Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সড়কে পানি ছিটালে কি গরম কমে, না বাড়ে

গরম কমানোর লক্ষ্য নিয়ে রাজধানীর সড়কে পানি ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ছবি : জীবন আমির
গরম কমানোর লক্ষ্য নিয়ে রাজধানীর সড়কে পানি ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ছবি : জীবন আমির
Picture of অনিক রায়

অনিক রায়

টানা এক মাস ধরে বইছে তাপপ্রবাহ; কয়েক জেলায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে, ঢাকায় ঘোরাফেরা করছে ৪০ ডিগ্রির আশপাশে। আবহাওয়া অধিদপ্তর দিচ্ছে হিট অ্যালার্ট।

চরম গরমে যখন নগরজীবনে হাঁসফাঁস, তখন আরাম দিতে ঢাকায় নগর কর্তৃপক্ষ সড়কে ছিটাচ্ছে পানি। ভরদুপুরে কয়েকদিন ধরেই রাজধানীর রাজপথে সক্রিয় কয়েকটি জলকামান।

সেই জলকামান থেকে ছিটানো জলে আপাত স্বস্তি পেতে দেখা যাচ্ছে সড়কে থাকা মানুষদের। উৎফুল্ল শিশুদের সঙ্গে সেই ‘কৃত্রিম বৃষ্টিতে’ ভিজতে দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকেও।

অসহনীয় গরম থেকে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে প্রথম পানি ছিটানো শুরু করে ডিএনসিসি। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও একই উদ্যোগ নেয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করছেন এই প্রচেষ্টার। তারা বলছেন, এভাবে পানি ছিটিয়ে কোনও লাভ নেই। যে পদ্ধতিতে পানি ছিটানো হচ্ছে, তাতে গরমের অনভূতি বাড়বে বৈ কমবে না।

এরকম চটকদার কর্মসূচিতে পানি অপচয় করে জনসাধারণের করের অর্থ ব্যয়ের সমালোচনাও করছেন তারা।

সম্প্রতি জলকামান থেকে ছিটানো পানিতে ভেজেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

কীভাবে এল এই উদ্যোগ

গরম কমাতে সড়কে পানি ছিটানোর সুপারিশ প্রথম আসে গত ২৩ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে।

তারপর ২৭ এপ্রিল থেকে রাস্তায় পানি ছিটানো শুরু করে ডিএনসিসি, যাকে মেয়র আতিক বলেন ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’।

কর্মসূচি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মেয়র আতিক বলেছিলেন, এখন থেকে প্রতিদিন ডিএনসিসির ১২টি গাড়ি দিয়ে নগরের বিভিন্ন সড়কে পানি ছিটানো হবে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রধান সড়কে দুটি ওয়াটার ক্যানন দিয়ে আর বিভিন্ন ছোট সড়কে ১০টি ওয়াটার বাউজার দিয়ে পানি দেবে ডিএনসিসি।

প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এভাবে পানি ছিটানো হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই কার্যক্রম চলবে উত্তরা, মিরপুর, ফার্মগেইট, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায়।

এরপর থেকে ঢাকার সড়কে ভরদুপুরে গরম যখন সবচেয়ে বেশি, তখন জলকামানগুলো থেকে পানি ছিটাতে দেখা যাচ্ছে।

এই কার্যক্রমের উদ্বোধনের সময় মেয়র আতিক বলেছিলেন, ডিএনসিসির ‘চিফ হিট অফিসার’ এর পরামর্শে পানি ছিটানোর উদ্যোগ।

সড়কে পানি ছিটালে বাড়ে গরম

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিচ কিংবা কনক্রিটের রাস্তা পানি শুষে নিতে পারে না। ফলে সেখানে পানি ছিটালে সেই পানি খুব অল্প সময়ের মধ্যে সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। সাগর উপকূলের বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে এমনিতেই আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ায় তখন আর্দ্রতাও বেড়ে যাচ্ছে।

বাতাসে ভাসমান জলীয় বাষ্প দিয়েই আর্দ্রতার পরিমাপ হয়। আর্দ্রতা বাড়লে মানব শরীরে ঘাম হয় বেশি। কারণ দেহ থেকে বেরিয়ে আসা পানি বাষ্পীভূত হতে পারে না। তাতে গরমের অনুভূতি যায় বেড়ে।

গত কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসেও বলা হচ্ছে, আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকায় গরমের অস্বস্তি বাড়বে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর সময়কাল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সিটি করপোরেশন পানি ছিটাচ্ছে অফিস টাইমে। এ সময় পানি ছিটানো নিষেধ। এ সময় পানি ছিটালে তা জলীয় বাষ্প হয়ে আর্দ্রতা আরও বাড়ায়, যাতে গরম আরও বেড়ে যায়; প্রচণ্ড গরম আরও বেড়ে যায়।”

তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খানও।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কনক্রিটে পানি দিলে তা খুব তাড়াতাড়ি জলীয় বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। কনক্রিটও তার ভেতরে যে তাপ ধরে রেখেছে, তা সেই সময় ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে গরম অনুভুত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের কোনও লাভ হচ্ছে না।”

এভাবে পানি ছিটালে যে রাতের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, তা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রকৃতিতে যেসব বস্তু আছে, তাদের মধ্যে তাপ ধারণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি পানির। যে বাষ্প তৈরি হচ্ছে দিনের বেলা, আর্দ্রতা যদি এমনিতেই বেশি থাকে এবং আমি যদি আবার বাড়তি জলীয় বাষ্প তৈরি করি, তাহলে এই তিনে মিলে রাতে আমার পরিবেশ যে ঠাণ্ডা হওয়ার কথা, সেই প্রক্রিয়াটি নিজেরাই নষ্ট করে দিলাম।

“এভাবে পানি ছিটিয়ে হবে না। আপনাকে পানি দিয়ে প্লাবিত করে ফেলতে হবে, যাতে সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। যেহেতু আপনি সেটা পারছেন না, ফলে কিছুটা ছিটিয়ে হিতে বিপরীতই হবে।” 

গরমে হাঁসফাঁস জনজীবনে তৃষ্ণা নিবারণে পানি পানে এক রিকশাচালক। ছবি : জীবন আমির

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল খানও বলেন, “তারা যে পরিমাণ পানি ছিটাচ্ছে, তা তো পুরো শহরের তুলনায় কিছু না। দীর্ঘমেয়াদে এর কোনও ইমপ্যাক্ট নাই।”

একে ‘চটকদার কাজ’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “সিটি কর্পোরেশন তো বিজ্ঞান বুঝে কাজ করছে না। তারা মানুষকে একটু সাময়িক স্বস্তি দেওয়ার জন্য করছে। কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে মিলিয়ে কাজ করতে হবে। তা না হলে লাভ হবে না।”

এ ধরনের কাজকে গরম কমানোর ‘টোটকা পদ্ধতি’ বলছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’র প্রধান এম জাকির হোসেন খান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসবকে আপনি টোটকা বলতে পারেন। কাজের কাজ কিছুই হবে না। বলার জন্য বলা হয়েছে আরকি।”

জাকির বলেন, “ঢাকায় এমনিতেই জলাধার নেই। শোনা যাচ্ছে ২-৩ শতাংশ জলাধার রয়েছে। এই গরম সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। আপনি এই পানি যে ছিটাচ্ছেন, সেই পানি আসছে কই থেকে? কতদিন আপনি এই পানি ছিটাবেন?

“এই পানির জন্য হয় আপনি জলাধার থেকে নিচ্ছেন; তা নাহলে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছেন। এতে তো আমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে।”

এই কাজ নিয়ে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে ডা. মুশতাক বলেন, “বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে নিজেরা নিজেরা করে ফেললে তো হবে না। এসব কাজে নষ্ট হচ্ছে জনগণের টাকা।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সড়কে ছিটানো পানি গরম বাড়িয়ে তুলছে। ছবি : জীবন আমির

তাহলে কী করা যায়

গরম কমাতে নগর কর্তৃপক্ষের পানি ছিটানোয় লাভ না হলেও তারা যে কিছু করতে চাইছে, সেই চেষ্টাকে সাধুবাদ দিচ্ছেন ডা. মুশতাক।

তিনি বলেন, “কিছু না করার থেকে কিছু করা ভালো। পিচ ঢালা রাস্তায় পানি দিচ্ছে, তাতে যদি আইল্যান্ডের গাছগুলোর গায়ে কিছু পানি লাগে, তাহলে লাভ।”

পানি ছিটানোর সময় বাতলে দিয়ে তিনি বলেন, “সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে যখন সূর্য থাকবে না, তখনপানি ছিটানোর নিয়ম।

“আর পানি ছিটাতে হবে মাটিতে এবং গাছে। গাছ মাটি পানিটা শুষে নেবে। তারা অক্সিজেন ছাড়বে, কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করবে। কনক্রিট তো পানি শুষতে পারে না, সেখানে পানি দিয়ে কী লাভ হবে?”

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল খানও বলেন, “যদি পানি দিতেই হয়, দিতে হবে গাছে। কারণ একমাত্র গাছই পারে এসময় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে। গাছ বেঁচে থাকলে সে কার্বন গ্রহণ করতে পারবে এবং অক্সিজেন ছাড়বে, যাতে আমাদের যে তাপমাত্রা তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।”

 চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের জাকির দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে বলেন, “দেখেন এ রকম গরম এখন প্রায়ই দেখা যাবে। এখন আমাদের ঢাকা ধরে পরিকল্পনার করার সময় এসেছে।

“প্রত্যেক ১-২ কিলোমিটার জায়গা পরপর জলাধার তৈরি করতে হবে। তার আশপাশে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ, যেমন বাঁশ গাছ লাগাতে হবে। তাতে আশপাশে গরম থাকলেও জলাধার ধরে জায়গাটিতে তুলনামূলক তাপমাত্রা কম থাকবে।”

সড়কে পানি ছিটাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

সদুত্তর নেই কর্মকর্তাদের কাছে

পানি ছিটানোর এই বিষয়ে কথা বলার জন্য সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে রবি ও সোমবার ডিএনসিসির বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

ডিএনসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম সাংবাদিক পরিচয় জানার এবং প্রশ্ন শোনার পর বলেন, “আমি একটি সভায় আছি। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।”

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেনের কাছে প্রথমে জানতে চাওয়া হয়- এভাবে পানি ছিটানোর কর্মসূচি আর কতদিন চলবে?

প্রশ্নের উত্তরে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “কতদিন ছিটানো হবে তা ঠিক নেই। পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” 

বিশেষজ্ঞদের বিপরীত বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মকবুল বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলতে পারবেন।”

দুদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করার পর ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমকে পাওয়া যায় সোমবার।

তিনি বলেন, “আমরা এ বিষয়টি জানতাম না। আমরা আমাদের পরিবেশবিদদের সাথে কথা বলব। আমরা মূলত ভেবেছিলাম যে সময়টাতে তাপ বেশি থাকে সে সময়টা ধরে আমরা পানি দিচ্ছিলাম। আমরা দরকার পড়লে পরিকল্পনা পরিবর্তন করব। যাই করব, তা পরিবেশের কথা মাথায় রেখে করব।”

ডিএনসিসির ‘চিফ হিট অফিসার’ বুশরা আপাতত কোনও কথা বলবেন না বলে জানানো হয়েছে।

ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টায় যৌথভাবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের (আর্শট-রক) সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করে ডিএনসিসি।

আর্শট-রক বিশ্বের বিভিন্ন শহরে তাদের কাজের অংশ হিসেবে ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ করে। ডিএনসিসিতে গত বছর ‘চিফ হিট অফিসার’ হিসাবে মেয়র আতিকের মেয়ে বুশরা আফরিনের নাম ঘোষণা করা হয়।

মেয়ের আতিকের মেয়ে বুশরার পড়াশোনা কানাডায় গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে। দেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শক্তি ফাউন্ডেশনেও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত