Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

জীবনের যে মন্ত্রে ক্যান্সার জয়ী হলেন শাপলা

ছবি:  জাহান-ই-গুলশান শাপলার ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া
ছবি: জাহান-ই-গুলশান শাপলার ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া
Picture of আইরিন সুলতানা

আইরিন সুলতানা

কাছের অগ্রজ বন্ধু ও সংবাদকর্মী নাহিদ জাহান লিনা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়াতে মন ভারাক্রান্ত হয়েছিল; তার চিকিৎসার তহবিল জোগাড়ে বইমেলা চত্বর থেকে আরও কত কত জায়গায় দাঁড়িয়েছিলেন জাহান-ই-গুলশান শাপলা। তখন ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি একদিন নিজের শরীরেও বাসা বাঁধবে ক্যান্সার। তারপর নতুন করে নিজের মন ও শরীরকে চিনে এর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

এন্ডোমেট্রিওসিসের চিকিৎসা চলছিল ২০১৬ কি ২০১৭ সাল থেকে। সেসময় একবার ল্যাপারোস্কপিক চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। মাসিকের দিনে অতিরিক্ত রক্তপাত আর যন্ত্রণা হতো বলে সকাল সন্ধ্যার কাছে জানালেন জাহান-ই-গুলশান শাপলা।

এরমধ্যে স্কলারশিপে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার সুযোগ এলো তার। ‘পিরিয়ডের যন্ত্রণা মেনে নিলেও এতো বেশি রক্তপাত হলে চলাফেলা করাই মুশকিল হয়ে যায়’ মাসের বিশেষ দিনগুলোতে। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ইনজেকশন নিলেন জাহান-ই-গুলশান শাপলা। তাতে করে মাসিক বন্ধ থাকলো বেশ অনেক দিন।

“প্রথম দিকে ১৫ দিন পর পর ইনজেকশন নিতাম যাওয়ার আগে। আমার কোর্স ছিল ১৮ মাসের। এরমধ্যে ১৭ মাস আমার ব্লিডিং বন্ধ ছিল। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে আবারও ব্লিডিং শুরু হলো। হঠাৎ করে ব্যথা। তখন আবারও ইনজেকশন নিলাম।”

এদিকে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শাপলা জানলেন, শরীরে সিস্টের আকার দুই সেন্টিমিটারেরও বেশি।

ফেলে দিতে হলো জরায়ু ও গর্ভাশয়

মহামারীর বছরে জুনে কোভিড আক্রান্ত করেছিল শাপলাকেও। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন ২৫ দিনের মতো। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও ভীষণ ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, এসব কোভিডের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

“কিন্তু দুমাস পার করেও আমি স্বাভাবিক হচ্ছিলাম না। জটিলতা বাড়ছিল। ব্লিডিং কোনো মতে থামছিল না।”

সেই সময় তাকে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। যদিও কোভিড পরিস্থিতিতে অস্ত্রোপচারের শিডিউল পাওয়া গেল একেবারে নভেম্বরে। চিকিৎসক তার হিস্টেরেক্টমি করালেন বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন জাহান-ই-গুলশান শাপলা।

“এবার আর ল্যাপারোস্কপিক করার মত অবস্থা ছিল না। আমার অনেকগুলো সিস্ট ছিল। ফলে ইউরেটরাস ও ওভারি ফেলে দেওয়া হলো অপারেশন করে।”

আগের বার ল্যাপারোস্কপিক করার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। আধা ঘন্টার বদলে তিন দিন ছিলেন হাসপাতালে।

“আর এবার ডাক্তার বলেছিল আমার সার্জারিতে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট লাগবে। কিন্তু সাড়ে পাঁচ ঘন্টা লেগেছিল।”

অস্ত্রোপচারের পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন শাপলা।

সেই ‘কঠিন সময়কে’ মনে করে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সার্জারির পর ২০ দিন আমি খুব অসুস্থ থাকি। আমি মুখ দিয়ে খেতে পারতাম না। এনজি মানে নাকে দিয়ে পাইপ ঢোকানো হয়। এভাবে পাঁচদিন থাকতে হয়।

“জাউ রান্না করে তারপর ব্লেন্ড করে দুই চামচ খেতে পারতাম। আমার পায়ে সেলুলাইটিস হয়ে গিয়েছিল। এক ধাক্কায় আমার ওজন কমে গেল ১০ কেজি।”

ক্যান্সারের সঙ্গে পরিচয়

এরমধ্যে বায়োপসি রিপোর্টে শাপলার ওভারিয়ান ক্যান্সার ধরা পড়ে। যদিও শুরুতে তাকে সেকথা জানানো হয়নি। বলা হয়েছিল ‘ইনটেসটাইন ব্লক হয়েছে’। পরিবার থেকে প্রস্তুতি চলছিল ভারতে গিয়ে আবারও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর।

এসব দেখে এক বন্ধুকে প্রশ্ন করেন শাপলা; “আমার অসুখের নাম কী?” 

আর তখন জানতে পারেন, তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত। তবে শাপলা ওই রিপোর্ট দেখতে চাননি। 

শুধু বলেছিলেন, “এতো লুকাচাপার কিছু নেই। আমাকে বললেই হতো।”

শাপলা তখন জানার চেষ্টা করেন ওভারিয়ান ক্যান্সারে ভোগা রোগী আর কে আছেন। পেয়েও গেলেন রোকেয়া হলে থাকার দিনের এক অগ্রজ বন্ধুকে। সেই অগ্রজ বন্ধুর ক্যান্সারের অভিজ্ঞতা জানতে জানতে শাপলা বুঝতে পারেন, তার অপারেশন ‘ক্যান্সার প্রোটোকল’ মেনে হয়নি।

“আমার বেলায় আগে থেকে কোনোভাবেই ক্যান্সার সম্ভাবনার দিকটি নিয়ে প্রস্তুতি ছিল না। টিউমার মার্কার করা হয়নি। সার্জারির সময় আমার একটা টিউমার ফেটে যায়।”

তবে ওভারিয়ান ক্যান্সারের অভিজ্ঞতা থাকার পরও অগ্রজ বন্ধুটির বড় পদে চাকরিতে কর্মরত থাকা, তিন সন্তান নিয়ে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন শাপলাকে সাহস আর প্রেরণা জোগায়। বন্ধু ও পরিবারও শাপলাকে বলে, এই বায়োপসি রিপোর্ট ভুল হতে পারে; ভারতের হাসপাতালে আবার পরীক্ষা করলে সেটা বোঝা যাবে।

এই বায়োপসি রিপোর্ট ভুল হোক; শাপলার মনেও সেই আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা আর আশার মাঝে বিশাল ফাড়াক দেখতে পেলেন তিনি।

”দেশে বায়োপসিতে দেখা যায় আমার ক্যান্সার সেল বেশ এগ্রেসিভ। তখন স্টেজ ওয়ান বলেছিল। আমি মুম্বাইতে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে যাই ডিসেম্বরে। আশা ছিল ওরা বলবে কিছু হয়নি কিন্তু সেটা হলো না। ওরা আবার রিভিউ করে বলল যে গ্রেড টু; সুপার এগ্রেসিভ। ”  

আশাহত হওয়ার ওই মুহূর্ত ‘ধাক্কা’ দিয়েছিল শাপলাকে। তারপর তিনি ভাবলেন, এই সত্যকে মেনে নিতে হবে।

শরীর ও মনে যত বদল আনে ক্যান্সার

গর্ভাশয় আর জরায়ু ফেলে দেওয়া নিয়ে তত বিপর্যস্ত ছিলেন না জাহান-ই-গুলশান শাপলা। এই দুই অঙ্গ না থাকায় ‘মেডিকেল মেনোপজ’ হলো তার অর্থ্যাৎ মাসিক বন্ধ হয়ে গেলো।

তবু মনের দিক থেকে কাবু হননি জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বললেন, “স্তন সার্জারি হলে না হয় কিছু বোঝা যেত। কিন্তু ইউটেরাস বা ওভারি তো শরীরের ভেতরে থাকলেও আমি দেখতে পাই না, আবার না থাকলেও আমি দেখতে পাই না।”

মেনোপজের কারণে কি হট ফ্ল্যাশ ভুগিয়েছে?

উত্তরে সকাল সন্ধ্যাকে শাপলা বলেন, “আমার বেলাতে আমি আসলে এতো ভয়ংকর ভাবে অন্য সব শারীরিক কষ্টে ভুগেছি যে হট ফ্ল্যাশ নিয়ে অত কিছু বুঝতেই পারিনি।”

এদিকে ক্যান্সার নিশ্চিত হওয়ার পর ভারতে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারে শুরু হলো কেমোথেরাপি।

“আমার ইনজেকটেবল কেমো লাগল। বম্বেতে একটানা থেকে একুশ দিন পর পর কেমো নিলাম। টানা পাঁচ মাস ছিলাম।”

কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিল দ্রুতই। এতো বছর নিজেকে যেমন দেখেছিলেন শাপলা, হঠাৎ নিজেই নিজেকে নতুন চেহারায় দেখতে পেলেন।

“কেমো নেওয়ার পর আমার চুল পড়তে শুরু করল। ধরে রাখার চেষ্টা করলাম; দেখি কতদিন থাকে। কিন্তু বিরক্ত হয়ে গেলাম। সব চুল ফেলে দিলাম।”

“তখন আমি আমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এটা আমার নতুন একটা চেহারা। আমার যে খুব মন খারাপ হলো তা না। কিন্তু আমার বরের খুব মন খারাপ হলো। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখটা ছলছল করছে।” 

ভারতে হাসপাতালে কেমোথেরাপি নিতে আসা ‘বাচ্চা থেকে বয়স্ক’ অনেক রোগী দেখেছিলেন শাপলা। তাদের মাঝে থেকে ‘মাথা ন্যাড়া’ কাউকে দেখতে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলেন তিনি নিজেকে।

“আমি আসলে আমার মতো অনেক দেখেছিলাম তাই মন খারাপ হয়নি। তখন বুঝলাম কমিউনিটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

২০২১ সালের জানুয়ারিতে দুটি কেমোথেরাপির পর শাপলা। ছবি: জাহান-ই-গুলশান শাপলার ফেইসবুক থেকে নেওয়া

“আসলে চল্লিশ বছর ধরে আমি আমাকে এক রকম দেখেছি। তারপর হঠাৎ করে আমাকে সবকিছু অন্যরকম ভাবে শিখতে হচ্ছে। এটা খুব একটা সহজ ব্যাপার না। পরিবেশ সবকিছুই চেনা কিন্তু যাত্রাটা নতুন করে শুরু হয়।”

ক্যান্সারের সঙ্গে যুঝতে নিজের শরীর ও মনকে জানার এই যাত্রায় জাহান-ই-গুলশান শাপলাকে শক্তি দিল কাউন্সেলিং।

কেমোথেরাপি চলার সময় যুক্তরাজ্যে থাকা ও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা এক বন্ধু তাকে প্রথম কাউন্সেলিং করার পরামর্শ দেন। যদিও এই পরামর্শ ‘ভালো লাগেনি’ তখন শাপলার।

তিনি ভাবলেন, “ধুর! আমার মনের জোর তো কম না। আমার লাগবে না কাউন্সেলিং।”

শাপলার সেই শুভাকাঙ্খী বন্ধুটি অবশ্য একজন থেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলে খরচও দিয়ে দেন নিজের পকেট থেকে।

“সেটা বেশ ভালো একটা অ্যামাউন্ট ছিল। প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো। আটটা বা দশটা সেশন। আমার জন্য এটা আসলে একটা বড় অনার।”

যুক্তরাজ্য থেকে থেরাপিস্ট শাহমিকা আগুন যোগাযোগ করলে শুরুতে এড়িয়ে গিয়েছিলেন শাপলা। তারপর ‘মুখ রক্ষার্থে’ সেশন শুরু করলেন।

“প্রথম দুটো সেশনে আমি খুবই বিরক্ত হলাম। কিন্তু থার্ড সেশন থেকে আমার মনে হলো যে আমি রিলেট করতে পারছি। শেষের দিকে গিয়ে আমি স্বীকার করলাম যে এটা আমার দরকার ছিল।”

এরপর শরীরের যত্নে মনকেও সুস্থ রাখতে আরও অনেকবার এমন কাউন্সেলিং নিতে দ্বিধা করেননি জাহান-ই-গুলশান শাপলা।

ক্যান্সার জয়ী শাপলার জীবনচর্যা

কোলা জাতীয় কোমল পানীয় এক সময় পানির মত যখন তখন পান করতেন শাপলা। এখন তিনি আর মনে করতে পারেন না, কোলা পান কবে ছেড়েছেন।

“এখন গরম হলে কখনও ডাব খাই। চা-কফি খাওয়ার টান আমার আগে থেকেই তেমন ছিল না। বাগানে তুলসি গাছ আছে; তুলসি পাতা দিয়ে পানি খাই।”

চিনি অবশ্য আগে থেকেই খুব একটা চলতো না তার জিহ্বায়। এখন চিনি, মধু, গুড় এবং কোনো বিকল্প চিনিও এড়িয়ে চলেন পুরোপুরি।

“বাড়িতে আমার মা যখন পুডিং করেন তখন আমার জন্য তাকে চিনি ছাড়াই করতে হয়। পায়েস রান্না হলে আমার জন্য চিনি ছাড়া আলাদা রান্না হয়। কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও কেক খাই না।”

এক সময় বাইরের খাবার খাওয়ার অভ্যাস ছিল। খাবার সময়েও ছিল অনিয়ম; দুপুরের খাবার খেতে খেতে বিকাল গড়িয়ে যেত। সেই শাপলা এখন জাঙ্ক ফুড, বিয়ে বাড়ি অথবা রেস্তোরাঁর খাবার একেবারেই এড়িয়ে চলেন। বন্ধুদের বাড়িতে গেলেও তার জন্য আলাদা খাবার চলে।

“আমি সাদা ভাত, সবজি, ডালই খাবো। এসবে আমি আর এখন ছাড় দেই না। এজন্য আমার নিজেকে যেমন গড়ে নিতে হয়েছে আমার চারপাশকেও তৈরি করতে হয়েছে। প্রয়োজনে না খেয়ে থাকি। অথবা নিজের খাবার সঙ্গে রাখি।”

চিকিৎসকরা কী কী বিধিনিষেধ দিয়েছেন শাপলাকে?

“আমার সেরকম বিধিনিষেধ নেই। ডাক্তার খুব বেশি রেসট্রিকশন দেননি। আমি নিজে থেকে চেষ্টা করি আঁশযুক্ত খাবার খেতে। অনেকের সঙ্গে কথা বলে বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে এই জীবন যাপন বেছে নিয়েছি।”

তবে নিজের খাবার রুচি সব সময় ভালো বলে জানালেন তিনি সকাল সন্ধ্যাকে।

“আমি কোরিয়াতে গিয়েছিলাম, তাদের খাবার আমি খেতে পেরেছি। আমি এক মাস ভাত না খেয়েও থাকতে পেরেছি। আমি অনেক বছর খাগড়াছড়িতে ছিলাম; পাহাড়ে। পাহাড়িদের খাবারও খেতে পারতাম, যেটা অনেকে পারত না।”

মুখোরোচক খাবার নিয়ে শাপলার উপলব্ধি হলো, “স্বাদ তো আসলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়। আর সুস্থতা হলো দায়িত্বের বিষয়।

“আমার এক সহকর্মী বলেছিল, খাওয়ার স্বাদ হচ্ছে দুই মিনিটের। ভালো থাকা বা মন্দ থাকা হলো আজীবনের বিষয়। আমার নিজের মোটিভেশন হলো, খেলে এখন হয়তো ভালো লাগবে কিন্তু পরে আমাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।”

আর এসব বাছবিচার শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদেরও এভাবে মেনে চলার কথা বলতে চান শাপলা।

“অনেকে বলেন একবার খেলে কী হয়? একটু খাও। আমি তো অন্যদের বলি, তোমরাও এড়িয়ে চলো। আমার তো একটা শিক্ষা হয়েছে। তোমাদের এমন না হোক।”

“শরীর কীভাবে কাজ করে এসব আগে জানতাম না। এখন বুঝেছি পুরো শরীর একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলে। আমাদের যে জীবন যাপন তাতে তো আরও অসুখ হওয়ার কথা। বিষাক্ত কিছু শরীরে দেওয়ার চেয়ে কিছু না খেলে শরীর ভালো থাকে। খুব ছোটবেলা থেকেই এসব শেখানো দরকার।”

তাহলে শাপলার খাদ্যাভ্যাস এখন কতটা স্বাস্থ্যকর হয়েছে?

“আমি সব রকম শাক-সবজি প্রতিদিন খেতে চেষ্টা করি। বাইরে থেকে এক ধরনের পাউডার প্রোটিন মিল্ক নিয়ে আসি; ওটা দিয়ে টক দই বানিয়ে খাই।”

“আমি গরুর মাংস খাই না সাধারণত। মুরগি খাই। সপ্তাহে দুই-তিন দিন খাওয়া হয়। মাছ-ডিম খাই প্রোটিনের জন্য। আমি বিভিন্ন রকমের ডাল খাই। মিষ্টি আলু খাই। ওটস খাই। বাইরে থেকে আনা অলিভ অয়েল খাই।”

মাঝে মাঝে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে আয়রন সাপ্লিমেন্ট নেন। তাছাড়া কাঁচাকলা-কচু তো থাকেই খাবার তালিকায়।

ছবি: জাহান-ই-গুলশান শাপলার ফেইসবুক থেকে নেওয়া

ত্বকের যত্নেও সচেতন হতে চেষ্টা করছেন জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে শাপলা বলেন, “আমি লোশন ব্যবহার করি না। নারকেল তেল ব্যবহার করি।

“আমি শুনেছি, আমরা যেটা খেতে পারি সেটা ত্বকে দিতে পারি। কঠিন ভাবে এসব অনুসরণ করতে পারি না তবে চেষ্টা করি। অবশ্য এখনও শ্যাম্পুর বিকল্প অন্য কিছু ব্যবহার করা হচ্ছে না।” 

আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন; এখনও ওষুধ নিতে হয় শাপলাকে। সেই সঙ্গে আছে অ্যাজমাও। ইনহেলার নিতে হয় তাই। তবে ডায়বেটিস বা কিডনি জটিলতা নেই তার।

প্রতিদিন কেমোথেরাপির ওষুধ মুখে খেতে হয় শাপলাকে। হয়ত এ কারণে আজকাল ঘুম কমে গেছে । তাই বলে ঘুমের ওষুধে অভ্যস্ত হননি তিনি। বরং চেষ্টা করেন রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে শুয়ে পড়তে।

সকালে উঠে ছাদে হাঁটেন। ইউটিউব দেখে ও বন্ধুদের থেকে শেখা হালকা ব্যায়াম করেন। আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে নাশতা সেরে নেন। অফিসের খাবার বাসা থেকেই নিয়ে যান সঙ্গে করে।

জরুরি মিটিং না হলে দুপুরের খাবার দেড়টার মধ্যেই খেয়ে নেন তিনি। আর এতে তার সহকর্মীদের সহায়তাও পান বেশ।

ক্যান্সার জয়ীদের জন্য শাপলাদের উদ্যোগ

ভারতে চিকিৎসা করানোর সময় স্যানিটোরিয়ামে থাকায় অনেক বাংলাদেশি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয় শাপলার। এরপর দেশে ফিরে তিনি ফেইসবুকে নিজের ক্যান্সার যাত্রার কথা লিখতে শুরু করেন।

“লিখতে গিয়ে দেখলাম আমার নিজেরও ভালো লাগে। আরও যাদের সঙ্গে পরিচয় হলো আমরা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতাম। কারো কোনো তথ্য লাগলে শেয়ার করতাম। তারপর আমরা দেখা করি।” 

গত বছর ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে দেখা করেন সবাই।

“আমরা ভেবেছিলাম দেখা করে চলে যাবো।  এক ঘন্টার বদলে সাড়ে চার ঘন্টা চলে সেই অনুষ্ঠান। চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম থেকেও চলে আসেন অনেকে। আমরা বুঝতে পারি, সারভাইভারদের বলার জায়গাটা কম। এই জায়গাটা বাড়াতে হবে।” 

গত বছর জুনে ক্যান্সার সারভাইভার ডে পালন করেন তারা।

“তখন আমরা দেশে ক্যান্সার নিয়ে সামাজিক ভাবে ভূমিকা রাখছেন এমন ১০ দশকে সম্মাননা জানাই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যে ক্যান্সার হলে সব শেষ হয়ে যায় বিষয়টা তা নয়।” 

এরপর নিবন্ধন করে গড়ে উঠল দেশের ক্যান্সার আক্রান্ত, ক্যান্সার জয়ী, আক্রান্তের পরিবার এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্লাটফর্ম সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন। জাহান-ই-গুলশান শাপলা এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।

শাপলার জীবন যাপনের মন্ত্র কী?

ছবি: জাহান-ই-গুলশান শাপলার ফেইসবুক থেকে নেওয়া

৪২ জন ক্যান্সার লড়াকুর লেখা নিয়ে সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে ’এখানে থেমো না’।

এই শরীরেও বইটি দেখার কাজ করেছেন শাপলা। অনেকদিন ধরেই ব্যস্ত রয়েছেন এই আয়োজন ঘিরে। টানা গত ১৫ দিন ধরে একটু অনিয়মও হচ্ছে তার। তবে ক্যান্সার প্রসঙ্গে কথা ও কাজ হলে ক্লান্তি কেটে যায় বলে জানালেন সকাল সন্ধ্যাকে।

এখন আবার নিয়মে ফিরবেন জানিয়ে শাপলা বলেন, “আমার সামর্থ আগের চেয়ে কমে গেছে। কেমোর আগে যতটা শক্তি ছিল এখন ততটা পারি না। তবে আমি চেষ্টা করি।”

ওরাল কেমোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতে মাঝে মাঝেই কোষ্ঠ্যকাঠিন্যে ভুগতে হয় শাপলাকে। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়।

এরপরও ‘ট্রমাটাইজড’ বোধ করেন না জানিয়ে বলেন, “আমার প্রতি মাসে-দুমাসে কিছু না কিছু কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। আমি যেমন তাতে কিছু বদল দেখলেই আমি সতর্ক থাকি ও কনসাল্ট করার চেষ্টা করি।” 

এই বছর পঁয়তাল্লিশে পা রাখবেন জাহান-ই-গুলশান শাপলা। সরকারি এই কর্মকতা রয়েছেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক পদে।  

শাপলার মাথায় চুল ফিরে এলেও এখন তা সব সাদা দেখায়। তবে এসব নিয়ে বিচলিত নন তিনি। কেন?

জীবনে ভালো থাকার মন্ত্র জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে এই নারী বলেন, “আমার চুল সাদা হয়ে গেছে। তবে আমি আসলে ওসব নিয়ে ভাবি না।  একদিন না একদিন তো হতোই। একটু আগে হলো না হয়। 

“আমার মধ্যে আমি-আমি-আমি ব্যাপারটা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। আমার প্রিয় শব্দ আমাদের। আমি যেখানে যাই আমাদেরই খুঁজে পাই। আমাদের হয়ে থাকলে অনেক বেশি ভালো থাকা যায়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত