Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বয়কট ডাকে ‘হালাল’ বিনিয়োগের পালে হাওয়া

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

 ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, স্যাংশন (বিডিএস) আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। অনেকে অর্থ ব্যয় বা বিনিয়োগের আগে তাদের অর্থ কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।

এ অবস্থায় বেড়েছে ইসলামী ‘শরিয়াহ সম্মত’ পদ্ধতিতে বিনিয়োগের আগ্রহ, যা বিশ্বব্যাপী গতি এনেছে ‘হালাল’ অর্থনীতিতে। 

হালাল বিনিয়োগ মূলত কারও বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা- এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাজ্যের ইসলামি ফিন্যান্স কাউন্সিলের পরিচালক ওমর শেখ।

বিশ্বজুড়ে হালাল বিনিয়োগ

শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ইসলামি হালাল অর্থনীতির বাজারমূল্য ৭.৭ ট্রিলিয়ন (৭,৭০০ বিলিয়ন) ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি ২০১৫ সালের ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি এবং মাত্র তিন বছর আগে ২০২১ সালের ৫.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি।

গত বছর ইসলামি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কাউন্সিলের (সিআইবিএফআই) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী ইসলামি তহবিলের বাজার ৩০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। বর্তমানে এই তহবিলের আকার প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার।

এসব পরিসংখ্যান হালাল বা ‘শরিয়াহ সম্মত’ বিনিয়োগ ও সুযোগের চাহিদা বাড়ার চিত্র তুলে ধরেছে।

ইসলামে সাধারণভাবে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে বিনিয়োগের কিছু বিশেষ দিক – যেমন সুদ নেওয়া-দেওয়া নিষিদ্ধ। এর ফলে অতীতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগে মুসলমানদের জন্য সুযোগের অভাব ছিল।  

হালাল বিনিয়োগ কী

হালাল একটি আরবি শব্দ যার অর্থ ‘অনুমোদিত’, যা নির্দেশ করে-

১. লেনদেনে কোনও ‘রিবা’ (সুদ) জড়িত থাকতে পারবে না।

২. ‘হারাম’ (অবৈধ) সম্পদ বা পণ্যদ্রব্য যেমন শূকরের মাংস, মদ বা সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করা যাবে না।

৩. ‘ঘারার’ (অস্পষ্টতা) এর ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করা যাবে না।

যুক্তরাজ্যের ইসলামিক ফিন্যান্স কাউন্সিলের (ইউকেআইএফসি) পরিচালক ওমর শেখ আল জাজিরাকে বলেন, “হালাল বিনিয়োগ মূলত আপনার টাকা ও আর্থিক লেনদেন ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিচালনা করা।

“মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, সমাজের জন্য ক্ষতিকর বা ধর্মের নীতিবিরুদ্ধ পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জনের চেয়ে হালাল পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জন করা উত্তম।”

ইসলামিক ফিন্যান্স গ্রুপ এথিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক উমর মুন্সী বলেন, “শরিয়াহ এখানে মূল চালিকা শক্তি। তবে নীতিগত বিনিয়োগে এখন আরও এগিয়ে চিন্তা করতে হবে। প্রতিষ্ঠান ও তাদের বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে নীতিগত কি না, সেটিও নিশ্চিত হতে হবে।”  

কোনও ব্যবসা সমাজ বা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না- উল্লেখ করে উমর মুন্সী আল জাজিরাকে বলেন, “অর্থাৎ শুধু মেনে চলাই যথেষ্ট নয়, বরং নেতিবাচক প্রভাব না রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, একটি তামাক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়ত শরিয়াহ সম্মত হতে পারে, কিন্তু এটি সমাজের জন্য ভালো নয়।”

হালাল বিনিয়োগ যেভাবে কাজ করে  

হালাল বিনিয়োগ হচ্ছে ইসলামি ব্যবসায় অর্থায়ন, তা শরিয়াহ সম্মত বিমা ও সুকুকের মাধ্যমে হতে পারে। 

সুকুক মূলত তহবিল সংগ্রহের ইসলামী ব্যবস্থাপত্র বা মাধ্যম, যার মাধ্যমে সরকার বা কোম্পানি তাদের পুঁজি বা মূলধন সরবরাহ করে থাকে।

বিভিন্ন দিক থেকে শেয়ার বা বন্ডের সঙ্গে সুকুকের পার্থক্য আছে। অন্য বন্ড বা ব্যবস্থাপত্র কিনে বিনিয়োগকারীরা সুদ পেয়ে থাকে। তবে সুকুক বিনিয়োগকারীরা কোনও ব্যবসার আংশিক মালিকানা লাভ করে এবং মুনাফার অর্থ সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। এই অর্থ শরিয়াহ মেনে চলার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য সুদের পরিবর্তে দেওয়া হয়।

ইউকেআইএফসির ওমর শেখ বলেন, “বিশ্বে ইসলামি অর্থায়ন খাতের বয়স মাত্র ৩০ বছর। গত ১৫ বছরে এর উন্নতি দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি।

“এক্ষেত্রে আসলে বিষয়টি বোঝাতে ও সচেতনতা তৈরিতে সময় লেগেছে। তবে এ সময়ে আরও বেশি ব্যাংক হালাল বিনিয়োগের চাহিদা পূরণে মনোযোগ দিয়েছে। এর ফলে আরও পণ্য তৈরি হয়েছে, যা বাড়িয়েছে আরও চাহিদা।” 

জানা-বোঝা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি আর্থিক পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

গবেষণা গ্রুপ দিনারস্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০২৩’ অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২৫.৯ বিলিয়ন ডলার শরিয়াহ সম্মত বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১২৮ শতাংশ বেশি।

দুবাইভিত্তিক রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম স্মার্টক্রাউডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিক ফরিদ বলেন, “সাধারণভাবে হালাল বিনিয়োগ বাড়ছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করছে, যা বিশ্বব্যাপী সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। 

“বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সামাজিকভাবে অনেক বেশি সচেতন। তারা বুঝতে পারে তাদের টাকা কোথায় যাচ্ছে এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।”

সিদ্দিক ফরিদ মনে করেন, সুযোগ বৃদ্ধি ও সহজপ্রাপ্যতাকেও হালাল বিনিয়োগ বাড়ার কারণ হিসেবে দেখা যায়। 

গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রভাব

গাজায় ৭ অক্টোবর ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালানোর পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার মানুষ। গাজার বাড়িঘরও সব প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

আল জাজিরা বলছে, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলকে সমর্থনকারী ব্র্যান্ড বয়কট শুরু করে বিশ্বের অনেক মানুষ। এই বয়কট থেকে উৎসাহ বাড়ায় অতি সম্প্রতি হালাল বিনিয়োগের চাহিদা বেড়েছে। 

গাজায় যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের আওয়াজ উঠেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।

স্মার্টক্রাউডের ফরিদ বলেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এত ফিলিস্তিনি নিহতের ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মানসিকতায় ‘বদল’ এসেছে। 

“হালাল বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়ছে। গত ছয় মাসে এটি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। বেশিরভাগ নতুন প্রজন্ম ও যাদের বয়স ৪০ বছরের কম তাদের মধ্যেই উৎসাহ বেশি,” বলেন তিনি।

ফরিদ আরও বলেন, “অতীতে এই লোকদের বেশিরভাগই হালাল কিছু খুঁজতেন। ব্যাপারটি ছিল এমন- যতক্ষণ না এটি হারাম, ততক্ষণ এটি ভালো। 

“তবে এখন কেবল হালাল নয়, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে হালাল সম্পর্কে আরও সচেতনতা বেড়েছে। এসব বয়কট আন্দোলন মানুষকে অনেক বেশি সচেতন করেছে। যেমন- কিছু হালাল হতে পারে; তবে আপনি তা ব্যবহার করতে, তার সঙ্গে যুক্ত হতে বা বিনিয়োগ করতে চান না।”

হালাল বিনিয়োগের উত্থানে প্রযুক্তির অবদান

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আর্থিক খাতের বিশেষায়িত সাময়িকী ফিনটেক গত বছরের ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে জানায়, মুসলমানরা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তবে আর্থিক সম্পদের মাত্র এক শতাংশ শরিয়াহ সম্মত বিনিয়োগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক খাতের প্রযুক্তি বা ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি (ফিনটেক) আসার পর তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের বদল এনেছে। আর্থিক প্রযুক্তি পণ্যগুলো সেবাকে সাধারণ গ্রাহক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে, যা বিনিয়োগে আরও বেশি প্রবেশাধিকার দিয়েছে। 

ফিনটেক ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অনলাইন আর্থিক প্লাটফর্ম ইসলামিক ফাইন্যান্স গুরুর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহিম খান বলেছেন, “বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলমানরা সাধারণত তেমন সচেতন নয়। অবশ্য সুযোগের অভাবও রয়েছে। এমনকি শরিয়াহ সম্মত বিনিয়োগ সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্যও পায় না বেশিরভাগ মুসলিম।”

ইব্রাহিম খানের মতে, সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে বেড়েছে সচেতনতা, যা শরিয়াহ সম্মত অর্থায়ন বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এছাড়া ফিনটেক হালাল বিনিয়োগের সুযোগ বাড়িয়েছে। কারণ স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ দিয়ে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগে অংশগ্রহণ সহজ। 

পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে আর্থিক খাতের প্রযুক্তি- ফিনটেক শিল্পের আয় প্রচলিত ব্যাংকিং খাতের তুলনায় প্রায় তিনগুণ দ্রুত বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

এখানে বলে রাখা দরকার, আর্থিক খাতে ব্যবহৃত ফিনটেক শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয় প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম প্রতিটি আর্থিক উদ্ভাবনকে। তা আর্থিক সেবা সরবরাহ এবং তার ব্যবহার উন্নত ও স্বয়ংক্রিয় করার চেষ্টা করে। 

ফিনটেক বিশেষায়িত সফটওয়্যার ও অ্যালগোরিদমে তৈরি করা হয়, যা কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে ব্যবহার করা হয়। 

ফিনটেক এরই মধ্যে পি-টু-পি, চেক জমা, অর্থের লেনদেন, বিল পরিশোধ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ক্রাউড ফান্ডিং ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সাড়া পেয়েছ।

এথিসের উমর মুন্সী বলেন, “আপনার ফোনটিই সাধারণত আপনার সবচেয়ে কাছের জিনিস। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেবা সহজ করতে আর্থিক খাতের প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে।

“স্বচ্ছতা থাকায় তা পছন্দ করছে ছোট বিনিয়োগকারী বা গ্রাহকরা। এর মাধ্যমে অনেক কার্যক্রম চলছে। অনেক ব্যাংক এখন ফিনটেক-ভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়ে গ্রাহক বাড়াচ্ছে। গ্রাহক লক্ষ্য করেই ফিনটেকের বিক্রয় কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠছে।”

নতুন প্রজন্ম অনলাইনে বিনিয়োগ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বলে মনে করেন উমর মুন্সী, যার কোম্পানি বিকল্প অর্থায়ন এবং বিনিয়োগের সুযোগের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং কমিউনিটি পরিচালনা করে।

ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির একই গবেষণায় দেখা গেছে, ফিনটেক শিল্প ২০১০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রেকর্ড পুঁজি সংগ্রহ করেছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডিং ২০১৫ সালে ১৯.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২০ সালে ৩৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে, যা বছরে ১৭ শতাংশ বেড়েছে।

গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত, সর্বজনীনভাবে ব্যবসা করা ফিনটেক কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত বাজার মূলধন ৫৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে, যা ২০১৯ সালের দ্বিগুণ।

বিশ্বে সুকুক

ইসলামী অর্থনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সুকুক ২০০০ সালের পর থেকে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি মালয়েশিয়ায় প্রথম প্রচলন হয়। ২০০১ সালে এই পথে হাঁটে বাহরাইন। 

বর্তমান সময়ে এসে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে ইসলামি সংস্থা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একইভাবে সুকুক ব্যবহার করছে, যা বিশ্বব্যাপী বাঁধা-আয়ের (ফিক্সড ইনকাম) বাজারের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ দখল করছে।

বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ রেটিংস বলছে, সুকুক ও অন্য বন্ডের তুলনামূলক মূল্যায়ন ২০২৩ সালে প্রায় একই রকম ছিল। গত বছরজুড়েই সুকুকের মূল্য বেড়েছে। এই প্রবণতা রয়েছে ২০২৪ সালেও।

গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি), ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের ৫০ সুকুক ও বন্ডের মূল্য নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে ফিচ। তারা বলছে, ৭০ শতাংশের বেশি সুকুক সরকার থেকে জারি করা। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, সুকুক ও বন্ডগুলোর দাম ছিল চড়া। এর কারণ সেগুলোর প্রতিটির পরিপক্কতা থেকে ফলন (ওয়াইটিএম) শূন্য দশমিক ৯। 

ওয়াইটিএম হচ্ছে, প্রাথমিক ক্রয়ের তারিখ থেকে পরিপক্কতার তারিখ পর্যন্ত প্রাপ্ত মোট অর্থপ্রদানের ওপর ভিত্তি করে একটি ঋণ উপকরণের বার্ষিক রিটার্ন।

বাংলাদেশে সুকুক

সরকার ২০১৯ সালের ২৯ মে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) মাধ্যমে সুকুক বিষয়ে সর্বপ্রথম গেজেট প্রকাশ করে।

পরে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন আকারে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় সরকার কর্তৃক সুকুক ইস্যু ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত গাইড লাইন জারি করে। এই গাইডলাইন অনুসরণ করে স্পেশাল পারপাস ভেহিকল (এমপিভি) হিসেবে ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ‘ইসলামিক সিকিউরিটিজ সেকশন’ ইতোমধ্যে তিনটি সুকুক ইস্যু করেছে।

বর্তমানে ইস্যু করা সুকুকের ৮৫ শতাংশে বিনিয়োগ করতে পারে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানি। ১০ শতাংশে বিনিয়োগ করতে পারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইসলামিক শাখা ও উইন্ডোজ। বাকি ৫ শতাংশে বিনিয়োগের সুযোগ থাকে সাধারণ মানুষের। 

দেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামে প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য সর্বপ্রথম সুকুক বন্ড (ইজারা সুকুক) ইস্যু করা হয়। এ নিয়ে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সরকারের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ।

সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এই বন্ড বিক্রি করছে। 

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ থাকায় নতুন করে আবারও দুই হাজার কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদি সুকুক বন্ড বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সুকুক কেনায় উৎসাহ কিছুটা কমলেও বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোর আগ্রহে কিছু টাকা ফিরে এসেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডো ও শাখার ২০২৩ সালে নভেম্বরের বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান। এছাড়া কনভেনশনাল ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ৩ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশে ইসলামি অর্থনীতি 

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের শুরু ১৯৮৩ সালে। বাংলাদেশের প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। এই ব্যাংকটিসহ বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরে ১৫টি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ৩০টি ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা রয়েছে, এবং আরও ১৫টি ব্যাংকের ৬১৫টি ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে।

১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের রাজধানী জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী অর্থ সংস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে। ওই বছর জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চার্টার গৃহীত হয়।

বাংলাদেশ সরকার আইডিবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সেই চার্টারে স্বাক্ষর করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইসলামি ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৫.৩৫ শতাংশ ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের দখলে রয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে মোট বিনিয়োগের ২৮.৯২ শতাংশ ছিল ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের। মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। 

আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান ফিচ রেটিংসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের বাজারে বাংলাদেশ ছিল অষ্টম বৃহত্তম দেশ। এদেশের ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সম্পদমূল্য ছিল ৪৫.৩ বিলিয়ন ডলার বা ৪ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। 

শরিয়াহ সম্মত সম্পদ কোন দেশে কতটা

গ্লোবাল ফাইন্যান্সের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শরিয়াহ সম্মত সম্পদের ৯৫ শতাংশ ১০টি দেশের হাতে। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ইরানের দখলে। সৌদি আরবের হাতে রয়েছে ২৫ শতাংশ। মালয়েশিয়ার হাতে ১১ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাতে ৮ শতাংশ। কুয়েতের হাতে ৬ শতাংশ, কাতারের হাতে ৬ শতাংশ, তুরষ্কের হাতে ২.৬ শতাংশ। বাংলাদেশের হাতে ২.১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার হাতে ২ শতাংশ এবং বাহরাইনের হাতে ১.৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত