Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

কোন সংকটে ব্যাংক খাত, উত্তরণ কোন পথে

কোন সংকটে ব‍্যাংক খাত

সালটি ২০০৮, ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ডের তিনটি ব্যাংক পড়ে সংকটে। তাতে ডুবতে বসে দেশটির অর্থনীতি, আর তা রাজনীতিকেও করে তোলে অস্থির। ঠিক ওই সময়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান লিম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে পড়লে শুধু ২৬ হাজারের মতো মানুষ কাজই হারায় না, অর্থনীতিকেও নাজুক করে তোলে। তখনই আবার ওয়াশিংটন মিউচুয়াল দেনার দায়ে ডুবতে বসে। ব্যাংক খাতের সেই দুরবস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেলে দিয়েছিল মন্দার মধ্যে, তার ধাক্কা লেগেছিল গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে। 

সেজন্যই ব্যাংক খাতকে ‘অর্থনীতির হৃদপিণ্ড’ বলা হয়ে থাকে। এই খাতের ভালো অবস্থা কিংবা মন্দ অবস্থা দুটোরই প্রভাব দেশের ওপর পড়ে বলে উদ্বেগও থাকে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়েও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ,তা সংসদে আলোচনায়ও উঠছে। চলতি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে বিরোধীদলীয় নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তুলে ধরেন, বর্তমান সংকটজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তারল্য সংকট, ডলার সংকট নিয়ে ব্যাংক খাত দুর্বল অবস্থায় আছে। সরকারি দলের সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময় বলেন,ব্যাংক লুটের মতো কিছু ঘটনা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। 

সত্যি হচ্ছে, দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে উদ্বেগ বেশ কিছু দিন ধরে। এখন প্রশ্ন আসছে, পরিস্থিতি আসলে কী?

দেখা যাচ্ছে যে সরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারিগুলোও বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণে ভারাক্রান্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা হলেও অর্থনীতিবিদরা হিসাব দিয়েছেন, এই অঙ্ক প্রকৃতপক্ষে চার লাখ কোটি টাকার বেশি। ডলার সংকট চলছে দুই বছর ধরে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের পতন থামছে না। সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগও কমছে। সব মিলিয়ে নাজুক অর্থনীতির মধ্যে নাজুক অবস্থায় আছে ব্যাংক খাত। 

এই পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ কমাতে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। খারাপ ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। 

সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত না হলে, শৃঙ্খলা ফেরাতে না পারলে সংকটের এই সময়ে অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো হবে না। এ বিষয়টির দিকেই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে ৬/৭টি ব্যাংকের মালিকানা চলে যাওয়াও উদ্বেগের কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো পরিচালনার ক্ষেতে সুশাসনের কথাটি বারবারই আসছে। তারমধ্যেও দেখা যাচ্ছে মালিকদের কথামতো না চলতে পারায় সরে পড়তে হচ্ছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীদের। 

তবে এই সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে খেলাপি ঋণ। 

যেভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনও ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকরা। ২০২২ সালে সেই ছাড় তুলে দেওয়ার পর খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় এবছরের শুরু থেকেই। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়। ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই খেলাপির খাতা থেকে নাম কাটার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণ বাড়ছেই ; বরং বারবার ছাড় দেওয়ার কারণে ভালো গ্রাহকেরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এতে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে।

এদিকে গত বছর জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়। এর ফলে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনের কারণে সামনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মূলত ২০১৫ সাল থেকে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপিরা বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা নতুন করে ঋণও নিচ্ছেন এবং নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃতফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, যা ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৮ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি।

আইএমএফ পুনঃ তফসিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এ শর্তও আপাতত পূরণ হচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে।

যত ছাড়তত বেশি খেলাপি

ঋণখেলাপিদের উদার হস্তে ছাড় দেওয়া শুরু হয় ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। নতুন করে ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেয়। তখন তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা যেত না। কিন্তু বেশিরভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন।

ফলে ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তারপরও এসব গ্রুপের বেশির ভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি।

আবার বড় ছাড় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী হয়েই আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ইতিহাসে ঋণখেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন। সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়, এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সেই সুযোগ নেওয়া বেশির ভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

অথচ অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসেই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তখন দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি বেড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই এখন এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কেবল পরিমাণে নয়, শতাংশ হারেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। আর আইএমএফের দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী পুনঃতফসিল ও মামলায় আটকে থাকা ঋণের হিসাবে নিলে পরিমাণ ও শতাংশ হারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বহু গুণ।

বিশাল অঙ্কের এই ঋণ খেলাপি নিয়ে সবচেয়ে জোরালো কথা বলেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আজ ব্যাংকিং খাতের যে দুরবস্থা, তার জন্য খেলাপি ঋণ দায়ী: বড় বড় ঋণ খেলাপিরা দায়ী। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকিং খাতে কখনই সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। এ দুই ঋণকে বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।” যত দিন ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আলাদাভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে না, তত দিন খেলাপি ঋণও কমবে না বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক। 

তিনি বলেন, ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোনও সরকারই এ উদ্যোগ নেয়নি। খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঘোড়াকে থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাদের জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। তাহলে হয়ত এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। যত দিন এ কাজ করা যাবে না, তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।

ঋণের সুদহার বাড়ছেই

ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়েই চলেছে। নতুন ঋণের ক্ষেত্রে এপ্রিল মাসে ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহার ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আগের মাস মার্চে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে এই স্মার্ট সুদ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। এ হিসাবে এপ্রিল মাসে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

অর্থাৎ এখন ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ঋণ নিতে বছরে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এপ্রিলের আগে নেওয়া ঋণের সুদহার আগের মতোই থাকবে। তবে ছয় মাস পর সুদহার পূনর্নির্ধারণ করতে পারবে ব্যাংক। 

ট্রেজারি বিলের সুদ হারের ছয় মাসের গড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্চ মাসের এই ‘স্মার্ট’ রেট হিসাব করেছে। ফেব্রুয়ারিতে ‘স্মার্ট’ রেট ছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এই সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। নভেম্বরে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ,অক্টোবরে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালুর সময় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ।

কটেজ, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই), ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে ভোক্তা ঋণ ও সিএমএসএমই ঋণের সুদহার হবে ১৪ শতাংশের বেশি—১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

মার্চে বড় অঙ্কের ঋণের সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ; আর ভোক্তা ও ছোট ঋণের সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে বড় অঙ্কের ঋণের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ; আর ভোক্তা ঋণের সুদহার ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ১৭ জানুয়ারি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে সীমিত রাখতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। উদ্দেশ্য ঋণের ব্যয় বাড়িয়ে চাহিদা কমানো। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ হিসাবে মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আগামী জুনের মধ্যে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নতুন মুদ্রানীতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই মুদ্রানীতিতে পলিসি রেট বা রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা নেওয়ার খরচ বেড়েছে। তহবিল খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঋণের বিপরীতেও সুদ বাড়াতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে স্মার্ট সুদ হারের সঙ্গে এখন সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। এতদিন যোগ করত ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে স্মার্ট সুদ হারের সঙ্গে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ যোগ করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এতদিন যোগ করা হত ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

অর্থনীতি গবেষক সাব্বির আহমেদের মতে,  উচ্চ সুদ হারের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে তারল্য সংকট; কমে গেছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি; নাভিঃশ্বাস উঠেছে কৃষি ও শিল্প উৎপাদকদের। উচ্চ সুদের হার মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, উচ্চ সুদের হার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেরাখতে পারেনি, বরং প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে। ১২/১৫ শতাংশ সুদের হার টেকসই অর্থনীতির পরিচায়কনয়। তাই সুদের হার কমাতেই হবে।

ডলারে ওলটপালট সব

দুই বছরের মহামারীর ধাক্কা সামলে যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি, তখন দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব ওলটপালট করে দিচ্ছে। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার; মাস দু’য়েক হলো বাড়েনি। তবে, দুই বছরে ৩০ শতাংশের মতো যেটা বেড়েছে, তার মাশুল দিতে হচ্ছে উঠতে-বসতে।

দুই বছর আগে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর বাড়তে থাকে ডলারের দর; টানা বাড়তে বাড়তে এখন ১১০ টাকায় এসে ঠেকেছে। তবে ব্যাংকগুলো ১১৫/১১৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করছে; প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহ করছে ১১৫/১১৬ টাকায়। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের কাছ ১২০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১১৯ টাকায়।

অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। বেড়েই চলছিল ডলারের দর; দুর্বল থেকে দুর্বল হতে থাকে টাকা। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি যে প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছে, তাতে ডলারের এই উল্লম্ফন অন্যতম প্রধান একটি কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের তৃতীয় মাস মার্চে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক  ৮১ শতাংশ, যা এক যুগ বা ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

শুধু মূল্যস্ফীতি নয়, ডলারের উল্লম্ফনের প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়েছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। কিন্তু এরপর থেকে কমছেই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয় সঙ্কোচনের পদক্ষেপ নিয়েও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যায়নি। উল্টো দিন যত যাচ্ছে, রিজার্ভ কমছেই।

সবশেষ গত ৮ এপ্রিল রিজার্ভের যে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তাতে দেখা যায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধে টাকার অঙ্কেও খরচ বেড়েযাচ্ছে, যা বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। তাই ডলারের জোগান না বাড়লে বৈদেশিক লেনদেনে বড় ঘাটতি তৈরি হবে।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব

ব্যাংকের মালিক ও ব্যবস্থাপক দ্বন্দ্বে গত এক বছরে চারটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দীর্ঘ দিনের চর্চার ওপর চোখ রাখলে দেখা যায়, এখাতে পরিচালকদের ভুল নেতৃত্ব অনেক সময় ব্যাংক খাতে বিপদ ডেকে এনেছে। আমানতকারীদের স্বার্থ বিপন্ন করে তুলেছে।

আবার পর্ষদের যোগ্য নেতৃত্ব অনেক ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেক শক্ত অবস্থান গড়েতুলতে সক্ষম হয়েছে। পরিচালকদের ভুল পথ থেকে ফেরাতে অনেক ক্ষেত্রে সফল হয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে বিফলও হয়।

ব্যাংক নির্বাহীদের অপ্রত্যাশিত পদত্যাগ বা চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে ২০১৪ সালে একটি সুরক্ষা নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই সুরক্ষা নীতিমালা খুব একটা কাজে আসেনি।

এক সময়ে সিটি ব্যাংক এনএ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সবশেষ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে কাজ করা রাশেদ মাকসুদ খান বলেন, ব্যাংকের এমডিদের ঠিকভাবে কাজ করতে না দেওয়ার ফলেই ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছে না। অনেক ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনেও এই কারণটি দায়ী।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো.নূরুল আমিন বলেন, ব্যাংকের পরিচালকরা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেন নাব্যাংক নির্বাহীরা। এক পর্যায়ে নতি শিকার করতে বাধ্য হন।

ব্যাংক পরিচালনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরসুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে। এমডি ও পর্ষদের কে কতটুকু কাজ করতে পারবেন, কার কতটুকু ক্ষমতা, তাসুনির্দিষ্ট করা আছে। এটি কার্যকর করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

সুশাসনে ফেরাতে হবে আস্থা

ব্যাংক কোনও সমস্যায় পড়লে আস্থা হারানে আমানতকারীরা, তার সার্বিক প্রভাব পড়ে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা সঠিকভাবে না দেখার কারণেই ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো.আহসান হাবীব। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ম-নীতি (কমপ্লায়েন্স) মেনে চলতে হবে। 

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “ব্যাংকের মালিকরা যে কোনও পুঁজি বিনিয়োগ করে না, তা নয়। তবে ৯০ শতাংশের বেশি পুঁজি আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে। ব্যাংক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে আমানতকারীদের স্বার্থ দেখতে হবে সবার আগে।”

বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরই দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে আশাবাদী। ব্যাংক খাত বিশ্লেষকরাও বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হলে দূর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর পক্ষেও তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব। 

কিছু কিছু ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককেই দায়ী করেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে ডজন খানেকের বেশি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়টি জানত। কিন্তু এতদিন তারা ‘দেখছি-দেখব’ বলে কালক্ষেপণ করে গেছে। আরও আগেভাবে এই ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে মার্জার অ্যান্ড এক্যুইজিশনের উদোগ নিলে এখনকার থেকে আরও কম লোকসানে পড়তে হতো ব্যাংকগুলোকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও শক্তিশালী ভূমিকা প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “সমাধান কী, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানা আছে। এখন তারা যদি সমাধান না করতে পারে তাহলে বলুক যে তারা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, কেন তারা পারছে না?”

কমেছে বিদেশি বিনিয়োগবেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩১৪ কোটি (৩.১৪ বিলিয়ন) ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই আট মাসে ৩ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই দেশে এসেছিল।

চলতি অর্থবছরে জুলাই-ডিসেম্বরে সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এই আট মাসে ১১১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ১১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির চলমান সংকটের মধ্যে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অষ্টম মাস ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আগের মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের ঘরে (৯ দশমিক ৯০ শতাংশ) নেমে আসে। অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দুই অঙ্কের ঘরে- ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।

২১ মাস পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) ঘরে—৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে। আগস্টে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে আরও খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে আসে। পরের মাস অক্টোবরে এই সূচক বেড়ে দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে–১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে ওঠে। নভেম্বরে তা ফের এক অঙ্কের ঘরে—৯ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমে এসেছে।

বিনিয়োগে মন্দা দেখা দেওয়ায় দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে, বলছেন বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে ব্যাংকগুলো। কয়েক মাসের মধ্যে সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে উঠেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমছে না; উল্টো বাড়ছে। এখানে আমার প্রশ্ন, শুধু সুদের হার বাড়ালেই কি বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমবে?” বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার পরামর্শ দিচ্ছেন রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক এই সভাপতি।

জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কী প্রভাব

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে করুণ দশা এবং অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপ নেয়। তার সুফলও মেলে, আমদানি ব্যয় বেশ কমে আসে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৪ হাজার ৪১০ কোটি ৮০ লাখ (৪৪.১৯ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই আট মাসে ৪৬ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

আমদানি কমায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) কমবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। সব দেশেই ডলারের দর বেড়েছে; মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। সামাল দিয়ে তারা কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল; এখন ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা।

“কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ডলার সংকট কাটছে না; ডলারের বাজারে অস্থিরতা যাচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমরা কী করছি; সব দেশ পারলে আমরা পারছি না কেনো? আমাদের গলদ কোথায়? আমরা কী ঠিকঠাক মত ব্যবস্থাপনা করছি না।?” তিনি বলেন, “এখানে দুটি বিষয় আমি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে চাই। দীর্ঘদিন ডলারের দর ধরে রেখে আমরা ঠিক কাজটি করিনি। ওইটা ছিল আমাদের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। আরেকটি ভুল ছিল আমাদের—মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল; তারপরও আমরা ৯ শতাংশ সুদ হার দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলাম। এখন অবশ্য সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই দুই ভুলের মাশুলই আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। আরও কতদিন দিতে হবে কে জানে?”

কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও থাইল্যান্ড, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে তথ্য দেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর। তিনি বলেন, “সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমানোর নীতি অবলম্বন করে এসব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। আমরা করিনি। তাই পারিনি। দেরিতে করছি। দেরিতেই ফল পাওয়া যাবে।” 

আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানার প্রভাবে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি আসা কমে যাওয়ার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এতে শিল্প উৎপাদন কম হবে। কর্মসংস্থান হবে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে।”

তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে আগে না তাকিয়ে এখন রিজার্ভ বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি। 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত