Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ইরাক থেকে ৯৯ টাকায় কেনা খেজুর কেন দেশে ৩৫০ টাকা

ঢাকার বাদামতলীর ফল পট্টিতে আমদানি করা সব ধরনের খেজুর মেলে।
ঢাকার বাদামতলীর ফল পট্টিতে আমদানি করা সব ধরনের খেজুর মেলে।
Picture of অনিক রায়

অনিক রায়

ঘনিয়ে আসছে রোজা, আর তাই বাজারে খোঁজ পড়ছে খেজুরের। যারা সারাদিন রোজা রাখেন, সন্ধ্যায় ইফতারে তাদের আর কিছু না হোক, একটি খেজুর যেন থাকতেই হয়। তবে আমদানি করা এই ফলের দামের সঙ্গে এবার তাল মেলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।

রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় সব ধরনের খেজুরের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে। সবচেয়ে কম মানের খেজুরটির দামও এবার ৩৫০ টাকা।

বাজারে বেশি দাম দেখা যাচ্ছে মেডজুল ও আজোয়া খেজুরের। মেডজুল প্রতি কেজি ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা, আজোয়া ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। আরও দামি খেজুরও আছে।

এছাড়া প্রতি কেজি মারিয়াম খেজুরের দাম ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, মাবরুম ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, দাবাস ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।

সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে জাহিদি খেজুর, দাম ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি।

আমদানিকারকরা বলছেন, গত বাজেটের পর থেকে খেজুরে যে পরিমাণ শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তার কারণেই এত দাম।

গত বছর রোজায় যে খেজুর পাইকারি বাজারে ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, এবার সেই খেজুরের ওপরই আমদানি শুল্ক গুনতে হচ্ছে ২০৮ টাকা। ফলে পাইকারি বাজারেই খেজুরটির দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।

গত অর্থবছরের বাজেটে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল।

পাশাপাশি খেজুরকে বিলাসী পণ্যের শ্রেণীতে ফেলায় শুল্ক বেড়ে তার দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে বলে আমদানিকারকদের ভাষ্য।

দামের প্রথম ধাপেই বড় ফারাক

সবচেয়ে কম দামে যে খেজুর বাংলাদেশে আমদানি করা হয়, তার নাম জাহিদি খেজুর। দুবাইয়ের বিভিন্ন সুপার শপে এই খেজুরের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩৮ টাকা দেখা যায়। বাংলাদেশে এবার তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৪০০ টাকায়।

বাংলাদেশের আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা খেজুর আনেন দুইভাবে । হয় কন্টেইনারের করে, না হলে বস্তায় ভরে। কনটেইনারে আনা খেজুরের দাম একটু বেশি হয় বস্তায় আনা খেজুর থেকে।

আমদানিকারকরা বলছেন, কনটেইনারে আসা জাহিদি খেজুরটি মধ্যপ্রাচ্যে কিনতে তাদের খরচ হয়েছে প্রতি কেজিতে ৯৯ টাকা।

ঢাকার ফলের বড় আড়ত বাদামতলীর ফল পট্টি ঘুরে দেখা যায়, সেখানে জাহিদি খেজুর বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০-২৬০ টাকা।

সেখান থেকে পাইকারি বিক্রেতারা কিনে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন ২৭০-২৮০ টাকায়। খুচরায় কিনতে গেলে গুণতে হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা।

আমদানিকারকদের কেনা দাম আর পাইকারিতে দামের বড় ফারাক কেন, প্রশ্নে ব্যবসায়ীরা উচ্চ শুল্কের কথাই বলেন।

ঢাকার বাদামতলীর ফল পট্টিতে এবার সব ধরনের খেজুরের দামই গতবারের চেয়ে বেশি।

শুল্ক কত

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ৩৫ বছর ধরে খেজুর আমদানি করছেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বর্তমানে খেজুরের শুল্কায়ন মূল্য প্রতি টন ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৭৫০ ডলার। এর সঙ্গে কাস্টমস ডিউটি ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর বাবদ ৫ শতাংশ মিলিয়ে ৪৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে।

সিরাজুল বলেন, “আমরা ইরাক থেকে কার্টনে ৮০০-৯০০ ডলারে যে খেজুর আমদানি করছি, সেটার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫০০ ডলারে। প্রায় তিন গুণ বেশি দাম দেখিয়ে যে খেজুরটার শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

“কাস্টমস আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ ও আমাদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত দামের ওপর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করুক, এটাই আমরা চাই। না হলে খেজুরের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।”

প্রতি বছর রোজায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি খেজুরের চাহিদা থাকে বলে জানান সিরাজুল।

তিনি বলেন, এবার ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে এবং শুল্কায়নের অপেক্ষায় ৪০০-৫০০ কন্টেইনার খেজুর বন্দরে আটকে আছে, যেখানে ১৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি খেজুর রয়েছে।

“বাড়তি অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুর কারণে এই খেজুরগুলো ব্যবসায়ীরা ছাড়াচ্ছে না। আর নতুন করে আমদানিও করতে চাচ্ছে না।”

বাংলাদেশের কাস্টমস আইন-২০২৩ অনুসারে, আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক নির্ধারণ হয় তার দামের ভিত্তিতে বা ওই দামের নিকটতম নিরূপণযোগ্য সমতুল্য দামের ভিত্তিতে। এই নিকটতম দাম যা নির্ধারণ করা হয়, তাই ‘অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু’।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমি যেই খেজুর যে মূল্যেই আনি না কেন, কনটেইনারে খেজুর আনলে তা টন প্রতি কাস্টমসের নির্ধারিত মূল্য ২৫০০ ডলার এবং হিমায়িত খেজুর প্রত্যেক টন ৪০০০ ডলার হিসেবে শুল্ক দিতে হয়।

“কাস্টমস আমাদের ওপর অভিযোগ করে, আমরা কেনা দাম কম দেখাতে চাই, যাতে আমাদের শুল্ক কম দিতে হয়। আমি এনবিআরে গেছি, তাদের বলছি, বিশ্ববাজারে খেজুরের দাম কত তা তো খুঁজে বের করা কঠিন না। কিন্তু তারা তো আমাদের কথা শুনবে না।”

রমজান ঘিরে আমদানি হওয়া সবচেয়ে কম দামের খেজুর এসেছে ইরাক, দুবাই ও তিউনিসিয়া থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব খেজুরের দাম প্রতি কেজিতে ৬৫ টাকা থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ এসব খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করেছে ১২০ টাকা।

প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরে শুল্ক আদায় করছে কাস্টমস অভিযোগ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি মেট্রিক টন খেজুর ৫০০-১৩০০ ডলার দিয়ে কিনে দেশের তার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ধরা হয়েছে শ্রেণী ভেদে ১০০০-২৭৫০ ডলার।

আমদানিকারকরা বলছেন, উচ্চ শুল্কের কারণেই এবার খেজুরের এত দাম।

শুল্ক কমানোর ঘোষণায় হচ্ছে না লাভ

বাদামতলী ফল পট্টির পাইকারি খেজুর বিক্রেতা আল-আমিন হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দাম ২০০ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা কমালে কি দাম কমে? খেজুর একটি পবিত্র ফল। এর উপর কেউ এত শুল্ক ধরে?”

এবার খেজুর বিক্রি কম জানিয়ে তিনি বলেন, “ক্রেতারা আসে দাম শুনে, আমাদের গালি দিয়ে চলে যায়। এরকম সময় আমার দোকানভরতি থাকে খেজুরে। কিন্তু আপনি নিজেই দেখেন দোকান খালি। বিক্রি হবে কি হবে না, জানি না। তাই রিস্ক নিয়ে বেশি খেজুর কিনি নাই।”

একই কথা বিএফএফআইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলামেরও মুখে। তিনি বলেন, গত রোজা থেকে এ রোজা পর্যন্ত শুল্ক সব মিলে বেড়ে হয়েছে ৫৩ শতাংশ।

“সেখান থেকে মাত্র ১০ শতাংশ কমালে কি দাম কমে? আমরা তো ভেবেছিলাম আরও কমানো হবে। কিন্তু যা কমানো হলো, তা কমানো আর না কমানো একই।”

তিনি বলেন, “বাজারে ইতোমধ্যেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা রোজায় আরও বাড়বে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষগুলো এবার খেজুর কিনতে পারবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত