Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

যাদের টাকায় চলে ব্যাংক, তাদের কথা কতটা শোনে

যাদের টাকায় চলে ব‍্যাংক

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাংকিং সেবাকে করে তুলেছে দ্রুততর। এখন ঘরে বসেই পাওয়া যাচ্ছে অনেক সেবা। এ কারণে অনেক আমানতকারী বা গ্রাহককে হয়ত বছরে একবারের জন্যও ব্যাংকে যেতে হয় না।

তাছাড়া দেশে পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য বিনিয়োগের তুলনায় ব্যাংক আমানতের ঝুঁকি কম। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় সুদ বা মুনাফার হার কম হলেও ব্যাংকের ওপর ভরসা রাখতে দেখা যায় আমানতকারীদের। 

আবার ব্যাংকের শাখাগুলোও এখন আগের থেকে চকচকে-ঝকঝকে। বড় গ্রাহকদের জন্য রয়েছে প্রায়োরিটি ব্যাংকিং সুবিধা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ব্যাংকের এ ধরনের বড় শাখাগুলো গড়ে উঠছে। ভবন মালিকরাও বেশি ভাড়ার আশায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়াটিয়া হিসেবে প্রত্যাশা করে ‘টু-লেট’ এ লিখে রাখে- ‘ব্যাংক-বিমার জন্য অফিস ভাড়া দেওয়া হবে’।

ফলে সার্বিক পরিস্থিতি ঈঙ্গিত করে ব্যাংক ব্যবসা এখন অনেক বেশি আর্কষণীয়। এ কারণে হয়ত বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর ঝোঁক ব্যাংক ব্যবসায়। 

আমানতকারীদের টাকায় ব্যাংকের ব্যবসা এমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠলেও তারা থেকে যাচ্ছেন আড়ালে। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবীব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যাংক ব্যবসার সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসার মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য ব্যবসায় মালিক থাকে একটি পক্ষ, যারা পুঁজি বিনিয়োগ করে। ব্যাংকের ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করে দুটি পক্ষ। একটি পক্ষ শেয়ারহোল্ডার, অন্য পক্ষটি হলো আমানতকারী। এখানে বড় আমানতকারীদের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র আমানতকারীরা। তাদেরকে আমরা ‘কোর ডিপোজিটর’ বলি। তাদের টাকাই কিন্তু বেশি।”

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের দুটি মালিক পক্ষই ঝুঁকি নিয়ে থাকে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঝুঁকি নিয়ে ঋণ বিতরণ করে। এই টাকা আদায় না হলে শেয়ারহোল্ডারও বিপাকে পড়ে। তবে আমানতকারীরাই সব চেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। কারণ ব্যাংক কর্মকর্তারাও মালিকপক্ষ হিসেবে বেশি ‍গুরুত্ব দেয় শেয়ার হোল্ডারদের। আমানতকারীদের স্বার্থের বিষয়টি তাদের অগ্রাধিকারে থাকে না।

আইপিডিসি’র স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই অধ্যাপক বলেন, “আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার প্রাথমিক দায়িত্ব ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের, যাদেরকে আমরা এজেন্ট বলি। কিন্তু তারা শেয়ারহোল্ডারকেই সবসময় মালিক মনে করে এবং তাদের স্বার্থই আগে দেখার চেষ্টা করে। একারণে আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ পর্যন্ত না আমানতকারীদেরকে মালিক বলে মনে না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আমানতকারীর স্বার্থ সঠিকভাবে দেখতে পারবে না। কারণ তারা সরাসরি ব্যাংক পরিচালনা করে না, ব্যাংকের পরিচালনায় নীতি-কাঠামো দিয়ে থাকে। তদারকি বা নজরদারির কাজ করে থাকে। সেই নজরদারীর ফাঁক গলে ব্যাংক অনিয়ম করে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু ততক্ষণে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন আমানতকারীরা।”

আহসান হাবীব বলেন, আমানতকারীরা অন্ধের মতো ব্যাংকে গিয়ে টাকা রেখে আসেন। এ কারণে তাদের টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ কাঠামো থাকতে হবে। তা না হলে তাদের আস্থায় ফাটল ধরবে। 

ঢাকার বারিধারার একটি বেসরকারি ব্যাংক শাখায় মাসিক সঞ্চয়ী আমানত স্কিম রয়েছে আবদুল কাদেরের। সংসার খরচের থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে জমা রাখেন সেই স্কিমে। এ জন্য প্রতি মাসে একবার ব্যাংকে যান, সারি ধরে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দেন। কখনও প্রয়োজনে স্কিম ভাঙাতে হলেও তাকে কোনও বেগ পেতে হয় না। ব্যাংকের নির্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেই টাকা তুলে নিতে পারেন। ফলে ব্যাংকের সঙ্গে এর থেকে বেশি যোগাযোগের দরকার হয় না তার।

কাদেরের মতো বেশির ভাগ আমানতকারীকে ব্যাংকের শাখা ছাড়া আর কিছুই চেনার দরকার হয় না। আবার ব্যাংকেরও তাদের আমানতকারীদের ডেকে এক কাপ চা খেতে বলতে হয় না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যরত ৬১টি ব্যাংকে খোলা আমানত হিসাব ছিল প্রায় ১৫ কোটি। প্রতিটি হিসাবে গড় জমার পরিমাণ ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। মোট আমানত ছিল ১৭ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। 

অন্যদিকে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য এর শেয়ারহোল্ডারদের মোট ৫০০ কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়। এই পুঁজি দিয়ে তারা লাখ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে ব্যবসা করতে পারেন। এই টাকা সঠিকভাবে বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে আমানতকারীর মুনাফার বিষয়টি।

দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের আমানতকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের জন্য বছরে একটি দিনও কোনও আয়োজন করে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এমনকি দেশের ব্যাংকিং বিধি-বিধান অনুযায়ী আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা কতটুকু পালন করা হচ্ছে সে বিষয়টি নিয়েও অন্ধকারে থাকেন আমানতকারীরা। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার মতো সংগঠিতও নন আমানতকারীরা। 

বিআইবিএম অধ্যাপক আহসান হাবীব বলেন, ব্যাংকগুলোকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ম-নীতি(কমপ্লায়েন্স) মেনে চলতে হবে। এ জন্য আমানতকারীদেরও সচেতনতা বৃদ্ধির দরকার আছে। আর এই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কোনও সংগঠনের দরকার নেই। কারণ, সংগঠন করতে গেলেই সেখানে আরেক ধরনের নেতৃত্ব দেখা যাবে যারা ঘুরেফিরে শেয়ারহোল্ডারদের দলে গিয়ে ভিড়বে। এ কারণে আমানতকারীদের মধ্যে আর্থিক স্বাক্ষরতা বা সচেতনতা (ফ্যাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বা অ্যাওয়ারনেস) বৃদ্ধির জন্য সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকে ‘ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি’ নিয়ে কোনও অধ্যায় থাকে না। এ কারণে অনেক বিষয়ে ভুল ধারণা থেকে যায়। আমরা বলি সরকারি ব্যাংক বা বেসরকারি ব্যাংক। কিন্তু উভয় খাতের ব্যাংকই জনগণের আমানত নিয়ে কাজ করে। এভাবে বলাটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? এটা হওয়ার কথা ছিল সরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক। এই ধরনের সচেতনতা গড়ে না উঠলে আমানতকারীদের স্বার্থ কখনওই পুরোপুরিভাবে রক্ষা হবে না।”

আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা সঠিকভাবে না দেখার কারণেই ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন বিআইবিএমের এই অধ্যাপক। তার ভাষ্যে, “আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে চাচ্ছে না বলেই তো এই সংকট হচ্ছে।”

আমানতকারীদের অভিযোগ, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জালিয়াতির কারণে অনেক ঋণ আদায় হয় না। ব্যাংকের শাখায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, সাজ-সজ্জা, দামি গাড়ি ব্যবহার করে। যে আমানতকারীদের টাকায় এত বিলাসী আচরণ ব্যাংকের, সেই আমানতকারীদেরকে যৌক্তিক মুনাফা দিতেও কার্পণ্য দেখা যায়।

অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের কক্ষে বসে আপ্যায়িত হন ঋণখেলাপিরা। কিন্তু আমানতকারীরা সেই আতিথিয়তা পান না। 

আমানতকারীদের সঙ্গে কথা বলে এমন আরও অনেক ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়। 

আবার ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কারণে প্রকৃত রিটার্ন বা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যান আমানতকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য ঘাটতি প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিদিন ব্যাংকগুলো রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার নিচ্ছে। এছাড়া বিশেষ তারল্য সুবিধার মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ধার করে চলছে এই ব্যাংকগুলো। 

তাছাড়া উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ৮-৯টি ব্যাংকের প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতিতে থাকছে নিয়মিতভাবে। 

ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে আমানতকারীদের উপেক্ষা

২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে ব্যাংক খাতের আমানতের সুদহার কমিয়ে আনতে শুরু করে ব্যাংক। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে গিয়ে আমানতকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ব্যাংকের আমানতের সুদহার নামিয়ে আনা হয় ৬ শতাংশে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে এসে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। ফলে আবারও আমানতের সুদহার বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে মেয়াদি আমানত সাড়ে ৮ শতাংশ বা তার থেকেও কিছু বেশি সুদ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশের ৫২ শতাংশ আমানতই ঢাকা জেলার ব্যাংক শাখাগুলোতে জমা আছে। সেই হিসেবে সবচেয়ে বড় অংশের আমানতকারীরা এই জেলার ব্যাংক শাখাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজধানী হিসেবে এই জেলার ব্যাংক শাখাগুলোর গ্রাহক যেমন বেশি, তেমনি সেবা নিয়ে অসন্তোষও বেশি। বিভিন্ন সময়ে কোনও নোটিস ছাড়াই এটিএম সেবা বন্ধের কারণে টাকা তুলতে সমস্যায় পড়েন আমানতকারীরা।

তাছাড়া জাল-জালিয়াত বা ব্যাংক কর্মকর্তাদের অসততার কারণে আমানতকারীদের টাকা খোয়ানোর অভিযোগও পাওয়া যায় সময়ে সময়ে। তবে এ সমস্যা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নজরদারির ঘাটতির কারণে দেখা দেয়। 

আমানতকারীদের প্রত্যক্ষ সুরক্ষার কী ব্যবস্থা?

বাংলাদেশ ব্যাংকে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি স্কিম আছে। আমানত বিমা স্কিমের আওতায় ব্যাংকের আমানতকারীদের ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা দ্বারা আচ্ছাদিত আছে। তহবিল সংকটের কারণে কোনও ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে ওই ব্যাংকের আমানতকারীদের এই বিমা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আর ব্যাংক খাতের ৯৫-৯৬ শতাংশ আমানতকারীর আমানত ২ লাখ টাকার মধ্যে। ফলে ব্যাংকের বেশিরভাগ আমানতকারীর এই সুরক্ষার মধ্যে রয়েছে। 

এছাড়া আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকের সকল ধরনের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে চেষ্টা করে। তাছাড়া ব্যাংক যাতে আমানতকারীর অর্থ অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় না করতে পারে, সেজন্য শাখা পর্যায়ে ব্যয়ের সীমাও নির্ধারণ করে দেয়। 

তবে ব্যাংক ভেদে অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীরা সুদ বা মুনাফা প্রাপ্তিতে বৈষম্যের শিকার হন। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা ব্যাংক তুলনামূলক বেশি সুদে যখন আমানত সংগ্রহ করে, তখন পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে অনেক আমানতকারীই কম সুদ পেয়ে থাকেন।

এ বিষয়ে তৌহিদুল ইসলাম নামের এক আমানতকারী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক দিন ধরে একটি ব্যাংকে আমানত ছিল। সম্প্রতি কিছু সুদহার বেড়েছে। তবে অন্য ব্যাংক এর থেকে বেশি সুদ দিচ্ছে। কিন্তু এতেদিন যে ব্যাংকে আমানত রাখলাম তারা সুদ আর বাড়াবে না বলে অন্য ব্যাংকে চলে গেলাম।”

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যাংকের মালিকরা যে কোনও পুঁজি বিনিয়োগ করে না, তা নয়। তবে ৯০ শতাংশের বেশি পুঁজি আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে। ব্যাংক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে আমানতকারীদের স্বার্থ দেখতে হবে সবার আগে। এ কারণে আমরা ব্যাংকাররা সবার আগে আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার দিকে নজর দিই। কিছু কিছু ব্যাংক হয়ত সঠিকভাবে বিষয়টির দিকে নজর দিচ্ছে না। তবে সামগ্রিক ব্যাংক খাতে যে এমনটা ঘটছে তা নয়।”

ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্য থেকে খাতটিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করে। তবে দেশের অর্থনীতির ব্যাপকার সঙ্গে বেড়ে ওঠা ব্যাংকিং খাতে গত দুই দশকে কিছু প্রতিষ্ঠানে অনিয়মেরও খবর পাওয়া যায়, যা আমানতকারীদের বিচলিত করে তোলে। 

দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, গত কয়েক দশকের মধ্যে ব্যাংক খাতে আমানতকারীরা বড় বিপাকে পড়ে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ৫০০-৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায়। ২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনায় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক দূর্বল হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত হওয়া ওই শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় মালয়েশিয়াভিত্তিক আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়। এরপর ১৮ বছরেও পুরো টাকা ফেরত পাননি ব্যাংকটির আমানতকারীরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাংকটি বন্ধ না হলেও আর কখনওই ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। 

২০১১ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা আর্থিক সংকটে পড়লে দুটি প্রতিষ্ঠান একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভোলপমেন্ট ব্যাংক নামে চালু করা হয়। 

পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে আর্থিক অনিয়মের প্রবণতা বেড়েছে। টাকার অঙ্কে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বা শিল্প ব্যাংকের অনিয়মের থেকেও বড় অনিয়ম ঘটেছে এখাতে।

ঋণ-কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়ার এসব আলোচিত ঘটনার মধ্যে হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, পিকে হালদারের ঋণ অনিয়মগুলো ব্যাংক খাতে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এছাড়া নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার কারণে এখাতে বর্তমানে (২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণের বোঝা চেপে বসেছে। এতে ব্যাংক খাতে স্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। সেই সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিতভাবে কিছু ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। তারপরও আমানতকারীদের মধ্যে অনাস্থা রয়ে যাচ্ছে। 

এই সময়ে কোনও ব্যাংক বন্ধ হতে দেখা যায়নি, বরং আরও ডজন খানেক ব্যাংক নতুন করে চালুর অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বর্তমানে দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ৬টি (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল)। বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে দুটি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।

প্রচলিত ধারার বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ৩৩টি। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে ১০টি এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে ৯টি। এছাড়াও ব্যাংকের মতোই আমানত নিয়ে কাজ করে এমন ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রয়েছে ৩৫টি। 

২০১৬ সাল থেকে ব্যাংক খাতে উদ্বেগ তৈরি করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক নামে ব্যবসা করার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান সেখানে বড় ধরনের পুঁজির জোগান দেয়। তারপরও ভালো করতে পারেনি ব্যাংকটি। প্রাতিষ্ঠানিক কয়েকটি আমানতকারীদের টাকা ফেরত না দিতে পেরে সম্প্রতি সেই আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

২০২১ সালের দিকে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর আমানতকারীদের আমানত ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এখনও মাঝে মাঝে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করতে দেখা যায় এর আমানতকারীদের। এছাড়াও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স দূর্বল হয়ে পড়ায় এই প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারীরাও দীর্ঘদিন ধরে আমানত নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির নাম বদল করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এছাড়া পিকে হালদারের অনিয়মের কারণে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বিআইএফসিসহ কয়েকটি এনবিএফআইয়ে সৃষ্ট উচ্চ মাত্রায় খেলাপি ঋণ গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বরাবরই দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে আশাবাদী। ব্যাংক খাত বিশ্লেষকরাও বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হলে দূর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর পক্ষেও তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব। 

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতকারীরা তাদের অর্থের নিরাপত্তার জন্যই ব্যাংকে টাকা রাখেন। সেক্ষেত্রে টাকাটা তোলার সময় ভালো যৌক্তিক মুনাফা পাওয়ারও অধিকার তার রয়েছে। তবে বাইরের দেশে ভালো ব্যাংকগুলো একটু কম মুনাফা দেয়। কারণ তারা অনেক বেশি নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকে ব্যবসা করে। সেক্ষেত্রে আমানতকারীর মূল স্বার্থ দুটি। একটি টাকাটা সময় মতো ফেরত পেলেন কি না? দ্বিতীয়ত একটি যৌক্তিক মুনাফা পাচ্ছেন কি না?

ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকলে আমানতকারীদের প্রতিদান (রিটার্ন) কমে যায়। তারা তাদের প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

দীর্ঘ ৩২ বছরেরও বেশি সময়ে ব্যাংকিং পেশায় একাধিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন নূরুল আমীন। ছিলেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠনের চেয়ারম্যান। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যাংক খাতে একটা কথা প্রচলিত আছে, টাকার ব্যবসায় কখনও লোকসান হয় না। ব্যাংক যদি দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করতে পারে, তাহলে ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া অর্থের ঘাটতিও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কারণ ব্যাংক নতুন ঋণ দিয়ে মুনাফা করতে পারে। সেই মুনাফা দিয়ে একটা সময় ঘাটতি পুরণ হয়ে যায়। তবে ঋণ অনিয়মের ফলে ঘটে যাওয়া তারল্য সংকটের তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে আমানতকারীদের ওপর।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত