Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

চাঁদের অচেনা অংশে কীসের অন্বেষণ চীনের

চাঁদের উল্টোপাশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে চ্যাঙ’ই-৬। ছবি: এএফপি।
চাঁদের উল্টোপাশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে চ্যাঙ’ই-৬। ছবি: এএফপি।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

পৃথিবী থেকে চাঁদের যে পাশটি দেখা যায়, ওই অংশে মানুষের অনুসন্ধান চলছে বহু দিন; তবে উপগ্রহটির বিপরীত পাশে কী রহস্য লুকিয়ে, তা ভেদ করতে চাইছে চীন।

পৃথিবীর বিচারে চাঁদের অন্ধকার অংশটিতে আলো ফেলতে সেখান থেকে মাটি ও পাথরের নমুনা আনতে যাত্রা শুরু করেছে চীনের মহাকাশযান চ্যাঙ’ই-৬।

চীনের হাইনান প্রদেশের ওয়েনচাং স্পেস লঞ্চ সেন্টার থেকে শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫ টা ২৭ মিনিটে মনুষ্যবিহীন লং মার্চ-৫ রকেটে করে উৎক্ষেপণ করা হয় চন্দ্রযানটি।

রকেট থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর চ্যাঙ’ই-৬ এর চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাতে সময় লাগবে চার থেকে পাঁচ দিন। এরপর জুন মাসের প্রথম দিকে চাঁদের অদেখা পাশের দক্ষিণ মেরুর আইটকেন বেসিনে অবতরণ করবে এটি। বেসিনটি ২,৫০০ কিলোমিটার চওড়া এবং ৮ কিলোমিটার গভীর।

রোবটযানটি চাঁদের বুকে দুদিন থেকে মাটি ও পাথরের নমুনা সংগ্রহ করে ফের পৃথিবীর পথে রওনা হবে।

৫৩ দিনের এই মিশনের লক্ষ্য গবেষণার জন্য চাঁদের বুক থেকে দুই কেজি মাটি-পাথরের নমুনা নিয়ে আসা। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহটি কীভাবে গঠিত হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণার জন্যই নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, আইটকেন বেসিন চাঁদ সৃষ্টি হওয়ার সময়ই তৈরি হয়েছে। তাই এখানকার মাটি-পাথরের নমুনা বিশ্লেষণ করে হয়ত চাঁদ কীভাবে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে নতুন এবং উল্লেখযোগ্য কোনও তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

চীনের এই অভিযান সফল হলে তা দেশটির চাঁদ ও মহাকাশ গবেষণা কর্মসূচির জন্য হবে আরেকটি মাইলফলক।

দেশটির চন্দ্র অনুসন্ধান কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়ক উ ওয়েরেন রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াকে বলেছেন, “চাঁদের অদেখা পাশ থেকে মাটি-পাথরের নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা একটি অভূতপূর্ব কীর্তি হবে।”

কারণ চীনই প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের উল্টোপাশের মাটি-পাথরের নমুনা নিয়ে আসতে চলেছে। এমনকি চীনই প্রথম চাঁদের উল্টোপাশে সফলভাবে মহাকাশযান অবতরণ করিয়েছে।

২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুর দিকে চাঁদের উল্টোপাশে অবতরণ করেছিল চীনের মহাকাশযান চ্যাঙ’ই-৪। সেবারই প্রথম পৃথিবীর কোনও দেশের মহাকাশযান চাঁদের উল্টোপিঠে অবতরণ করে। চীন ছাড়া আর কোনও দেশ এখনও চাঁদের উল্টোপাশে সফলভাবে অভিযান চালাতে পারেনি।

উ ওয়েরেন বলেন, “আমরা চাঁদের অন্য পাশ সম্পর্কে খুব কমই জানি। যদি চ্যাঙ’ই-৬ মিশন তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তবে এটি বিজ্ঞানীদের চাঁদের অদেখা অংশের পরিবেশ ও বস্তুগত গঠন বোঝার জন্য প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ সরবরাহ করবে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।”

কী আছে চাঁদের উল্টো পাশে

চাঁদের বিপরীত পাশটি পৃথিবী থেকে কখনও দেখা যায় না বলে তা মানুষের কাছে রহস্যের আকর হয়ে রয়েছে।

পৃথিবী থেকে সবসময় চাঁদের একটি দিকই দেখা যায়, কারণ চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে আসতে যে সময় নেয়, নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতেও তার একই সময় লাগে। ফলে পৃথিবীর দিকে সবসময় চাঁদের একটি দিকই থাকে।

পৃথিবী থেকে চাঁদের অদেখা পাশটিকে বিজ্ঞানীরা ‘ডার্ক সাইড’ বা ‘অন্ধকার দিক’ বলেও ডেকে থাকেন। তবে সেখানেও আসলে সমান হারেই সূর্যের আলো পড়ে। কিন্তু সেটি কখনও পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, তাই এমন নাম।

পৃথিবী থেকে দেখা যাওয়া অংশের তুলনায় চাঁদের এই অংশটি বেশ আলাদা। এখানে জমাট পুরনো ভূত্বক রয়েছে, যার চারদিকে রয়েছে অসংখ্য গর্ত। সেখানে বেশ কিছু অশ্বখুরাকৃতির আগ্নেয়গিরিজাত শিলাও রয়েছে, যেমনটা রয়েছে পৃথিবী থেকে দেখা যাওয়া অংশেও।

তবে চাঁদের অদেখা দিকটিতে বিশাল দক্ষিণ মেরু-আইটকেন অববাহিকাসহ বিভিন্ন আকার ও গভীরতার আরও অনেক খাদ রয়েছে।

চাঁদের প্রকৃত ‘অন্ধকার’ অংশের অবস্থান হলো এর দক্ষিণ মেরুর কেন্দ্রভাগ, সেখানে থাকা হিমশীতল গর্তগুলো সবসময় ছায়ায় আবৃত থাকে।

যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০২৬ সালে আর্টেমিস-৩ মিশনের মাধ্যমে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, সেখানে বরফের আকারে পানির অস্তিত্ব রয়েছে।

চাঁদের উল্টোপাশে মহাকাশযান পাঠানো নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল যোগাযোগের সমস্যা। কারণ উল্টোপাশ থেকে যে সিগন্যাল পাঠানো হবে, চাঁদ নিজেই সেটিকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে বাধা দেবে। একইভাবে পৃথিবী থেকে পাঠানো সিগন্যালও সেখানে পৌঁছাবে না। এর জন্য দরকার রিলে স্যাটেলাইট, যেটি চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝখানের এমন কোনও অংশে অবস্থান নেবে, যাতে দুই জায়গাতেই সিগন্যাল পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে পারে।

এজন্যই ২০১৮ সালের ২০ মে চীন চাঁদের কক্ষপথে কোয়েকিয়াও নামে একটি রিলে স্টেশন পাঠায়। এরপর সে বছরেরই ডিসেম্বরে চ্যাঙ’ই-৪ চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে, যা চাঁদের উল্টোপাশে গিয়ে পৌঁছায় পরের বছরের জানুয়ারিতে। এর মধ্য দিয়ে চীন এক নতুন ইতিহাস গড়ে। সেই প্রথম পৃথিবীর কোনও দেশের মহাকাশযান চাঁদের উল্টোপিঠে অবতরণ করে।

চাঁদের উল্টো পাশ নিয়ে কেন এত রহস্য

মহাকাশে অভিযানের আগে মানুষের ধারণা ছিল, চাঁদের অন্য পাশটি একটি হিমায়িত ও অশুভ অঞ্চল। ১৯৭৩ সালে পিঙ্ক ফ্লয়েডের গানের অ্যালবাম ‘ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন’ চাঁদের উল্টো পাশ নিয়ে মানুষের এই উৎকল্পনাকে আরও উস্কে দেয়।

তবে ১৯৫৯ সালের অক্টোবরের আগ পর্যন্ত চাঁদের উল্টো পাশটি প্রকৃত অর্থেই মানুষের কাছে রহস্যাবৃত ছিল। তখনই সোভিয়েত রাশিয়ার মহাকাশ কর্মসূচি চাঁদের চারপাশে লুনা-৩ মহাকাশযানকে ঘুরিয়ে আনে। লুন-৩ চাঁদের উল্টোপাশের কয়েকটি ছবি তুলে আনে। ওই ছবিগুলো থেকেই মানুষ সর্বপ্রথম চাঁদের উল্টোপাশটা দেখতে পায়।

তার ৫০ বছর পর ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র চাঁদের চারপাশে ঘূর্ণায়মান রোবট মহাকাশযান লুনার রিকনেসান্স অরবিটারকে মহাকাশে পাঠায়। সেটি এখনও চাঁদের পৃষ্ঠের ছবি তুলে পাঠাচ্ছে। লুনার রিকনেসান্স অরবিটারের পাঠানো ছবিগুলো থেকে বিজ্ঞানীরা চাঁদের অপর পাশের বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করেছেন।

চীনের চ্যাঙ’ই-৬ মিশন চাঁদে একটি স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণের এক দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের অংশ। চীন ও রাশিয়া মিলে ওই আন্তর্জাতিক চন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রটি (আইএলআরএস) তৈরি করবে।

চীনের মহাকাশ কর্মসূচির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানো, মঙ্গল গ্রহ থেকে মাটির নমুনা আনা এবং আগামী চার বছরে তিনটি চন্দ্র অনুসন্ধান মিশন চালানো। চাঁদে চীনের পরবর্তী মিশনটি ২০২৭ সালের জন্য নির্ধারিত হয়েছে।

এর আগে চীন তিনবার চাঁদের মাটিতে সফলভাবে মহাকাশযান অবতরণ করিয়েছে। দেশটি চাঁদের বুকে প্রথম সফল অভিযান চালায় ২০১৩ সালে। সেবছরের ১৪ ডিসেম্বর চীনের মহাকাশযান চ্যাঙ’ই-৩ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে। দ্বিতীয় অভিযানটি ছিলো চ্যাঙ’ই-৪ (২০১৯), যার মাধ্যমে চীন প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের উল্টোদিকে মহাকাশযান অবতরণ করায়।

২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর চীন চ্যাঙ’ই-৫ মহাকাশযানকে চাঁদে পাঠায়। তৃতীয়বারের মতো চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণ করে চীনা মহাকাশযান। চ্যাঙ’ই-৫ মহাকাশযানটি চাঁদের এপাশের মাটি-পাথর নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে সে বছরের ১৭ ডিসেম্বর। এর মধ্য দিয়ে চীন আরেকটি নতুন ইতিহাস গড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পর চীন তৃতীয় দেশ যারা এমন অভিযানে সফল হলো। ৪৪ বছর পর আবার চাঁদের মাটি ও পাথর আসে পৃথিবীতে।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, দ্য প্ল্যানেটারি সোসাইটি, নাসা, স্পেস ডটকম, ম্যাশেবল ডটকম

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত