তার দুই বছর পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সোহেল চৌধুরী।
দিতি অভিনয় চালিয়ে যান। ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেক ব্যবসাসফল সিনেমাও দর্শকদের উপহার দেন তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী হারানো কাঞ্চনের সঙ্গে পরে জীবনেরও জুটি গড়েন দিতি। তবে তাদের সংসার বেশিদিন টেকেনি। ২০১৬ সালে দিতি মারা যান।
সোহেল চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- খুনের বদলা, লক্ষ্মীবধূ, আমার ভালোবাসা, প্রেমের প্রতিদান, কালিয়া, প্রতিশোধের আগুন, হিংসার আগুন, চিরদিনের সাথী, অবরোধ, দাঙ্গা ফ্যাসাদ, প্রেমের দাবি, প্রিয়শত্রু, ভাইবন্ধু, দোষী, লেডি ইন্সপেক্টর, পাপী শত্রু, আজকের হাঙ্গামা, বিরহ ব্যথা, জুলি, মহান বন্ধু ইত্যাদি।
সোহেল চৌধুরী যখন খুন হন, তখন তিনি চলচ্চিত্র থেকে মোটামুটি দূরে ছিলেন। টেকনোভিশন নামে একটি কেবল অপারেটর প্রতিষ্ঠান খুলে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী বনে গিয়েছিলেন তিনি। গুলশান-বনানীতে থাকা বিদেশিদের বাড়িতেই টেলিভিশন কেবল সংযোগ দিত তার প্রতিষ্ঠান।
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ কেবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন ২৩ ডিসেম্বর দেশজুড়ে কালো পতাকা তোলার পাশাপাশি তিন ঘণ্টা সম্প্রচার বন্ধও রেখেছিল।
দিতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর সোহেল বনানীতে বাবার বাড়িতে থাকতেন। ওই বাড়ির পাশেই ছিল ট্রাম্পস ক্লাব, যেখানে নিয়মিত পার্টি চলত। ওই ক্লাবে একবার এমবি ফিল্মসের কর্ণধার আজিজ মোহাম্মদ ভাইর সঙ্গে সোহেলের কথা কাটাকাটি হয়েছিল।
১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে ট্রাম্পস ক্লাবে একবার ঢুকতে গিয়ে বাধা পান সোহেল। পরে ভোররাতে আরও কয়েকজনকে নিয়ে ঢুকতে গিয়ে বাদানুবাদে জড়ান। তখন তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের দিনই তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় মামলা করেন। ২০০১ সালে বিচার শুরু হলেও এক আসামির আবেদনে হাইকোর্টের আদেশে তা ঝুলে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর আইনি জটিলতার অবসান ঘটলে ২০২২ সালে পুনরায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। তার দুই বছর পর রায় হলো।