বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংক বাড়তে বাড়তে ৬১টি হয়েছে, তবে এর কয়েকটি এখন খাবি খাচ্ছে। ব্যাংক খাতের সার্বিক দুরবস্থার মধ্যে দুর্বল এই ব্যাংকগুলো সংকট বাড়িয়ে দিতে পারে, এমন শঙ্কা রয়েছে। তাই সমস্যা সমাধানে একীভূতকরণকে দাওয়াই ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনাও হয়েছে। তবে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হলেও কাজটি করা সম্ভব হলে ব্যাংক খাতের জন্য তা ভালো ফল দেবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
ঋণ বিতরণে আগ্রাসী মনোভাব, অনিয়মের ফলে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, নিয়মিত মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন সূচকে নাজুক হয়ে পড়া কয়েকটি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এধরনের দুর্বল ব্যাংক বসে পড়লে আমানতকারীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়াসহ এই খাত বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে বলে এগুলোকে নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।
তাছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত ও অধিগ্রহণ (মার্জার অ্যান্ড একুজিশন) করার পর্যাপ্ত আইনি কাঠামোও ছিল না দেশে। একারণে দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূত করার বিষয়টিও কেবল আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পুঞ্জীভূত এই সংকট এখন বড় আকার ধারণ করেছে। একারণে দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ না করে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক রোডম্যাপে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার কর্মপরিকল্পনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নে অন্তত তিনটি সুফল পাওয়া যাবে বলে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত, দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনায় ভালো ব্যাংকের পরিচালকরা এলে পর্ষদ শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর হবে। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক ব্যয় কমে আসবে।
তবে এই প্রক্রিয়ায় একীভূত করা কোনও দুর্বল ব্যাংকের কর্মীদের যাতে চাকরি হারাতে না হয়, সে লক্ষ্যে কিছু শর্তও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে একটি শর্ত থাকবে, প্রথম ৩ বছরে দুর্বল ব্যাংকগুলোর কোনও কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।
একীভূত দুর্বল ব্যাংকের কোনও কর্মীকে ৩ বছরের মধ্যে ছাঁটাই করা যাবে না, বলা আছে রোডম্যাপে
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াটি সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার না হলে আবারও কোনও না কোনও ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। নজর দিতে হবে সেদিকে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমীন বলেন, মার্জার অ্যান্ড একুইজিশন বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত পন্থা। বিভিন্ন দেশে নিত্যনৈমিত্তিক এটা হচ্ছে। বাংলাদেশে এটা অনেক কম। শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত হয়ে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক হয়েছিল। এটাও সরকারের একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে হয়েছিল। এরপরে ব্যাংকের মার্জার বা একিউজিশন আর খুব একটা হয়নি।
সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দুর্বল ব্যাংককে বাঁচানো গেলে তা ব্যাংকের কর্মী এবং আমানতকারীদের জন্য ভালো: নুরুল আমীন
একীভূত করার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন যে উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিক আছে। যদি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দুর্বল ব্যাংককে বাঁচানো যায়, সেটা ব্যাংকের কর্মী এবং আমানতকারীদের জন্য ভালো হবে। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু একীভূত করার উদাহরণ খুব একটা নাই, সেহেতু কিছু আশঙ্কা থাকবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোই এই আশঙ্কা বেশি করবে। সেটা হলো, এই ব্যাংকগুলোর কর্মীদের চাকরি থাকবে কি না? তাদের গ্রাহকদের কী হবে? দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকরা সবল ব্যাংকের পরিচালনায় কীভাবে থাকবেন? সবাই থাকবেন, না কি আংশিক থাকবেন? বাকি পরিচালকদের কী হবে? এরকম অনেক আশঙ্কা থেকে যাবে।”
এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে নূরুল আমীন বলেন, “কোন দুর্বল ব্যাংক কোন সবল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ হবে, সেই সিদ্ধান্তটা কে নেবে আর কিসের ভিত্তিতে নেবে? সেই পদ্ধতিটা এখনও স্পষ্ট না। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে বসতে হবে এবং সবল ব্যাংকগুলোকে বলতে হবে, তোমরা নিজেরাই পছন্দ করতে পার, কোন দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করবে। তাহলে সবার জন্য এটা ভালো।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থান নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “দুর্বল ব্যাংকগুলোর এমডি থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাকরি কীভাবে সংস্থান করা হবে, সে বিষয়ে খুব স্বচ্ছ পদক্ষেপ থাকতে হবে।”
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং সবল ব্যাংকগুলোকে চেপে ধরার চেষ্টা বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। এই নীতি ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়েও সংশয়ী তিনি।
আহসান মনসুর বলেন, “কোনও সবল ব্যাংককে চাপ দিয়ে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলে সবল ব্যাংকগুলোও অস্বস্তিতে পড়তে পারে। ব্যাংকগুলোকে নিজেদের ব্যবসার গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী এ ধরনের মার্জারে যাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিতে দিতে হবে।”
তার মতে, যেসব ব্যাংকের সূচক খারাপ ও তারল্যে ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে তা চালানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এসব ব্যাংকে নিরপেক্ষ নিরীক্ষা করাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে বা দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই নিরীক্ষা করাতে পারে। নিরীক্ষায় যে পরিমাণ লোকসানের তথ্য পাওয়া যাবে, তা সরকারকে বাজেট থেকে সহায়তা দিতে হবে।
চাপ দিয়ে একীভূত করালে সবল ব্যাংকগুলোও অস্বস্তিতে পড়তে পারে: আহসান এইচ মনসুর
আহসান মনসুর বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। কেবল আন্তঃব্যাংক ও সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ রাখতে হবে। কিছু শাখাও বন্ধ করে খরচ কমিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। আর এসব কার্যক্রম চালাতে হবে ধাপে ধাপে। এতে ৩-৫ বছর সময় লেগে যাবে।
তবে প্রক্রিয়াটি এখনই শুরু করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা এতটাই গুরুতর যে তাদের সময় দেওয়া ঠিক হবে না। এই প্রক্রিয়ায় দুর্বল ব্যাংকগুলো লোকসান থেকে বের হয়ে আসলে একীভূত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
দুর্বল ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পুরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও একটি তহবিল সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রাখছেন আহসান মনসুর। তবে সেই তহবিলের সুবিধা দিয়ে যেন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়। ব্যাংকের মূলধন পুরণের জন্য দিলে আগে যা ছিল তাই ঘটবে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটিয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে একটি নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বলা হয়, যেসব ব্যাংক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে না, তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ থেকে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক কার্যকর করার কথা বলেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ২০২৫ সালের মার্চের আগে কোনও ব্যাংক সেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে তা করতে পারবে। তবে কোনো ব্যাংককে একীভূত হতে বাধ্য করা হবে না।
এই সময়ের আগে কোনও দুর্বল ব্যাংক সবল হয়ে উঠলে সেই ব্যাংককে আর একীভূত হতে হবে না। দুর্বল কাটিয়ে ব্যাংকগুলো সবল হতে চেষ্টা করলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতি সহায়তা দেবে।
খুব শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত করার নীতিমালা আরও স্পষ্ট করবে বলেও জানা গেছে৷ ওই নীতিমালা অনুযায়ী দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে মূল্যায়ন করা হবে৷
দুর্বল ব্যাংক কোনগুলো, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলধন ঘাটতিতে আছে এমন ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও উচ্চ মাত্রায় খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকটসহ আরও বেশ কিছু সূচকের দুর্বলতার ভিত্তিতে একটি ব্যাংককে দুর্বল বা সবল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
যে ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোকে বর্তমানে মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের (রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট) ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেই পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেসব ব্যাংক এ নীতিমালা অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারে না, সেসব ব্যাংককে মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংক শেয়ারধারীদের কোনও লভ্যাংশ দিতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের সরকারি- বেসরকারি ১৪টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ছিল। এই ঘাটতির মোট পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৫০৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
তার তিন মাস আগে এই ঘাটতি ছিল ৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৩ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।
সরকারি-বেসরকারি কোন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কত
সরকারি ব্যাংক | ঘাটতি (কোটি টাকা) | বেসরকারি ব্যাংক | ঘাটতি (কোটি টাকা) |
---|---|---|---|
কৃষি ব্যাংক | ১৫,৮০৪ | ন্যাশনাল ব্যাংক | ২,০২৪ |
অগ্রণী ব্যাংক | ৪,৮২৯ | আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক | ১,৮২৩ |
বেসিক ব্যাংক | ৩,১৫০ | কমার্স ব্যাংক | ১,৪০২ |
জনতা ব্যাংক | ৩.০৩০ | পদ্মা ব্যাংক | ৬০৮ |
রূপালী ব্যাংক | ২,১২২ | সিটিজেন ব্যাংক | ৯৫ |
রাকাব | ২,৪৭২ | বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক | ৭১ |
ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির মূল কারণ হিসাবে খেলাপি ঋণকে চিহ্নিত করছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ আদায় কমে গেলে এর বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। আর ব্যাংকের মুনাফা থেকে এই প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে। মুনাফা থেকে না পারলে মূলধন থেকে তা কর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূলধন না থাকলে প্রভিশন রাখতে গিয়ে ঘাটতিতে পড়তে হয় ব্যাংককে।”
এছাড়া আমানতের তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করেও কিছু ব্যাংক বিপাকে পড়েছে। কারণ কিছুদিন আগে আমানত তোলার চাপ বেড়ে গিয়েছিল। সেই তুলনায় ঋণের আদায় কম হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে ধার করে টাকা পরিশোধ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এসব কারণেও অনেক ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দেয়।
মাহবুবুর মনে করেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে কিছু ব্যাংকের ব্যয় কমবে। তখন দুটি বা তিনটি ব্যাংক মিলে যদি একটি ব্যাংক গঠিত হয়, তখন তাদের একটি প্রধান কার্যালয় অফিস দিয়েই কাজ হবে। তিনি বলেন, “আগে লাগত ৩টি হেড অফিস। একই জায়গায় তিনটি শাখা থাকলে একটি রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়া যাবে। তাতে কর্মী সংখ্যাও কমে আসবে। এই কর্মীদের চাকরিচ্যুত না করে অন্য কাজে লাগালে ঋণ বিতরণ ও আমানত সংগ্রহও বাড়তে পারে। তবে যেসব ভুলগুলোর কারণে অতীতে ব্যাংকটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল সেই ভুল আর করা যাবে না। অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে এই উদ্যোগ থেকে ভালো ফল পাওয়া যাবে।”
খেলাপি ঋণ কোন ব্যাংকে কত
বর্তমানে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে আলোচনায় রয়েছে পদ্মা ব্যাংক। এই ব্যাংকটি দিয়েই দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা শুরু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এমন ধারণা প্রবল। এই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা।
বেসরকারি কোন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কত
ব্যাংকের নাম | খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা) |
---|---|
ন্যাশনাল ব্যাংক | ১২,৩৬৮ |
ইসলামী ব্যাংক | ৬,৯১৮ |
এবি ব্যাংক | ৫,২৭২ |
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক | ৩,০৮৬ |
আইএফআইসি ব্যাংক | ২,৫৮৯ |
ইউসিবি | ২,৫০০ |
ওয়ান ব্যাংক | ২,৪৩৮ |
ফার্স্ট-সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক | ২,১৪১ |
সাউথইস্ট ব্যাংক | ১,৯৬৫ |
ব্র্যাক ব্যাংক | ১,৭৫০ |
ট্রাস্ট ব্যাংক | ১,৭১২ |
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক | ১,৬৮৯ |
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক | ১,৬৭৬ |
সোশাল ইসলামী ব্যাংক | ১,৬৪৪ |
এক্সিম ব্যাংক | ১,৬২৯ |
ব্যাংক এশিয়া | ১,৫৯৭ |
পূবালী ব্যাংক | ১,৩৯৩ |
সিটি ব্যাংক | ১,৩৮২ |
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক | ১,৩৫৭ |
মার্কেন্টাইল ব্যাংক | ১,২৪৮ |
কমার্স ব্যাংক | ১,২০৮ |
প্রিমিয়ার ব্যাংক | ১,১২১ |
এনসিসি ব্যাংক | ১,০৯৪ |
ইস্টার্ন ব্যাংক | ১,০৮৫ |
প্রাইম ব্যাংক | ১,০৪৯ |
উত্তরা ব্যাংক | ৯৮৪ |
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক | ৯৩২ |
ঢাকা ব্যাংক | ৯১২ |
ইউনিয়ন ব্যাংক | ৮৪৩ |
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক | ৬৮৬ |
যমুনা ব্যাংক | ৬২৯ |
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর কার খেলাপি ঋণ কত
ব্যাংকের নাম | খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা) |
---|---|
অগ্রণী ব্যাংক | ১৮,০৯৫ |
জনতা ব্যাংক | ১৭,৫০১ |
সোনালী ব্যাংক | ১৩,১৫০ |
বেসিক ব্যাংক | ৮,৪০২ |
রূপালী ব্যাংক | ৭,৮৪৭ |
কৃষি ব্যাংক | ৩,৯৮০ |
রাকাব | ১,৫৩৪ |
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক | ৯৮২ |
দুর্বলতার জন্য দায়ী অসুস্থ প্রতিযোগিতা
২০০৯-২০১৪ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় এক ডজন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। এই ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই রাজনৈতিক প্রভাব থেকে অনুমোদন বের করে নেন। এই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক।
এর মধ্যে ২০১৩ সালে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, ফারমার্স (পদ্মা) ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, সাউথবাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (পরিবর্তিত নাম) চালু হয়। ২০১৬ সালে সীমান্ত ব্যাংক, ২০১৯ সালে কমিউনিটি ব্যাংক, ২০২০ সালে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক চালু হয়।
বর্তমানে ৬১টি ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১১ হাজার ২২৪টি। এর মধ্যে গ্রামে ৫ হাজার ২৯৭টি এবং শহরে ৫ হাজার ৯৮৭টি। অর্থাৎ শহরে ব্যাংকের শাখার সংখ্যা কিছুটা বেশি।
এখন চলছে ডিজিটাল ব্যাংকের নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া। তাতে থাকবে না কোনো শাখার সীমাবদ্ধতা। দেশের যে কোনও এলাকার গ্রাহকই ইন্টারনেট ব্যবহার করে এই ব্যাংকের সুবিধা নিতে পারবেন।
নতুন ব্যাংকের অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় থেকেই দেশে নতুন ব্যাংকের দরকার আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সে সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এত ব্যাংক দরকার আছে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, দেশে এখনও ব্যাংক শাখার সংখ্যা অপ্রতুল। সেই দিক থেকে দেশে আরও ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আছে।
এবিষয়ে সাবেক ব্যাংক নির্বাহী নূরুল আমীন বলেন, “নতুন ব্যাংকগুলো যখন অনুমোদন দেওয়া হচ্ছিল,তখনও আমরা বলেছিলাম ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে কোনও সমস্যা হবে না। কারণ ব্যাংকের শাখা এখনও অপ্রতুল। তবে এক জায়গায় অনেকগুলো ব্যাংকের শাখা খোলাটা কিছুটা বিপজ্জনক। কিন্তু ব্যাংক তো ব্যবসা করতে বসবে। সে যেখানে তার গ্রাহক বেশি পাবে সেখানেই যাবে। আমরা তো ব্যাংকের শাখা খুলতাম বাজারকে কেন্দ্র করে।”
সমস্যার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “বেশি ব্যাংক হওয়ায় যে সমস্যাটা হয়েছে, আমানত নিয়ে কাড়াকাড়ি দেখা গেছে। আবার এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের ঋণ কিনে নেওয়ার প্রবণতাও শুরু হয়েছিল। ফলে সব কিছু মিলিয়ে কিছু নতুন ব্যাংকও সংকটে পড়েছে। তবে নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে যারা ভালো ব্যবস্থাপনা বজায় রাখতে পেরেছে তারা কিন্তু ভালো করছে।”
পদ্মা ও এক্সিম একীভূত
চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক বড় অঙ্কের দেনায় ডু্বে যাওয়ায় ব্যাংকটি শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মিলছে। গত ১৮ মার্চ ব্যাংক দুটোর মধ্যে এনিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকেই একীভূতকরণ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
দুটো ব্যাংক মিলে এক্সিম নামেই চলবে বলে জানানো হয়েছে। তাহলে ব্যাংকটির আমানতকারীদের কী হবে?শেয়ারধারীদের কী হবে?
এ বিষয়ে এক্সিম ব্যাংক চেয়ারম্যান বলেন, “অডিট ফার্ম দিয়ে আমরা ভ্যালুয়েশন করে দেখবো পদ্মা ব্যাংকের প্রকৃত দায়-দেনা কত। এরপর চূড়ান্তভাবে পদ্মা ব্যাংক এক্সিমের সঙ্গে একীভূত হলে পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীরা তাদের টাকা তুলতে পারবেন। এজন্য হয়ত মাস খানেক সময় লাগবে।”
শেয়ার গ্রহীতাদের বিষয়ে নজরুল মজুমদার বলেন, আমানতকারীদের মতো শেয়ারগ্রহীতাদেরও শেয়ারের মূল্য নির্ধারন করে দেওয়া হবে। এরপর ওই শেয়ারগ্রহীতা চাইলে শেয়ার রাখতেও পারেন, চাইলে শেয়ার বিক্রি করে চলেও যেতে পারেন।
পদ্মা ব্যাংকে ৮০০ থেকে ১১শ’র মতো কর্মী রয়েছেন। তাদের কারও চাকরি যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
পদ্মা ব্যাংকের শেয়ারগ্রহীতা পরিচালক হিসেবে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন তারেক রিয়াজ খান। তার কী হবে- সেই প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়নি।
নজরুল মজুমদার বলেন, “পদ্মা ও এক্সিম উভয় ব্যাংকের এমডিই খুবই অনন্যসাধারণ। আমরা চেষ্টা করব দুজনের দক্ষতাই কাজে লাগাতে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”