Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

ব্যাংকে মালিক-ব্যবস্থাপক দ্বন্দ্ব অবসানের উপায় কী

ব‍্যাংক মালিক-ব‍্যবস্থাপক
মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন।

২০১৬ এবং ২০১৭ সালে কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদত্যাগ করতে হয়েছিল। সেই সময়ে বিনা প্রশ্নে তাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ অনুমোদনও দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। 

কোভিড মহামারির সময় এমন পদত্যাগ কিছুটা কমে এলেও গত বছর আবার তা বাড়ে। ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতায় তিনি আবার ওই ব্যাংকে ফিরলেও বেশি দিন আর কাজ করেননি।

ওই বছরের ২৬ জুলাই পদত্যাগ করেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ বিল্লাহ আদিল চৌধুরী। তিন বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন। তবে এক বছরের মধ্যে তাকে সরতে হয়েছিল। একই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ছাড়েন তারেক রিয়াজ খান। তখনও তার চুক্তির মেয়াদ দেড় বছর বাকি ছিল। ওই মাসেই সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান পদত্যাগ করেন। তবে অল্প সময়ের মধ্যে আবার চাকরিতে ফেরেন তিনি। 

এত অল্প সময়ের ব্যবধানে চার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর পদত্যাগ নিয়ে অনেক সমালোচনা জন্ম দেয় ব্যাংক অঙ্গনে। এরপর এবছরের শুরুতেও একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। গত ২১ জানুয়ারি এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ ছাড়েন মামুন মাহমুদ শাহ। এরপর গত ৩ মার্চ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের হাবিবুর রহমানকেও পদত্যাগ করতে হয়। 

ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণ লেখা থাকলেও মালিক পক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই তাদের সরতে হয় বলে আলোচনা রয়েছে। 

ব্যাংকে দুটি কর্তৃপক্ষ থাকে। একটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, যা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত। অন্যটি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, যাদের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। 

ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতে উদ্যোক্তাদের মধ্যে থেকে পর্ষদের সদস্য নির্বাচন করা হয়। তারা ব্যাংক পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে যে ধরনের নির্দেশনা দেন, সেভাবেই ব্যাংক চলে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় থাকা শীর্ষ নির্বাহী থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন পর্যায়ের কর্মীর সমন্বয়ে গঠিত হয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এই দুই কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে একটি ব্যাংক পরিচালিত হয়।

এর মধ্যে ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের ভূমিকা হলো তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেন। তবে আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকাই এই ব্যাংকগুলোর বড় পুঁজি। এ কারণে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় যারা থাকেন, তাদের মূল দায়িত্ব থাকে আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে ব্যবসা এনে দেওয়া, উভয় পক্ষের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা করে দেওয়া। 

তবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যেহেতু সরাসরি পর্ষদ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত, সেহেতু তাদের পর্ষদের নেতৃত্ব মেনে চলতে হয়। ফলে যখন ব্যাংকের পরিচালকরা আমানতকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কিছু করতে চান, তখন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধার মতো ঘটনা ঘটে। 

ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব আমাতনকারী বা সাধারণ মানুষের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ তারা এক ধরনের ট্রাস্টির ভূমিকায় থাকেন। আর এই ক্ষেত্রে নীতিমালা দিয়ে সহযোগিতা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দীর্ঘ দিনের চর্চা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এখাতে পরিচালকদের ভুল নেতৃত্ব অনেক সময় ব্যাংক খাতে বিপদ ডেকে এনেছে। আমানতকারীদের স্বার্থ বিপন্ন করে তুলেছে। আবার পর্ষদের যোগ্য নেতৃত্ব অনেক ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেক শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। 

পরিচালকদের ভুল পথ থেকে ফেরাতে অনেক ক্ষেত্রে সফল হয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিফলও হয়। আবার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষে থেকে কেউ কেউ পরিচালকদের অনিয়ম-দুনীর্তিতে সায় দিয়ে নিজের আখের গোছাতে চেষ্টা করেছে, এমন উদাহরণও পাওয়া যায়। আমানতকারীর স্বার্থ দেখার পাশাপাশি নিজের ক্যারিয়ারে কালিমা লেপন না করে ব্যাংকের উচ্চ পদের মতো আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো সৎ কর্মকর্তাও পাওয়া যাবে। 

দেশের নামকরা বেশ কয়েকটি ব্যাংকে দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করে বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন এমন কয়েকজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডির সঙ্গে কথা বলে এমন ধারনাই পাওয়া যায়।

তারা জানান, ব্যাংক খাতের জন্য এটা এমন একটি সমস্যা, যা অনেক বড় ক্ষতি বয়ে আনলেও তা সমাধান করা কঠিন। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে শুরু করে অর্থের দাপটসহ অনেক সমস্যা রয়েছে। আর ব্যাংকের শীর্ষ পদে থেকে এই লড়াই করতে গিয়ে বিপদে পড়ে শীর্ষ নির্বাহীরা। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করছে

ব্যাংক নির্বাহীদের অপ্রত্যাশিত পদত্যাগ বা চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে ২০১৪ সালে একটি সুরক্ষা নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালার পেছনের কারণ ছিল একটি বেসরকারি ব্যাংক। তখন ব্যাংকটিতে কোনও এমডি টিকতে পারছিলেন না। এমন প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেয়, কেউ ব্যাংকের এমডির চাকরি ছাড়তে চাইলে এক মাস আগে নোটিস দিতে হবে। আবার পর্ষদ কাউকে বাদ দিতে চাইলেও এক মাস আগে জানাতে হবে। উভয় ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। 

তবে এই সুরক্ষা নীতিমালা কোনও কাজে আসেনি। গত ৩ মার্চ এই নীতিমালা জারির দিনই স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডির পদ ছাড়তে হয় মো. হাবিবুর রহমানকে। 

গত কয়েক বছরের পদত্যাগের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জোর করে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ অনুমোদনে রাজি না করাতে পেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এমডিদের। 

মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক সময় ব্যাংকের পর্ষদ এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে এমডির পক্ষে আর কাজ করা সম্ভবপর হয় না। সেটা অনেক কারণে হতে পারে। এমন হতে পারে যে এমডি পর্ষদের উদ্দেশ্য হাসিল করে দিচ্ছে না। তখন পর্ষদ চায় না এমডি চাকরিটা চালিয়ে যাক। তখন তাকে চাকরি ছেড়ে চলে যেতেই হয়।”

এক সময়ে সিটি ব্যাংক এনএ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সবশেষ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে কাজ করেছেন রাশেদ মাকসুদ খান। বর্তমানে তিনি একটি বিদেশি সংস্থায় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “সব ব্যাংক নয়, তবে অনেক ব্যাংকের পরিচালকরা এধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। তাদের কারণে ব্যাংকের যারা ব্যবস্থাপনায় থাকেন তাদের কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক ভালো ও দক্ষ এমডিও পরিচালকদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এটা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর। এভাবে চলতে থাকলে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তাই হতাশ হয়ে পড়বেন।”

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের এমডিদের ঠিকভাবে কাজ করতে না দেওয়ার ফলেই ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছে না। অনেক ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনেও এই কারণটি দায়ী। তাছাড়া চাকরি ছেড়েও ব্যাংক এমডিদের নিস্তার থাকে না। চাকরি ছাড়ার পর অনেক অনিয়মের দায় এমডির কাঁধে চাপানো হয়। এই পরিস্থিতিটা ভালো নয়। এটা ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে। 

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ব্যাংকের পরিচালকরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেন না ব্যাংক নির্বাহীরা। এক পর্যায়ে নতি শিকার করতে বাধ্য হন। 

নূরুল আমিন দেশের বেশ কয়েকটি বড় ব্যাংকে ৩২ বছরেরও বেশি সময় কাজ করেছেন। এমডি ছিলেন একাধিক ব্যাংকে। মেঘনা ব্যাংকের এমডির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন ২০১৭ সালের নভেম্বরে।

তিনি বলেন, “ব্যাংক পরিচালনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে। এমডি ও পর্ষদের কে কতটুকু কাজ করতে পারবেন, কার কতটুকু ক্ষমতা, তা সুনির্দিষ্ট করা আছে। এটি কার্যকর করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। তা না হলে এমডিরা কাজ করতে পারবেন না।” 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত