“সুখবরটা শুনে যেতে পারলে বেশি খুশি হতেন বাবা”- যশোরের বেনাপোল থেকে মুঠোফোনের অন্য প্রান্তে রাব্বী হোসেন রাহুলের কন্ঠে কান্না। গলার মধ্যে দলাপাকানো যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে বলতে থাকেন, “ফুটবল খেলে জাতীয় দলে সুযোগ পাবো, সেই স্বপ্নই দেখতেন বাবা। কিন্তু গত বছর বাবা মারা গেছেন। এমন দিনে বাবার কথায় সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। তিনি দেখে যেতে পারলেন না আমার সাফল্য। আক্ষেপটা সারা জীবন থাকবে।”
ঘরোয়া ফুটবলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে রাহুল এবার জাতীয় দলের স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরার নজর কেড়েছেন। আগামী ২১ ও ২৬ মার্চ ফিলিস্তিনের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে খেলবে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের এই দুটি ম্যাচের জন্য উদীয়মান ফুটবলার রাহুলকে প্রাথমিক দলে চেয়েছেন কোচ। শুধু তাই নয়, রাহুলকে নিয়ে যাবেন সৌদি আরবে হতে যাওয়া জাতীয় দলের কন্ডিশনিং ক্যাম্পে।
রাহুলের ফুটবলার হওয়ার গল্প যেন সিনেমার কাহিনিকেও হার মানাবে। বেনাপোল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রামের ভবারবেড়ে জন্ম রাহুলের। গ্রামটি মাদক, চোরাচালান আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। যে গ্রামে মরণনেশা ইয়াবা গ্রাস করে নিয়েছে বেশির ভাগ তরুণকে।
বেচাকেনা ও পাচারের জন্য যে গ্রামে মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে এলাকার শিশু-কিশোরদের। ভয়ঙ্কর মরণনেশা এড়িয়ে সেই গ্রাম থেকে উঠে এসে রাহুল এবারের প্রিমিয়ার লিগে খেলছেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে।
রাহুলের উত্থান ২০২২ সালের জাতীয় স্কুল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে। বেনাপোলের মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের বাবার নামে গড়া এই একাডেমির ফুটবলাররাই সেবার খেলেন জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে। টুর্নামেন্টে রাহুল খেলেন বেনাপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জার্সিতে। ওই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দেওয়ায় তৃতীয় বিভাগ ফুটবলের দল বিক্রমপুর কিংসে সুযোগ পান। লিগে ফ্রি কিকে দর্শনীয় একটা গোল করেন দিপালী যুব সংঘের বিপক্ষে। ওই গোলটি নজরে আসে বসুন্ধরা কিংসের একাডেমির কোচদের। এরপরই তারা নিয়ে নেন বসুন্ধরা কিংস একাডেমিতে।
এরপর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ওয়ারী ক্লাবের হয়ে খেলে জায়গা করে নেন জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। খেলেছেন সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে।
যদিও জাতীয় স্কুল ফুটবলে খেলার আগে ২০২০ সালে এফসি ইউনাইটেড ফেনীর হয়ে বসুন্ধরা কিংস বিএফএসএফ একাডেমি কাপেও খেলেছিলেন রাহুল। ওই টুর্নামেন্টেও অসাধারণ ফুটবল উপহার দেন এই স্ট্রাইকার।
বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে চুক্তি থাকায় প্রিমিয়ার লিগে রাহুলের ধারে অভিষেক হয়েছে ব্রাদার্সের জার্সিতে।
প্রথম লেগের ৯ ম্যাচে যেখানে ব্রাদার্স পরিণত হয়েছে গোল স্টোরেজে, রয়েছে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রাহুল। এরই মধ্যে গোল করেছেন বসুন্ধরা কিংস, আবাহনী লিমিটেড, শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের মতো বড় দলের বিপক্ষে। গোল দিয়েছেন ফর্টিস এফসির জালেও। যদিও শেখ জামাল ধানমন্ডির বিপক্ষে কোচ তাকে মাত্র ৪ মিনিট মাঠে নামিয়েছিলেন!
৯ ম্যাচে এ পর্যন্ত ৫ গোল করে স্থানীয় ফুটবলারদের মধ্যে আছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলের তালিকায়। ৬ গোল করে সবার ওপরে আছেন রাকিব হোসেন।
আসলে মাদকের চেয়ে ফুটবলের শক্তি যে বেশি, তা দেখিয়ে দিয়েছেন রাহুল। বেনাপোল রেলস্টেশনের পাশের বাজারে এক সময় সবজির দোকানের কর্মচারীর কাজ করতেন রাহুল। তবে এলাকার সচেতন অভিভাবকদের একজন ছিলেন রাহুলের বাবা লাল মিয়া। তিনি চাইতেন, ছেলে যেন পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়। কিন্তু রাহুলকে ফুটবলের নেশায় ঢুকিয়ে দেন কোচ সাব্বির আহমেদ পলাশ।
চোখের সামনে শৈশবের বন্ধুদের নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছেন রাহুল, ‘আমাদের এলাকার সবচেয়ে খারাপ জায়গায় থাকি আমি। ঘুম থেকে উঠে অনেক কিছু দেখতে হয়। ওরা যেসব ব্যবসা করে, এটাকে আমাদের এলাকায় ব্ল্যাক বলে। বন্ধুদের যাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম, তাদের অনেকে এখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে, নেশা করছে। অনেকে মাদক ব্যবসা করে। আমি ছাড়া গ্রামের অন্য চার-পাঁচটা পরিবার এসবের মধ্যে নেই। তবে ওদের দেখে খুব খারাপ লাগে।’
বল পায়ে রাহুলের টার্ন অসাধারণ। লিগের পুরো সময় দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে দেখা গেছে তাঁর পায়ে।
কাবরেরার প্রাথমিক দলে ডাক পেয়ে উচ্ছ্বসিত রাহুল, “প্রতিটা ফুটবলারের স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলের হয়ে খেলা। আমারও সেই স্বপ্ন। কোচ যদি আমাকে মাঠে নামান, চেষ্টা করবো দেশের জন্য নিজেকে উজাড় করে খেলতে।”
রাহুলের পায়ে ফুটবল এখন ফুল হয়ে ফোটার অপেক্ষায়।