Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন

যে পথ পেরিয়ে এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি

আশফাকুর রহমান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

‘‘যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে বার বার
   একটি প্রিয়তমার ছবি চোখে
   আনতে চেষ্টা করেছিল,
তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবি করতে এসেছি
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমি তাদের
     ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে হত্যা করেছে,
যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায়
     অভ্যস্ত মাতৃ সম্বোধনকে
     কেড়ে নিতে গিয়ে
আমার এই সব ভাইবোনকে হত্যা করেছে,
আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’’

[মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতার অংশবিশেষ]

প্রথম কবিতা

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে মানুষ হত্যার খবর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির দুপুরে জানতে পেরেছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। অসুস্থ অবস্থায় শ্রুতিলিখনের সাহায্যে ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ নামে একুশের প্রথম কবিতাটি লিখলেন চট্টগ্রাম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এই আহ্বায়ক। পরদিন চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লা কোহিনুর প্রেস থেকে ১৭ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকায় এ কবিতাটি ছাপা হয়। এ খবর জানতে পেরে পুলিশ উপস্থিত হওয়ার আগেই কবিতার পাণ্ডুলিপিটি লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে ২৩ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিশাল এক প্রতিবাদী সমাবেশে কবিতাটি চৌধুরী হারুনুর রশিদ আবৃত্তি করেন।

১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম শহীদ দিবসে প্রভাতফেরিতে ফেস্টুন হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। আলোকচিত্র: রফিকুল ইসলাম।

প্রথম গান

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনেই ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিনের মরদেহ দেখতে গিয়েছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। মরদেহটি দেখে তার মনে হলো এ যেন তার ভাইয়ের রক্তমাখা দেহ। এ সময়েই তাৎক্ষণিকভাবে তার কল্পনায় লেখা হলো অমর এ গানের প্রথম দুই ছত্র:

‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি’’

২২ ফেব্রুয়ারিতে লাঠিচার্জে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের অনুরোধে এই কবিতা-গানটি লেখা শেষ করেছিলেন। একুশের এই গানটির কয়েকটি ছত্র নিয়ে প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম লিফলেট। শিরোনাম ছিল ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব’। ছাপা হওয়া এই গানটির সঙ্গে রচয়িতার নাম ছিল না।

১৯৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’তে লেখক নামসহ একুশের গান শিরোনামে প্রকাশিত হয় এই কবিতা-গানটি। এই গানটিতে প্রথম সুর দিয়েছিলেন তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল লতিফ। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। ওই বছরেই ঢাকা কলেজে শহীদ মিনার স্থাপনের সময় ছাত্ররা গানটি গেয়েছিলেন। এই গানটিতে ১৯৫৪ সালে প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ সুরারোপ করে। ওই বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে তার সুরটি পায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’য় একুশের এই গানটি প্রথম কোনও চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়।

প্রথম শহীদ দিবসে ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুরাতন ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ইডেন কলেজের ছাত্রীরা শহীদ মিনার বানাচ্ছেন। এ সময় বাধা দিয়েছিলেন ইডেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ফজিলাতুন্নেসা জোহা (ছবিতে সম্মুখে বাম থেকে সাদা শাড়ি পরিহিতা প্রথমজন)। আলোকচিত্র: রফিকুল ইসলাম।

প্রথম শহীদ মিনার

১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির পরদিন উত্তাল ছিল ঢাকা। চলমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও তীব্র। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে এক বিশাল গায়েবানা জানাযার নামাজ আদায় করা হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা। পরে বের হয় কালো পতাকার এক শোভাযাত্রা। হাইকোর্টের সামনে এ শোভাযাত্রার ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি করা হয়। সারাদিন পুরো শহর জুড়েই চলে বিক্ষোভ-মিছিল-শোভাযাত্রা। ওই দিন রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে রাজনীতি ও সংস্কৃতি সচেতন শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

এই শহীদ মিনারের নকশাকার ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন শিক্ষার্থী সাঈদ হায়দার এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘এটাকে স্বতঃস্ফূত একটি পরিকল্পনা বলা চলে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। … ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। … নকশায় সাড়ে ন’ফুটের পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ করার পর দেখা গেল মূল পরিকল্পনাকে তা ডিঙিয়ে গেছে। মিনারটি সম্ভবতঃ ১১ ফুট তৈরি হয়েছিল।’

২৪ ফেব্রুয়ারি এ শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। আবার ২৬ ফেব্রুয়ারি এই শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। সেই দিন দুপুর-বিকালে তৎকালীন সরকারের সশস্ত্র বাহিনী নিশ্চিহ্ন করে দেয় এই শহীদ মিনারটি।

এরপরই কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখলেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? …ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর … রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।’

ভেঙে দেওয়া এই শহীদ মিনারের স্থানটি হয়ে উঠল বাঙালির আত্মপরিচয়ের উৎস। ‘‘বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ বইয়ে রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘তিপ্পান্ন, চুয়ান্ন, পঞ্চান্ন, সাতান্ন, আটান্ন, ঊনষাট, ষাট, একষট্টি, বাষট্টি, এই দশটি বছরের প্রথম চারটি বছর নিশ্চিহ্ন মিনারের কালো কাপড় ঘেরা স্থানটি আর বাকি সাতটি বছর শহীদ মিনারের জন্যে নির্মিত ভিত্তি ও মঞ্চটি ছিল এ-দেশের মানুষের শহীদ মিনার, তিপান্ন থেকে তেষট্টি প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে বাঙালি শপথ নিয়েছে ঐ স্মৃতির মিনারে যা বাঙালিকে দিয়েছে অবিরাম সংগ্রামের অন্তহীন প্রেরণা। চুয়ান্ন একুশে ফেব্রুয়ারিত আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’ যুক্তফ্রন্ট একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতীক একুশ দফায়, শহীদ মিনার নির্মাণ, একুশকে শহীদ দিবস ঘোষণা, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা, নূরুল আমীনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমী করার শপথ নিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করেছিল। চুয়ান্ন সালের ২রা এপ্রিল গঠিত হয়েছিল শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে সে সরকার পয়ঁতাল্লিশ দিনের বেশি স্থায়ী হতে পারেনি। শেরে বাংলাকে ‘রাষ্ট্রদোহী’ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মুহম্মদ আলি যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়েছিল। ঐ পয়ঁতাল্লিশ দিনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করলেও তা কার্যকর করে যেতে পারেনি। পঞ্চান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ৯২-ক ধারায় জেনারেল ইস্কন্দর মীর্জার শাসনামলে শহীদ দিবসের ছুটি বাতিল করা হয়। বাধা দেয়া হয় শহীদ দিবস পালনে, শহীদানের কবরে ও শহীদ মিনারে যেতে।’’

মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ আজ পর্যন্ত গড়ে দিয়েছে এমন এক বলয় যা উপক্ষো করা যায় না। এমনকি চেষ্টা করা হলেও ত্যাগ করা যায় না— পেছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। শহীদ দিবস চায় প্রসারতা— চায় বিশালতা— হতে চায় নিত্য জীবনের সখা।

প্রেরণার দিন

কবিতা-গান-লেখা-চিত্রে আর আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অন্তিম আকাঙক্ষাই হয়ে উঠেছে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’। একইসঙ্গে উদ্‌যাপন, নিবেদন, স্মরণ, শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অর্পূব সম্মিলনের দেখা শহীদ দিবসের মতো বছরের আর কোনও দিনে পাওয়া যায় না। এই দিন এমনই যা কখনো হয় না পুরানো। বছর ঘুরে প্রতিটি অন্য দিনের মতো এই দিনটি হয়ে ওঠে নতুন এক নিজেকে খুঁজে পাওয়ার দিন— প্রেরণার দিন।

মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রে ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ আজ পর্যন্ত গড়ে দিয়েছে এমন এক বলয় যা উপক্ষো করা যায় না। এমনকি চেষ্টা করা হলেও ত্যাগ করা যায় না— পেছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। শহীদ দিবস চায় প্রসারতা— চায় বিশালতা— হতে চায় নিত্য জীবনের সখা।

রফিকুল ইসলাম আরও লিখেছেন, ‘‘পঞ্চান্ন সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বায়ান্নো সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি হয়েছিল প্রায়। আবার নিষেধাজ্ঞা, আবার ১৪৪ ধারা, ছাত্র সমাজের সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য, বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলাভবন থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর সভা শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, লাঠি, টিয়ারগ্যাস, ফাঁকা গুলিবর্ষণ, অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর গ্রেফতার বরণ ইত্যাদি ঘটনা, তবে এবারে কাউকে প্রাণ দিতে হয়নি কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে এত অধিকসংখ্যক ছাত্রী গ্রেফতার হয়েছিলেন যে, লালবাগে পুলিশ হেডকোয়ার্টাস প্রাঙ্গণে তাদের জন্য অস্থায়ী জেলখানা বসাতে হয়েছিল তাবুতে।’’

২১শে ফেব্রুয়ারি তথা শহীদ দিবস পালন বাঙালি জীবনে ছিল সম্পূর্ণভাবে আনকোড়া নতুন বিষয়। কালে কালে এই দিনটি হয়ে উঠল বাঙালির জেগে উঠার দিন। এ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘বায়ান্নো সালের ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার দাবিতে হলেও এটা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির আন্দোলন, আরো ব্যাপক অর্থে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বাধিকারের আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের প্রক্রিয়া। তাই ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ দিবস উদযাপিত হয়েছিল যে আঙ্গিকে তা পূর্ব বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতায় নতুন।’’ এই দিনটির কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘ … সন্ধ্যায় (১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি) ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে (বর্তমান জিন্নাহ এভিন্যু এলাকায়) যে অনুষ্ঠান হয়, সেখানে এমন কতকগুলো গান গাওয়া হয়েছিল যেগুলো পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করে। সেখানেই প্রথম ‘আমার সোনার বাংলা…’ গানটি গাওয়া হয়। ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটিও সেখানেই গাওয়া হয়।’’ 

তিনি আরও লিখছেন, ‘‘একুশের সকালে প্রভাতফেরি— মুখে গান, ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’, কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ পরিধান, নগ্নপদ শোভাযাত্রা, শহীদানের কবরে এবং ধ্বংসকৃত শহীদ মিনারের স্থানে পুষ্পস্তবক প্রদান। ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে শহীদ মিনার নির্মাণ এবং ঢাকা কলেজে ছাত্রদের শহীদ দিবস অনুষ্ঠানে প্রথম আবদুল লতিফের সুরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর সঙ্গীত ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান আর হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র প্রকাশের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারি বা অমর একুশে পালন বাঙালির জীবনে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ২১শে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।’’  

রফিকুল ইসলাম আরও লিখেছেন, ‘‘২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর একটা গান— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ যেমন এখন জনমনে দাগ কাটতে পেরেছে, সে-সময় অর্থাৎ ১৯৫২, ’৫৩, ’৫৪, ’৫৫ সালে পর্যন্ত ‘আমরা ভুলব না, ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সারা বাংলার বুকে একটি শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল।’’ উল্লেখ্য, এ গানটি লিখেছিলেন গাজীউল হক।

প্রথম শহীদ দিবসে সকালে ঢাকা মেডিকেল হোস্টেল মোড়ে (যেখান থেকে গুলি চলেছিল) ছাত্র-জনতার শোভাযাত্রায় শহীদানের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত করা হচ্ছে। আলোকচিত্র: রফিকুল ইসলাম।

১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবস

প্রথম শহীদ দিবসের স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন করে আহমদ রফিক ‘একুশের দিনলিপি’তে লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক তাৎপর্যে দিনটিকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। ভোরবেলাটা যদি হয়ে থাকে ছাত্রদের, তাহলে দুপুরটা মিছিলে মিছিলে ছাত্রজনতার এবং বিকেলটা ময়দানি ভাষণে রাজনীতিকদের।’। তার লেখা থেকেই জানা যাচ্ছে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এর আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য ছাত্র-জনতার উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

প্রথম শহীদ দিবসের প্রভাতফেরির দিয়েছেন তিনি অপূর্ব এক বর্ণনা। লিখেছেন, ‘‘ভোরে ছাত্রাবাসগুলো স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। স্লোগানে মূলত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ ‘শহীদস্মৃতি অমর হোক ‘জুলুমশাহী ধ্বংস হোক’ ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ ইত্যাদি প্রাধান্য পায়। যাত্রা শুরু নিজ নিজ শিক্ষায়তন প্রাঙ্গণ থেকে, যেখানে শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে সে সব স্থানে শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হয়ে প্রতীকী শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে দিয়ে।’’ এ দিনেই নগ্নপদে প্রভাতফেরির সূচনা হয়। গানে স্লোগানে পথে নেমে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রথাও চালু হয়ে এ সময় থেকেই।

প্রথম শহীদ দিবসের শেষ দুপুরে আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল জনসভা। এতে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। বক্তৃতা করেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুস সামাদ, কাজী গোলাম মাহবুব ও ইব্রাহিম তাহাসহ আরও কয়েকজন। সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা বিষয়ক দাবিগুলো ছাড়াও বন্দীমুক্তি, জালেমশাহীর নিন্দা, নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার এবং জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তোলা হয় বলে আহমদ রফিক তার লেখায় উল্লেখ করেছেন।

১৯৫৪ সালের শহীদ দিবস পালন হয় আরও বড় কলবরে। আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘‘তাতে রাজনৈতিক আবেগ প্রাধান্য পায়। এর কারণ আসন্ন সাধারণ নির্বাচন এবং অসহনীয় দুঃশাসন মুসলিম লীগের, বিশেষ করে অবাঙালি আমলাতন্ত্র পরিচালিত মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের। তাই শহীদ দিবসের আবহ এবার যতটা শোকের তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রতিবাদের, সংসদীয় ধারায় শান্তিপূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণের। … শহীদ দিবস তাই এবার রাজনৈতিক আকাঙক্ষা পূরণের মাধ্যম হয়ে ওঠে। তাই বলে ভাষার দাবি ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে নয়।’ তিনি আরও ধারণা করছেন, ‘… সমগ্র পূর্ববঙ্গজেুড়ে শহীদ দিবসের কর্মসূচি পালন সমাজে যে উদ্দীপনা তৈরি করে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে একুশ দফা ভিত্তিক যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে (১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ) যা তাদের এককাট্টা বিজয় নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছিল।’

এরই ধারাবাহিকতায় শাসকগোষ্ঠী যে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার কথা ভাবছে এ সম্পর্কে আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ একুশে ফেব্রুয়ারি। পর পর তিন বছর দিনটি ছাত্র-জনতার প্রতিবাদী একাত্মতায় রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তির যে প্রকাশ ঘটায় এবং ১৯৫৫-র কাঠোর শাসন ব্যবস্থার মধ্যেও ছাত্রদের যে সাহসী পদক্ষেপ তা মনে হয় শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনায় কিছু না কিছু প্রভাব রাখে। তাই মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে উর্দু ও বাংলাকে ‘সরকারি ভাষা’ (Official Language) হিসাবে স্বীকৃতির চিন্তা মাথায় আসে তাদের।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন

১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করে আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘বেলা ৯টায় মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণের বিলুপ্ত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের কাছাকাছি ১২ নম্বর ব্যারাকের একপাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, আওয়ামী লীগ প্রধান ভাসানী এবং শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।’

১৯৫৭ সালের শহীদ দিবস উদ্‌যাপন শুরু হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিস্থানকে কেন্দ্র করে— প্রভাতফেরির মধ্য দিয়ে। শহীদ মিনার তৈরির বিষয়টি উল্লেখ করে আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘১৯৫৭ সালের শেষ দিকে আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। শিল্পী হামিদুর রাহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমদের যৌথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগে কাজ শুরু। তাদের দুজনকে দেখা যেতো কর্মস্থলে দুটো ছোট্ট বেড়ার ঘরে, কখনো বাইরে বসে গভীর মগ্নতায় কাজ করে যেতে। কাজ চলছে ১৯৫৮ সনে সামরিক আইন জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত।’

আহমদ রফিক আরও লিখছেন যে, ‘১৯৫৮ সনটি একুশে পালনের ক্ষেত্রে আগের বছরের মতোই ছিল গতানুগতিক, নতুন কোনো প্রেরণাহীন। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনের অবাঞ্ছিত দ্বন্দ্বে একুশের ক্ষোভ জমা হতে থাকে। … এর দায় একুশের নয়, দায় রাজনৈতিক বিভ্রান্তির ও আত্মঘাতী দ্বন্দ্বের। সর্বপোরি কঠোর সরকারি দমননীতির।’

সামরিক শাসনে শহীদ দিবস

১৯৫৯ সালে পালন হয় সামরিক শাসনামলে প্রথম শহীদ দিবস। এমন ভয়ংকর পরিবেশেও ছাত্ররা ছিলেন ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনে প্রবলভাবে সক্রিয়। আহমদ রফিক এ সময়টিকে বলছেন, ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আড়াল নিয়ে চলে সামরিক শাসনের বিরোধিতা।’ ১৯৬০ সালের শহীদ দিবস পালন হয় আগের বছরের চেয়ে আরও সর্তকতার সঙ্গে। ১৯৬১ সালে শহীদ দিবস আয়োজন আহমদ রফিকের ভাষায়, ‘… ১৯৬১ সনের একুশে উদ্‌যাপন অপেক্ষাকৃত ব্যাপক, সামরিক সরকার-বিরোধী ছাত্রচেতনা তখন অধিকতর সংহত। সঙ্গে ছিল বাড়তি সাংস্কৃতিক প্রেরণা রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের ভাবনা।’ এবারের শহীদ দিবসের নগ্নপদের মিছিলে স্লোগানে বলা হয়েছে— ‘শহীদস্মৃতি অমর হোক’ ‘রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা কর’ ‘শহীদ মিনার সম্পূর্ণ কর’ ‘ধোঁকাবাজি চলবেনা’ ‘ছাত্র-জনতা এক হও’। এর সঙ্গে উচ্চারিত হতো— ‘একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ। যা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানটির বদলে ১৯৫৬-র পর থেকে উচ্চারিত হয়েছে বলে আহমদ রফিক লিখেছেন।

ছাত্র আন্দোলনে শহীদ দিবস

১৯৬২ সালের শহীদ দিবসে বাড়তি যুক্ত হয় ছাত্র আন্দোলন। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এছাড়া সামরিক শাসনের কড়াকড়ি বেড়ে যাওয়া শহীদ দিবস ছিল উত্তাপহীন। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ করে জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন ছাত্ররাই পালন করেছে গভীর আবেগ নিয়ে। ছাত্র রাজনীতি ক্রমশ উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল। এদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয়। ভাষা শহীদ বরকতের মা শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে আতাউর রহমান খান বলেন, ‘সরকার কতৃক শহীদ মিনার নির্মাণে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয় ঘোষিত হয়েছে এবং কোনো সরকারের সাধ্য নেই শুধু নিপীড়ন দ্বারা জনগণের আশ-আকাঙক্ষাকে পদানত করে রাখা। … শহীদদের আত্মদান শহীদ মিনারকে আজ প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষীর জন্য তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছে।’

শহীদ মিনারে রাজনৈতিক মঞ্চ

১৯৬৪ সালে শহীদ দিবস কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে হায়াৎ মামুদ ‘একুশে উদ্‌যাপনের ইতিহাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৬৪ সালের শহীদ দিবস কয়েকটি কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতি সরকারের নমনীয় ও আপসমূলক মনোভাব দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্য প্রমাণ করে। দ্বিতীয়ত, গত বছরে নবনির্মিত শহীদ মিনার এখন থেকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। … সকালে (১৯৬৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিরাট সমাবেশ ঘটে। মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব তাতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।’ এ সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যে, বাংলা ভাষাতেও একটি জাতীয় সংগীত রচনা করতে হবে এবং দেশের প্রতীকচিহ্নে বাংলা ব্যবহার করতে হবে। এ বছরই প্রথম ঢাকার উর্দুভাষী জনসাধারণ শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

আবার একুশের সংকলন

১৯৬৫ সালে শহীদ দিবস প্রথাগত অনুষ্ঠানের বাইরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল একুশের সংকলন প্রকাশ। এ সময় নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ পুনরায় প্রকাশিত হয়। হায়াৎ মামুদ আরও জানাচ্ছেন যে, ‘১৯৬৬ থেকে ’৬৮ এই তিন বছর শহীদ দিবস যেভাবে উদ্‌যাপিত হয়েছিল তা ঐতিহ্য-পরম্পরাসূত্রেই গ্রথিত।’ তবে প্রবল আর বলিষ্ঠ শহীদ দিবসের দেখা পাওয়া যায় ১৯৬৯ সালে। হায়াৎ মামুদ বলছেন, ‘রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলনে সমগ্র দেশ ও দেশবাসী তখন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। … এই দিনটি হয়ে উঠেছিল দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গণ-আন্দোলনের অজস্র শহীদদের অমর স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত অনন্য— এক শহীদ দিবস।’ ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘আত্মপ্রতিষ্ঠার বজ্রশপথে ভাস্বর শহীদ দিবস উদ্‌যাপিত’।

‘একুশের সৃষ্টি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় দীর্ঘ বক্তৃতা দেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যিক উপন্যাস লেখার জন্য সাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান জানান। যদিও ভাষা আন্দোলনে ৭২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আমাদের এখনও এই মহাকাব্যিক উপন্যাস লেখা হয়নি। ভাষা— রাষ্ট্রভাষা— মাতৃভাষার মতো ভাষা আন্দোলনও এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

বাঙালিয়ানার নির্বাচনী বিজয়

১৯৭০ সালে শহীদ দিবস উদ্‌যাপনকে ‘বাঙালিয়ানার নির্বাচনী বিজয়’ উল্লেখ করে আহমদ রফিক লিখেছেন, উনসত্তরের গণজাগরণ ও রক্তস্নাত দিনগুলোর ঘটনাবহুল ধারাবাহিকতা নিয়ে এ বছরের একুশের দিনটিকেও মনে হয়েছে একই আবেগ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত। ভাষিক জাতীয়তাবাদী ও প্রগতি চেতনায় উদ্বুদ্ধ শুধু ছাত্র ও তরুণ সমাজই নয়, উদ্ধুদ্ধ ঢাকাবাসী নাগরিকবৃন্দ। পুরনো ঢাকার মহল্লাগুলো থেকে নতুন ঢাকা তথা উত্তর ঢাকার পাড়াগুলো একই আলোড়ন, একই চেতনার প্রকাশ। তবে রমনার ছাত্র এলাকায় প্রকাশের তীব্রতা সর্বাধিক।’

দিনটি কীভাবে শুরু হলো এ সম্পর্কে তিনি লিখছেন এভাবে, ‘বিশে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানসূচি শুরু এবং তা বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের তরফ থেকে ভাবগাম্ভীর্যে সূচিত। … রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র এবং ঢাকা টেলিভিশন শহীদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে। সংবাদপত্রগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে এবং এদিন সংবাদপত্র অফিসগুলো বন্ধ থাকে। সকালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উড়তে থাকে কালো পতাকা। … আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন যে, ‘‘দেশমাতৃকার সোনার সন্তানদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করিয়াছে। আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলিতে পারিতেছি’’ (দৈনিক ইত্তেফাক)।’ শহীদ দিবসে দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, ‘আজ বাংলার সেই সূর্যতাপস তরুণদলের অমর আত্মার আবাহনের দিন’।

১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি

আহমদ রফিক ‘একুশের দিনলিপি’ বইতে ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন নিয়ে লেখাটির শিরোনাম দিয়েছেন, ‘একুশের ডাক স্বাদেশিকতার নানা চরিত্রে পরিস্ফুট’। লিখেছেন, ‘১৯৭১ সন। সারা পূর্ববঙ্গ বিক্ষুব্ধ রাজনীতির ঢেউয়ে চড়ে গর্জমান। রাজপথ, মাঠ ময়দান এক কাতারে দাঁড়ানো। সে রাজনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার, তার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণের। তাতে প্রগতিবাদীরাও বিক্ষোভে সমান অংশীদার, এমনকি মওলানা ভাসানীও একই পথের যাত্রিক। এমন রাজনৈতিক ভাসানে একুশের অনুষ্ঠান হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু না রাজনীতি যথারীতি একুশেকে ব্যবহার করে। একুশে রাজনৈতিক বিক্ষোভের দাবদাহময় প্রেক্ষাপট তৈরি করে।’

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালের শহীদ দিবস উদ্‌যাপনের খবর দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হয় এভাবে, ‘এই উদ্দীপনা অভুতপূর্ব। এ আলোড়ন অবিস্মরণীয়। একুশের আগের এ রাতে ঘুম নামেনি রাজধানীতে। ঘুম নামেনি পড়ায় পাড়ায়। … শনিবার রাতে প্রায় এগারোটা থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী খালি পায়ে মশাল নিয়ে মিছিল করে জমায়েত হতে থাকে গোরস্থানে। রাত বারোটা বাজতেই সেখানে দলীয় প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এসে পৌঁছান এবং শহীদদের মাজার জিয়ারত করেন। এরপর এক বিরাট মশাল মিছিল নিয়ে আসেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে জনতার উদ্দেশ্যে তিনি ভাষণ দেন’।

আহমদ রফিক আরও লিখেছেন, ‘তুলনামূলক বিচারে একাত্তরের শহীদ দিবস উদ্‌যাপনের ঘনঘটা ছিল ত্রিমাত্রিক— রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিকে ঘিরে।’

ওই লেখা থেকে জানা যায়, বাংলা একাডেমি শহীদ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে ‘ভাষা আন্দোলন স্মরণ সপ্তাহের পঞ্চম দিনে ‘একুশের সৃষ্টি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় দীর্ঘ বক্তৃতা দেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যিক উপন্যাস লেখার জন্য সাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান জানান। যদিও ভাষা আন্দোলনে ৭২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আমাদের এখনও এই মহাকাব্যিক উপন্যাস লেখা হয়নি।

ভাষা— রাষ্ট্রভাষা— মাতৃভাষার মতো ভাষা আন্দোলনও এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সময়ের নানা আাঙ্গিক ও পর্বে ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের আবেদনের বিনাশ হয়নি— এ যেন নিজেই হয়ে উঠেছে এক চির নতুন পটভূমি।

ওই অনুষ্ঠানে সভানেত্রীর ভাষণে কবি সুফিয়া কামাল বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি কখনো আমাদের চেতনা থেকে মুছে যাবে না। তা চিরন্তন। তাৎক্ষণিকতার মধ্যে তা হারিয়ে যাওয়ার মতো নয়’। ‘শহীদের দিনলিপি’ বইতে ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ প্রকাশিত উদ্ধৃত সংবাদ থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ‘‘১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে’।’’

প্রথম শহীদ দিবসে বিকালে পল্টন ময়দানে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টের (চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষার্থীদের ফেস্টুন শোভাযাত্রা। আলোকচিত্র: রফিকুল ইসলাম।

আরেক ফাল্গুন

১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের অভিজ্ঞতায় ১৯৬৯ সালে ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাস লিখেছিলেন জহির রায়হান। উপন্যাসটির শেষ দৈববাক্য ছিল এমন, ‘‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।’’ উৎসর্গ অংশে জহির রায়হান লিখেছেন, ‘‘এ দেশের মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রাম করেছেন। যাঁরা পুলিশের লাঠি গুলি আর বেয়নেটকে উপেক্ষা করে মিছিলে এগিয়ে এসেছেন। যাঁরা অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গিয়ে কারাগারে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করেছেন যাঁরা স্বৈরাচারের বিষাক্ত ছোবলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জনতার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর যাঁরা মিছিলে, কারাগারে, ক্ষেতে, খামারে কারখানায় এই আন্দোলনের বাতাস বহন করতে গিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের সকলকে।’’

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রাণের বিনিময়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের দিল শহীদ দিবস। যা আজ একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সময়ের সঙ্গে আমরা যতই এগিয়েছি, ভাষা-সংস্কৃতি বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব বেড়েছে ততটাই। ফাল্গুন মাসে আমাদের শহীদ দিবস আরও শক্তি অর্জনের কথা বলে, জহির রায়হানের ভাষায় দ্বিগুণ হতে বলে— আন্দোলন বাতাসে অমরত্ব লাভের কথা বলে। তাই ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেনি তাদেরও ত্যাগ স্বীকারের কথা প্রতীকীভাবে গল্পে বলেছেন মুর্তজা বশীর। ১৯৬৫ সালে তিনি লিখেছেন ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’। প্রেম-সম্পর্ক, রজনীগন্ধা ফুল আর শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এই গল্পের প্রতিপাদ্য। গল্পটির শেষ অংশ এমন:

‘‘একুশের ভোরে ঘুম ভাঙ্গল প্রভাতফেরী শুনে। দূর থেকে ভেসে ক্রমেই নিকটে এসে আবার দূরে মিলিয়ে গেল। মনটা এক স্নিগ্ধতায় ভরে উঠল। কামালের।

… সকালে ঘর থেকে যখন বেরুল তখন আটটা। রাস্তায় বেরিয়ে ভাবল এই মৌসুমে রজনীগন্ধা ফুল কোথায় পাবে? মনে মনে অনুশোচনা করল কামাল।

… মনে মনে হাসল কামাল। হ্যাঁ লিলিকে সে চমক লাগিয়ে দেবে। (ঘৃণা করলেও ত কিছু করা হলো। এবার ভালবাসতে হবে তাকে।) আজিমপুরা থেকে হেঁটে হেঁটে আসছিল সে। প্রতিটি বাড়ির সুমুখে দেখছিল কোথায় রজনীগন্ধা ফুটেছে। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল একটা বাড়ির ভেতর। একটু থমকে দাঁড়াল কামাল।

হ্যাঁ তাই। সিঁড়ির পাশে, টবে এক ঝাড় রজনীগন্ধা মৃদু বাতাসে মাছের ছিপের ফাতনার মতো নড়ছে।

… হঠাৎ দেখল কেউ নেই সেখানে। বাসার সুমুখে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে সোজা গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। চটপট্ ফুলটা ছিঁড়ে এক রকম চোরের মতোই রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

পেছনে ফিরে তাকাল না। সোজা হাঁটা দিল সামনে।

দর দর করে ঘামতে লাগল সে। কপালের ঘাম মুছে ফুলগুলো শুঁকল। এমন ভাবে সন্তর্পণে সে শুঁকল যেন লিলিকে বুকে জড়িয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে। মনমাতানো সুবাস তার সারা মনকে ছেয়ে ফেলল।

এখনো আধা ঘন্টা বাকী নটা বাজতে। একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ মিনারে সুমুখ দিয়ে যাবার সময় ভাবল সময় কাটানোর জন্য কিছুক্ষণ ওখানে সে দাঁড়াতে পারে। এর আগে কোনোদিন এই দিনে সে এখানে আসেনি। মনের কোনো তাগিদ অনুভব করেনি।

সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠে সম্মোহিত হয়ে গেল কামাল। থরে থরে ফুল সাজানো। শাদা আর লাল ফুলে উঠে সম্মোহিত হয়ে গেল কামাল। থরে থরে ফুল সাজানো। শাদা আর লাল ফুলে লেখা অমর একুশে। একুশে ফেব্রুয়ারি জিন্দাবাদ।

মনটা বেজায় ভারাক্রান্ত হয়ে গেল তার। হাতের মুঠির দিকে চোখ পড়তেই দেখল রজনীগন্ধা ফুলগুলো। নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হলো। ও যেন চোর। কিছুতেই সেখান থেকে নড়তে পারল না। সিমেন্টে তার পা গেঁথে গেছে। অব্যক্ত কান্নায় তার চোখ ভরে গেল। হাতের ফুলগুলো বিছিয়ে দিল সৌধ মিনারে।

রমনা পার্কের রেস্তোরাঁয় যখন সে আসল, দেখল লিলি লেকের ওপরকার কাঠের বারান্দায় বসে। ওকে ঢুকতে দেখে হাসল লিলি। ধীর পায়ে কাছে এসে মিটি মিটি করে তাকাল।

কাচপোকার মতো জ্বলজ্বলে চোখের মণিতে নিজেকে দেখল কামাল।

বলল, লিলি জানো, আমি কিন্তু রজনীগন্ধা ফুল এনেছিলাম।’’


ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবস উদ্‌যাপন ও শ্রদ্ধা নিবেদন— ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করে আরও বড় সত্যের সন্ধান পাওয়া। নিছক কোনও মহাসত্য নয় ভাষার দাবিতে বাংলার মানুষের ক্রমাগত এই আন্দোলন চলমান। ভাষা আন্দোলন এক পরমসত্যের চিরায়ত আখ্যান। যেখানে প্রেমিকার জন্য চুরি করা রজনীগন্ধা ফুলও আর তাকে দেওয়া যায় না— জীবন দেয় বদলে— জীবন যায় বদলে। প্রতিটি শহীদ দিবস আমাদের এখনও ইঙ্গিত দেয় ভাষা আন্দোলনকে সার্থক করতে। মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদাবান হতে ভাষা আন্দোলনই হোক আমাদের সিদ্ধি অর্জনের উপায়।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।
ইমেইল: ashfak21@gmail.com

আরও পড়ুন