Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সংকট উত্তরণের উপায় কী

ইসলামিক ব‍্যাংকিং

চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা ইসলামিক ব্যাংকিং খাত এখন বাংলাদেশে একটি সংকটময় সময় পার করছে। একদিকে আমানত তুলে নেওয়ার চাপ, অন্যদিকে ঋণ আদায়ে ধীরগতির কারণে নিয়মিত চলতি হিসাবের ঘাটতিতে থাকছে এ খাতের ৫-৬টি ব্যাংক। 

এই সংকটের পেছনে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ব্যবসার জন্য দেওয়া নীতিমালায় কাঠামোগত সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন নীতি-নির্ধারকরাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে বলেন, “ইসলামিক ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবের ঘাটতির কারণ, ইসলামিক ব্যাংকগুলো যে ধরনের ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের মধ্যদিয়ে চলে, তাতে একটি কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে।”

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের ১৫ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে বাধ্য, যাকে বলে এসএলআর। ব্যাংকগুলোর কেনা সরকারি ট্রেজারি-বন্ড বিল এই এসএলআর হিসেবে জমা রাখা যায়। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর জন্য এসএলআর ৫ শতাংশ। তবে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর জন্য যে ধরনের বন্ড আছে এটাকে আমরা সুকুক বলি, যা কিছুকাল আগে শুরু হয়েছে, আমি তখন অর্থসচিব ছিলাম। এই মূহূর্তে যে পরিমাণ সুকুক আছে, তা ইসলামিক ব্যাংকগুলোর চাহিদার মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। তার মানে এখানে বন্ডের একটি ঘাটতি আছে।”

দেশের ব্যাংকগুলো স্বল্প সময়ের জন্য আমানত সংগ্রহ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে। ইসলামিক ব্যাংকগুলো বন্ডে বিনিয়োগ করতে না পেরে সাধারণ বিনিয়োগে চলে যায়, যা সাধারণত এক, দুই বা তিন বছর মেয়াদ থাকে। তবে আমানতকারী যে কোনও সময় টাকা তুলে নিতে গেলে ইসলামিক ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ে। 

গভর্নর বলেন, “আমানতকারীরা যখন টাকা তোলে, তখন প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো বন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দিয়ে টাকা তুলে নিতে পারে। কিন্তু ইসলামিক ব্যাংকগুলোর যেহেতু বন্ডে বিনিয়োগ কম, তারা সঙ্গে সঙ্গে টাকা পরিশোধ করতে পারে না। কিন্তু আমানতকারী তো অপেক্ষা করতে পারবে না। একারণে একটি ম্যাচুরিটি মিসম্যাচ তৈরি হয়।”

এই কাঠামোগত সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ইসলামিক ব্যাংকগুলোর কাছে যদি ৫-১০ শতাংশ বন্ড থাকত, তাহলে ব্যাংকগুলো সেই বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা দিয়ে টাকা নিয়ে যেতে পারত।”

কিন্তু তা না হওয়ায় ইসলামিক ব্যাংকগুলোকে চলতি হিসাবের ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত টাকা ধার নিতে হচ্ছে।

ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমানতকারীদের জমা টাকা সুরক্ষিত রাখতে ব্যাংকগুলোকে আমানতের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। তবে ইসলামী ব্যাংকসহ ছয়টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক চাহিদামতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সেই অর্থ জমা রাখতে পারছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা এসব ব্যাংকের চলতি হিসাব মাঝেমধ্যে বড় ঘাটতিতে পড়ছে। গত নভেম্বর শেষে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। 

দেশের ব্যাংকগুলোকে গত নভেম্বরে নগদ জমা বাবদ (সিআরআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৭১ হাজার ৫২ কোটি টাকা জমা রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো জমা রাখতে পেরেছিল ৬৫ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। তারল্য সংকটে না থাকা ব্যাংকগুলো সিআরআর বাবদ প্রয়োজনের বেশি অর্থ জমা রাখলেও সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ বাবদ ঘাটতি ছিল ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। মূলত শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংক সিআরআর বাবদ অর্থ জমা রাখতে না পারায় সার্বিকভাবে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে জরিমানাও গুণতে হচ্ছে।

তাছাড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের থেকে কমেছে। ঋণ বিতরণ সেই তুলনায় কমেনি। ফলে যে পরিমাণ আমানত আসছে, তার বড় অংশই ঋণে চলে যাচ্ছে। 

গত ৩১ জানুয়ারি সিআরআর বাবদ ইসলামী ব্যাংকের জমা রাখার কথা ছিল ৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। ওই দিন ব্যাংকটির চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। 

একই দিন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৯ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা,সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ৬ কোটি টাকা ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৩৪ কোটি টাকা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ২২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা ছিল। গত বছরের জুলাইয়ে যা কমে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকায় নেমে আসে। আগস্ট থেকে পুরো ব্যাংক খাতে ঘাটতি শুরু হয়। ওই মাসে ঘাটতি হয় ৬৯৫ কোটি টাকা। এরপর ক্রমাগত ঘাটতি বাড়তে থাকে। বর্তমানে তা বেড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এতে চাপে পড়েছে অন্য ব্যাংকগুলোও।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন বলেন, “ইসলামিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের পেছনে আস্থার সংকটও কাজ করছে। এ খাতের কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম নিয়ে নানা ধরনের খবর প্রকাশের কারণে সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা কমে গেছে। ফলে তারা অনেকেই টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রেখেছেন। একসাথে অনেক গ্রাহক টাকা তোলার চেষ্টা করায় এই তারল্য সংকট তৈরি হয়েছিল। এক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি আস্থার জায়গাটাও মেরামত করতে হবে।”

সিআরআর ঘাটতি কয়েকটি ব্যাংকের হলেও এর জন্য যে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে, তা বলেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, “বিদেশি ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা, বিদেশি ব্যাংক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ঘাটতিকে ভালো চোখে দেখে না। তারা এসব সূচক পর্যালোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। যেসব ব্যাংকের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাদের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ জরুরি।”

তবে কেবল ইসলামিক ব্যাংকগুলো না, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ধার করছে বলেও মুদ্রানীতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, বন্ড না থাকলে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও ঘাটতিতে পড়ত।

প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) ৪ শতাংশ ও এসএলআর (স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও) ১৩ শতাংশ। এর অর্থ হলো প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে এর থেকে ৪ টাকা নগদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রাখবে। এর পাশাপাশি ১৩ টাকা বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে সেই বন্ড দিয়ে এসএলআর পুরণ করবে। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সিআরআর ৪ শতাংশ এবং এসএলআর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। 

গত ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা,সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল চলতি হিসাবে। 

এই ব্যাংকগুলো নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার করে ঘাটতি পুরণের চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের আওতায় সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ। 

অথচ এর এক বছর আগে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৮ শতাংশের বেশি ছিল ইসলামিক ব্যাংক ও শাখাগুলোর হাতে। অর্থাৎ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর আমানতে অংশগ্রহণ আগের থেকে কমে এসেছে। 

ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের উদ্ভব যেভাবে

সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের বিকল্প ব্যবস্থার প্রবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ইসলামিক ধারার ব্যাংকিং নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কেননা, ইসলাম ধর্মে সুদ হারাম বা নিষিদ্ধ। কেবল এই কারণেই প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। এখাতের ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে টাকার পরিবর্তে পণ্য কিনে দিয়ে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে থাকে। সেই ব্যবসার মুনাফা ভাগাভাগির শর্তে এই ঋণ দেওয়া হয়। এ কারণে ইসলামিক ব্যাংকগুলো এই ঋণকে বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করে। 

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম এ ধরনের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক চালু হলেও এই ব্যাংকগুলোর আমানত ও বিনিয়োগের মেয়াদ পূর্তির তারতম্য ঘোচাতে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। 

ইসলামিক ব্যাংকগুলো সুদভিত্তিক ট্রেজারি বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করে না। তাই ২০২০ সালের পর দেশে প্রথমবারের মতো সুদমুক্ত সুকুক বন্ড চালু করে সরকার। এর ফলে ইসলামিক ব্যাংকগুলো তাদের সংগৃহীত আমানত এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারছে। তবে তাও এখনও পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে বর্তমানে ‘কর্জে হাসানা’ নামে এক ধরনের তারল্য সহায়তা দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তাছাড়া ডলার অদলবদল (সোয়াপ) সুবিধার ক্ষেত্রে ইসলামিক ব্যংকগুলো কোনও ধরনের সুদ দেয় না বা নেয়ও না।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৬৩ সালে মিশরে ড. আহমদ আল নাজ্জার নামের এক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে মিশরীয় বদ্বীপ শহর মিটগামারে ‘মিটগামার ব্যাংক’ নামে সুদমুক্ত একটি ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল আধুনিক বিশ্বের সর্বপ্রথম সুদবিহীন ইসলামী ব্যাংক। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ব্যাংক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

এরপর ধীরে ধীরে ইরান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েতসহ মুসলিম দেশগুলো ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকে পড়ে।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শরিয়াহসম্মত সম্পদের ৯৫ শতাংশ ১০টি দেশের হাতে। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ইরানের দখলে। সৌদি আরবের হাতে রয়েছে ২৫ শতাংশ। মালয়শিয়ার হাতে ১১ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাতে ৮ শতাংশ। কুয়েতের হাতে ৬ শতাংশ, কাতারের হাতে ৬ শতাংশ, তুরস্কের হাতে ২.৬ শতাংশ। বাংলাদেশের হাতে ২.১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার হাতে ২ শতাংশ এবং বাহারাইনের হাতে ১.৮ শতাংশ। 

গত এক দশক ধরে এই দেশগুলোতে ইসলামিক অর্থায়নের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ থেকে ১২ শতাংশ। 

জেদ্দা থেকে প্রকাশিত আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০২৪ সাল নাগাদ এই ১০টি দেশের শরিয়াহ-সম্মত সম্পদের পরিমাণ বেড়ে ৩.৫ ট্রিলয়ন ডলারে পৌছাবে। স্ট্যাট অব গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট অনুযায়ী, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে ইসলামী অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে ৪.৯ ট্রিলিয়ন ডলার।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ এই দুই বছরে ইসলামী অর্থনীতিতে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি আসবে ১০ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে সৌদি আরব ও কুয়েতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো।

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হওয়া অমুসলিম দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিঙ্গাপুর,যুক্তরাজ্য, লুক্সেমবুর্গ, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া ও আইভরি কোস্ট।

বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের শুরু যেভাবে

১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী অর্থ সংস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে এবং ওই বছর জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক’ (আইডিবি) চার্টার গৃহীত হয়। বাংলাদেশ সরকার আইডিবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সেই চার্টারে স্বাক্ষর করে।

১৯৭৫ সালে সৌদি আরবে আইডিবি যাত্রা শুরু করে এবং ওই বছরই সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘দুবাই ইসলামী ব্যাংক’ নামে একটি ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই পথ ধরে কুয়েত, সেনেগাল, বাহরাইন, পাকিস্তান, ইরান, সুইজারল্যান্ড, জর্ডান প্রভৃতি দেশে ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হয়।

‘বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং, সক্ষমতা ও সফলতার নিরিখে’ গ্রন্থে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ আবদুল মান্নান লিখেছেন, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশে ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজে অংশ নেয়।

দেশে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি উদ্যোক্তার পাশাপাশি আইডিবিসহ বিদেশি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আইডিবির সক্রিয় উদ্যোগের ফলে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ, দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক,লুক্সেমবুর্গ ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ করপোরেশন, সৌদি আরবের আল-রাজি কোম্পানি ফর কারেন্সি এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং কুয়েতের ৩টি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় ৭০ শতাংশ মূলধন জোগান দেয়। 

বাংলাদেশ সরকার ৫ শতাংশ মূলধন জোগান দেয়। বাকি ২৫ শতাংশ মূলধন জোগান দেয় স্থানীয় উদ্যোক্তারা। ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ (বর্তমানে পিএলসি) নিবন্ধিত হয়। ওই বছরের ৩০ মার্চ থেকে কার্যক্রম শুরু করে ব্যাংকটি।

আবদুল মান্নানের লেখা ওই বইটি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে শুরু থেকেই অত্যন্ত সক্রিয় ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক এ এস এম ফখরুল আহসানকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইসলামিক ব্যাংক ও ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। 

১৯৮২ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৪তম ব্যাংকার্স সভায় তৎকালীন গভর্নর নূরুল ইসলামের সভাপতিত্ত্বে দেশের তখনকার ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ২টি বিশেষায়িত ব্যাংকের মেট্রোপলিটন ও জেলা সদর শাখাগুলোতে শিগগিরই ইসলামিক ব্যাংকিং চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তের আলোকে ইসলামিক ব্যাংক পরিচালনার উপযোগী জনবল তৈরির জনশক্তি তৈরির জন্য ১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের ওপর এক মাসের জন্য একটি আবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হয়। সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল এম আযীযুল হক ওই কোর্স বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।

এছাড়া প্রকাশক ও মুদ্রাকর আবদুর রাজ্জাক লস্কর, বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ খালিদ খান, চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা আবদুল জব্বার, প্রকাশক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ও জাকীউদ্দিন আহমদ, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনুসসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির নাম জড়িয়ে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। 

এর পর ধীরে ধীরে দেশে গড়ে উঠতে শুরু করে ইসলামিক ধারার ব্যাংক। ১৯৮৭ সালে আল বারাকা ব্যাংক, ১৯৯৫ সালে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ২০০১ সালে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ১ জুলাই থেকে এক্সিম ব্যাংক এবং ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক তাদের কার্যক্রম ইসলামিক পদ্ধতিতে রূপান্তর করে। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিয়ন ব্যাংক। এরপর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ইসলামিক ধারায় চলে আসে। 

এর বাইরে ১৫টি প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ৩০টি ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা রয়েছে, এবং আরও ১৫টি ব্যাংকের ৬১৫টি ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের সবগুলো ব্যাংকের সংগৃহীত আমানতের মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অংশ ২৬ শতাংশ। তবে ঋণ বা বিনিয়োগে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ। এর আগের প্রান্তিকে এই অংশগ্রহণ ছিল ২৯ শতাংশ। মূলত কিছু ইসলামিক ব্যাংক নতুন করে ঋণ বিতরণে বাধার মুখে পড়ায় এখাতের বিনিয়োগ সেই তুলনায় বাড়ছে না। 

কৃষি খাতের মোট ঋণের মধ্যে ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে দেশে আসা রেমিটেন্সের ৫২ শতাংশই আসে ইসলামিক ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকায় কিছু ব্যাংকের ঋণ বিতরণে শর্ত দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে রেমিটেন্সে বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে ব্যাংকগুলো রেমিটেন্স আকৃষ্ট করছে। এর আগের প্রান্তিকে ইসলামীক ব্যাংকগুলোর রেমিটেন্সের হিস্যা ছিল ৩৮ শতাংশ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত