Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

কলাম

কৃষি জমির উত্তরাধিকারে হিন্দু বিধবা স্ত্রীর ভাগবখরা-৪

প্রতীকী ছবি। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৫৬-তে ‘হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন’ করে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের বৈধ অধিকার দেওয়া হয় মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারিণী থাকা অবসানের বিনিময়ে।

পূর্বাভাষ: হিন্দু শাস্ত্রীয় আইনে দুটি প্রধান মতবাদ আছে: মিতাক্ষরা ও দায়ভাগ। এ-দুই মতের আইনেই পুত্র, পৌত্র, এমনকি প্রপৌত্র থাকলেও বিধবা স্ত্রীরা স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারিণী হতে পারে না, হতে পারে যদি তারা কেউ না থাকে। স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পাবার ক্ষেত্রে হিন্দু বিধবা স্ত্রীদের এই সুদূরপরাহতদশা ঘোঁচাতে ব্রিটিশ ভারতের শাসকরা ১৯৩৭ সালে নতুন আইন করে পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্রদের সঙ্গে একই সময়ে এক পুত্রের মতো ভাগ বিধবা স্ত্রীদেরও পাবার বিধান করে। সেই সঙ্গে বিধবা পুত্রবধু ও বিধবা পৌত্র বধুদেরও অনুরূপ ভাগ পাবার বিধান করে ঐ আইনে। কিন্ত, সমস্যা বাধল ঐ আইনে কৃষি জমিতে তাদের ভাগ পাওয়া নিয়ে। কেন এই সমস্যা? আমাদের দেশে এখনও কি এই সমস্যা থাকবে? মিতাক্ষরা ও দায়ভাগ হলো কী করে? ভারতে ব্রিটিশের আইন প্রণয়নের কর্তৃত্বের কী ইতিহাস? পড়ুন সেই সব আলোচনা এ-লেখায়। ছয় পর্বের ধারবাহিকের আজ প্রকাশ হলো চতুর্থ পর্ব। 

(তৃতীয় পর্বের পর)

কৃষি জমির উত্তরাধিকারে হিন্দু বিধবা স্ত্রীর ভাগবখরা-৩

৪. ব্রিটিশ ভারতে আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব  

এর আগে পর্যন্ত হিন্দুদের উত্তরাধিকার নিয়ে ব্রিটিশ যে-আইনগুলো করে (তৃতীয় পর্বে ‘প্রণীত আইনের কথা’-য় যেগুলোর উল্লেখ আছে) তখন তো কৃষি-অকৃষির প্রশ্ন ওঠেনি! হেঁয়ালিপূর্ণ ব্যাপক অর্থের এসব শব্দ না বসিয়ে সোজাসুজি ‘কৃষি জমি সমেত’ (including agricultural property) লিখে দিলেই তো মিটে যেত গোল!

এখানেই তো বাঙালি সরব! আইন করতে যথাযথ কর্তৃত্বসম্পন্ন ক্ষমতাবান হতে লাগে (বলেছি প্রথম পর্বে ‘গোড়ার কথা’-তে)। ব্রিটিশের আগে মোগল পর্যন্ত যারা বাইরে থেকে এসে রাজত্ব জুড়ে বসেছিল ভারতবর্ষে তারা কেউ আসেনি আদিভূমির শাসকের চাকরি নিয়ে। এসেছিল তারা নিজ তেজে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে করতে। জিতে নিয়ে রাজত্ব গেঁড়ে বসে, বংশপরম্পরায় এখানকারই স্থায়ী নিবাসী হয়ে। আদিভূমির বাঁধন ছিন্ন করে নাড়ি পোঁতে এখানেই, টান রাখেনি আর আদিভূমির সঙ্গে। নিজের রাজত্ব তার উপ-নিবাস নয়, হয়ে যায় একমাত্র আপন নিবাস। আদিভূমির থেকে সম্পর্ক চুকিয়ে নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে শাসন চালিয়েছে নিজের মনমতো নিজের পারিষদদের নিয়ে। দেওয়ানি-ফৌজদারি সব আইনেরই প্রণয়ন ছিল সপারিষদ নিজের হাতে।

ব্রিটিশের আগে মোগল পর্যন্ত যারা বাইরে থেকে এসে রাজত্ব জুড়ে বসেছিল ভারতবর্ষে তারা কেউ আসেনি আদিভূমির শাসকের চাকরি নিয়ে। এসেছিল তারা নিজ তেজে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে করতে। জিতে নিয়ে রাজত্ব গেঁড়ে বসে, বংশপরম্পরায় এখানকারই স্থায়ী নিবাসী হয়ে। আদিভূমির বাঁধন ছিন্ন করে নাড়ি পোঁতে এখানেই, টান রাখেনি আর আদিভূমির সঙ্গে। নিজের রাজত্ব তার উপ-নিবাস নয়, হয়ে যায় একমাত্র আপন নিবাস।

ব্রিটিশ তো এসেছিল (ভারতবর্ষে) বাণিজ্যের বেশে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে!

ভারতবর্ষে তারা এসেছিল যে-কোম্পানির জাহাজ নিয়ে তার নাড়ি বাঁধা ছিল প্রথম ১৭৩ বছর ‘Royal charter’-এ [রাজা/রানীর (এই রানী হলো রাজসিংহাসনে সমাসীন নারী; রাজার বউ রানী হলো ‘Queen Consort’) বিশেষ অধিকারবলে প্রদত্ত রাজসনদ], পরের ৮৫ বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অ্যাক্টে। গড়ে (এবং বেড়েও) ওঠে তা রাজছত্রছায়াতেই। এলিজাবেথিয়ান যুগের (ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড দুটি পৃথক রাজ্যের একচ্ছত্র রানী ১ম এলিজাবেথের ১৫৫৮-১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ ব্যাপী শাসনকাল; ওয়েলসকে ইংল্যান্ডভুক্ত করে সারে তার পরদাদারা ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে) শেষভাগে ১৬০০-এর ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ক্ষমতাসীন গুটিকয় রাজনীতিকের (এক নম্বরেই ছিল খোদ রানীর জ্ঞাতিভাই ‘আর্ল অব কামবারল্যান্ড’ জর্জ) সঙ্গে উঠতি অভিজাত ধনিক-বণিকেরা মিলে (মোট ২১৯ জন শেয়ারহোল্ডারে) রানীর চার্টার বাগিয়ে গড়ে তোলেন সেই জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি; চার্টার্ড নাম ছিল তখন “Governor and Company of Merchants of London Trading into the East-Indies”, সংক্ষেপে যা ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (পর্তুগীজ, ফরাসি, ডাচদেরও আলাদা আলাদা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল, ভারতবর্ষে কারবারও ছিল তাদের)।

কোম্পানি কী কী অধিকার পায় সে-চার্টারে?

সে-চার্টারে কোম্পানি পায় ভারতীয় উপমহাদেশসহ গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এবং এগুলোতে চলাচলের [সমুদ্র] পথে যত দ্বীপ-শহর-বন্দর-নগর চোখে পড়ে সবখানে ইংলিশরাজের পক্ষে একচেটিয়া বাণিজ্য চালাবার আর তার জন্য জায়গাজমি হস্তগত করা, কুঠি-কেল্লা বসানো, সৈন্যসামন্ত সঙ্গে রাখা, কোম্পানির কারবার ও প্রশাসন চালাবার আইনকানুন বানানো, বিচার-আচার, দরকারি সব কিছু করার অবাধ এখতিয়ার। সঙ্গে পাহারায় পায় দুর্ধর্ষ ‘রয়্যাল নেভি’। (১৭৫৭-তে তাই নবাব সিরাজের বাংলায় কোম্পানির ক্লাইভ যখন ডাঙ্গায়, জলে তখন রয়্যাল নেভির চার্লস ওয়াটসন)। চার্টারের সব ক্ষমতা নিয়ে কোম্পানি চালাতে  লন্ডনে বসে গভর্নর ও ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’ (২৪ জন শেয়ারহোল্ডার সমন্বয়ে)। সেখান থেকে নিয়োগ পেয়ে কোম্পানির চাকরিতে ইংরেজরা সব আসতে থাকে ভারতবর্ষে, চলত ও চালাত তারা এখানে লন্ডনেরই নির্দেশে।

তারপরে তো বণিক ব্রিটিশ শাসক হয়ে বসে! 

চট করে নয় অতটা, যতটা হয়েছিল আমেরিকান থার্টিন কলোনিতে। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে সুরাটে [গুজরাটের] কোম্পানির জাহাজ ভিড়িয়ে ঢোকে তারা ভারতবর্ষে, ফ্যাক্টরি [বাণিজ্যকুঠি] বসায় সেখানে ১৬১৫-তে, তারপরে একে একে বাংলাসহ সব অঞ্চলে। তারপরে ফতে করে কেল্লা [ফোর্ট, দুর্গ] গড়ে। মোগলের আশকারা (একেক ফরমানে) পেয়ে কোম্পানি দিনে দিনে জাঁকিয়ে বসতে থাকে গোটা ভারতবর্ষে। কোম্পানি ভারতবর্ষে কারবার সামলাত কয়েকটা করে ফ্যাক্টরি অঞ্চল নিয়ে একেকটা এজেন্সিতে ভাগ করে। এজিন্সির ক্ষমতা বাড়িয়ে উন্নীত করে প্রেসিডেন্সিতে : ১৬৮৪-তে মাদ্রাজ, ১৬৮৭-তে বোম্বে, ১৬৯৯-তে ফোর্ট উইলিয়াম ইন বেঙ্গল। ফ্যাক্টরি এলাকার ভার দেয় ‘Chief and Council of Factor’-এর হাতে, এজেন্সির ভার দেয় ‘Chief and Council of Agency’-এর হাতে, আর প্রেসিডেন্সির ভার দেয় ‘Governor and Council of Presidency’-এর হাতে। পেতে পেতে কোম্পানি পেয়ে যায় (১৬৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই) যুদ্ধ ঘোষণার, সন্ধি করার, নিজস্ব মুদ্রা বানাবার এবং হস্তগত এলাকার শাসন-বিচার পরিচালন ও তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনকানুন প্রণয়নের ক্ষমতা, নতুন নতুন সব চার্টারে (প্রথম চার্টারের পনেরোবছরী মেয়াদটা বেমেয়াদি করে পায় ১৬০৯-এর চার্টারে)।

সে-চার্টারে কোম্পানি পায় ভারতীয় উপমহাদেশসহ গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এবং এগুলোতে চলাচলের [সমুদ্র] পথে যত দ্বীপ-শহর-বন্দর-নগর চোখে পড়ে সবখানে ইংলিশরাজের পক্ষে একচেটিয়া বাণিজ্য চালাবার আর তার জন্য জায়গাজমি হস্তগত করা, কুঠি-কেল্লা বসানো, সৈন্যসামন্ত সঙ্গে রাখা, কোম্পানির কারবার ও প্রশাসন চালাবার আইনকানুন বানানো, বিচার-আচার, দরকারি সব কিছু করার অবাধ এখতিয়ার।

১৭৫৭-তে ক্লাইভরা যখন বাংলায় আসে তখন কেমন ছিল?

ভারতবর্ষে তখনও কোম্পানির কারবার ভাগ করা ছিল সেই মাদ্রাজ, বোম্বে ও বেঙ্গল (কেতাবি নাম : ‘Presidency of Fort William in Bengal at Calcutta’) এই তিনটা আলাদা আলাদা প্রেসিডেন্সিতে। ততদিনে অবশ্য সেই কোম্পানি আরেক কোম্পানির (১৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সৃষ্ট ‘English Company Trading to the East Indies’) সঙ্গে ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে একীভূত হয়ে ‘United Company of Merchants of England Trading to the East Indies’ হয়ে গেছে। ওদিকে, ‘কিংডম অব ইংল্যান্ড’ আর ‘কিংডম অব স্কটল্যান্ড’ মিলে ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে হয়ে গেছে ‘কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন’ (ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের ১৭০৬-এর আর স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টের ১৭০৭-এর বানানো আলাদা দুটি আইনের জোরে; এগুলো ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে পরিচিত ছিল আরো আগে থেকে, যখন ৪৩-৪১০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ছিল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ‘রোমান প্রভিন্স অব ব্রিটেন’, ‘ব্রিটেন’ নামটা আসে সেই থেকে)। ক্লাইভরা আসে খাঁটি ব্রিটিশ হয়ে।

ভারতবর্ষে কোম্পানির কারবার চালাত কীভাবে?

১৭৫৭-তে নবাব সিরাজের বাংলা যখন কোম্পানির বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির হাতে যায় তখনো কোম্পানি চলছিল রাজসনদে, লাগাম ছিল বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের হাতে। ১৭৭৩-এ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রেগুলেটিং অ্যাক্ট (কেতাবি নাম : East India Company Act 1772) দিয়ে বোর্ড অব ডিরেক্টর্সকে কবজা করে কোম্পানির ভারতের কারবারে পেছন থেকে হাত লাগানো শুরু করে। তারও বহু আগে সেই ১৬৩৯ থেকে ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দের তিন-তিনটা গৃহযুদ্ধের মহাবিদ্রোহ [Great Rebellion] আর ১৬৮৮ থেকে ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দের রক্তপাতহীন মহা-অভ্যুত্থান [Great Revolution] ঘটিয়ে খোদ রাজাকেই কবজা করে ব্রিটেনের শাসনভার হস্তগত করে এই পার্লামেন্টারিয়ানরা (বিশাল বিশাল জমিদারির অধিকারী অভিজাতরা; পার্লামেন্ট অভিজাতদেরই দখলে সর্বকালে, গণতন্ত্রের ভোটভেলকিতে কমজাতরা কেউ কখনো জিতে এলে তারাও উঠে যায় অভিজাতে, ভেলকিটা হোক রাতের অন্ধকারে কি দিনের আলেতেই, কমজাত কি অভিজাতই হোক, উঠে এসে শেষে হয় বজ্জাত!)। বাংলা হয়ে একটু একটু করে গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশের উপনিবেশ হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্টেরই হাতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭৭৩ থেকে একটার পর একটা East India Company Act দিয়ে ৮৫ বছর পেছন থেকে চালিয়েছে কোম্পানির নামে, তারপর ১৮৫৮-তে কোম্পানিকে সরিয়ে একটার পর একটা Government of India Act দিয়ে নিজেরা সামনে থেকে চালিয়েছে বাকি ৮৯ বছর ব্রিটিশরাজের নামে।           

ভারতবর্ষে ব্রিটিশের আইনকানুন প্রণয়নের কায়দাটা কী ছিল?  

ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ, বোম্বে ও বেঙ্গল তিনটা প্রেসিডেন্সিই ছিল একই ক্ষমতাসম্পন্ন এবং একে অপরের থেকে স্বাধীন। তিনটারই নিয়ন্ত্রণ ছিল সরাসরি লন্ডনে বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের হাতে, ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্টের পর থেকে ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল’ (ব্রিটিশ অর্থ মন্ত্রীর নেতৃত্বে আরো এক জন মন্ত্রী ও চার জন প্রিভিকাউন্সিল সদস্য সমন্বয়ে) এর  হাতে, আর ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন [গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট] এর পর থেকে ‘সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া’ ও তার কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (বা ‘ইন্ডিয়া কাউন্সিল’; এক জন ব্রিটিশ মন্ত্রীর নেতৃত্বে পার্লামেন্ট মনোনীত ১৫ জন সদস্য সমন্বয়ে; ইন্ডিয়া অফিস নামে সুপরিচিত)। আলাদা কোনো আইন-পরিষদ ছিল না কোনো প্রেসিডেন্সিতে। ‘Governor and Council of Presidency’-এর হাতে নিজ নিজ প্রেসিডেন্সি এলাকার শাসন-বিচার পরিচালন ও তার জন্য প্রয়োজনীয় আইনকানুন প্রণয়নের ক্ষমতাও দেয়া ছিল চার্টারে এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্টে। অর্পিত এই ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্সিতে তারা ‘Act’ নয়, Rules-Regulations-এর মতো অধস্তন আইনকানুন [Delegated Legislation, Subordinate legislation] প্রণয়ন করত।

তাহলে কি ব্রিটিশ ভারতে যেসব অ্যাক্ট হয়েছে (যেমন, তৃতীয় পর্বের প্রণীত আইনের কথাতে যেসবের উল্লেখ আছে) সেগুলো সব ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পাস করা আইন? 

না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টে (২২ এপ্রিল ১৮৩৪ থেকে বলবৎ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্টও বলা হয় একে) ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে ঘোষণা করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেলের পদটি গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়া’-য় উন্নীত করা হয় এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধিক্ষেত্র থেকে এলাকা কেটে নিয়ে আগ্রা তথা নর্থ-ওয়েস্ট-ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স গঠন করা হয় এবং মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রেসিডেন্সিকেও গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার অধীনে আনা হয় । প্রেসিডেন্সিগুলোর আইনকানুন প্রণয়নের কর্তৃত্ব কেড়ে নিয়ে সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের ওপর আইন প্রণয়নের এখতিয়ার দেয়া হয় ‘গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়া ইন কাউন্সিল’-এর হাতে। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে Law Member হিসেবে অতিরিক্ত আরো এক জন (৪ নম্বর) কাউন্সেলর যুক্ত করা হয় এই অ্যাক্টে। এই প্রথম ল-মেম্বার ছিলেন আমাদের ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের পেনাল কোডের প্রণেতা হিসেবে খ্যাত লর্ড থমাস বেবিংটন মেকলে।

এই ল-মেম্বারের কাজ কী ছিল?

গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে চার কাউন্সেলর ছাড়াও পদাধিকারবলে কমান্ডার ইন চিফও সদস্য ছিলেন, আর ছিলেন স্বয়ং গভর্নর জেনারেল, এই মোট ৬ জন। ৪ নম্বর কাউন্সেলর ল-মেম্বারকে বাদ রেখে ৫ জনে বসতেন শাসনকাজে, আর আইন প্রণয়ন কাজে বসতেন ৪ নম্বর কাউন্সেলর ল-মেম্বারকে নিয়ে ৬ জনে। স্পষ্ট নামকরণ না হলেও ব্রিটিশ ভারতে সূচনা হয় গভর্নর জেনারেলের আলাদা ‘Executive Council’ [শাসন পরিষদ] ও  ‘Legislative Council’ [আইন পরিষদ] এর। আইন প্রণয়নের কাজে গভর্নর জেনারেলের ৬ জনের এই কাউন্সিলকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুরূপ মর্যাদা দেয়া হয়। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয় ব্রিটিশ ভারতে পার্লামেন্টের মতো ‘গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়া ইন কাউন্সিল’-এ অ্যাক্ট প্রণয়ন। এক্তিয়ার ছিল সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের ওপর।     

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্টে (চার্টার অ্যাক্টও বলা হয়) ব্রিটিশ ভারতে আইন প্রণয়ন কাজে গভর্নর জেনারেলের ৬ সদস্যের ঐ কাউন্সিলে ল-মেম্বার ছাড়াও আরো ৬ সদস্য (চিফ জাস্টিস, গভর্নর জেনারেল মনোনীত ১ জন জাস্টিস এবং বোম্বে, মাদ্রাজ, বেঙ্গল ও আগ্রা এই ৪ প্রদেশ থেকে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ১ জন করে সিভিল সার্ভেন্ট) যোগ করে ১২ সদসের (এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ৫ সদস্যসহ) ‘Indian Central Legislative Council’ নামে প্রথম আলাদা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ গঠন করা হয়। সদস্যরা সবাই ছিল ব্রিটিশ।

তারপর?

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্টে (চার্টার অ্যাক্টও বলা হয়) ব্রিটিশ ভারতে আইন প্রণয়ন কাজে গভর্নর জেনারেলের ৬ সদস্যের ঐ কাউন্সিলে ল-মেম্বার ছাড়াও আরো ৬ সদস্য (চিফ জাস্টিস, গভর্নর জেনারেল মনোনীত ১ জন জাস্টিস এবং বোম্বে, মাদ্রাজ, বেঙ্গল ও আগ্রা এই ৪ প্রদেশ থেকে ১০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ১ জন করে সিভিল সার্ভেন্ট) যোগ করে ১২ সদসের (এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ৫ সদস্যসহ) ‘Indian Central Legislative Council’ নামে প্রথম আলাদা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ গঠন করা হয়। সদস্যরা সবাই ছিল ব্রিটিশ।

তারপর?

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চাপা দিতে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা Indian Councils Act-এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় এই আইন পরিষদে সর্বপ্রথম ভারতীয় বেসরকারি সদস্য (গভর্নর জেনারেলের, ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাকে Viceroy, বাংলায় বড় লাটও বলা হতো, মনোনয়নে ৬ থেকে ১২ জন) যোগ করা হয়। তখন এর নাম পরিবর্তন করে ‘Imperial Legislative Council’ রাখা হয়। ১৮৬১-এর এই অ্যাক্টে আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয় মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রদেশে, সেই সঙ্গে বেঙ্গল, পাঞ্জাব ও নর্থ-ওয়েস্ট-ফ্রন্টিয়ার প্রদেশেও Provincial Legislative Council নামে প্রাদেশিক আইন পরিষদ করা হয়। আইন পরিষদে ভারতীয় সদস্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রণিত ১৮৯২ ও ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের Indian Councils Act-এ। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের অ্যাক্টে সীমিত পরিসরে নির্বাচনের ব্যবস্থাও হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের গভর্নমন্টে অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টে কেন্দ্রের আইন পরিষদ হলো দ্বিকক্ষীয় : Council of State হলো উচ্চকক্ষ, Central Legislative Assembly হলো নিম্নকক্ষ। উভয় কক্ষেই ভারতীয়দের আসন সংখ্যা আরো বাড়লো, অল্প কিছু মনোনীত বাদে বাকিরা নির্বাচিত। প্রাদেশিক আইন পরিষদ থাকল এককক্ষীয়, প্রদেশ পড়লো দ্বৈত শাসনে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের করা ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের গভর্নমন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টে দেয়া হলো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন।

তাতে ১৯৩৭ সালের ‘Hindu Women’s Rights to Property Act’ প্রণয়নে ব্রিটিশের ভুলটা হলো কী?

সে-কথা হবে পরবর্তী পর্বে।             

(চলবে)

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।ইমেইল: moyeedislam@yahoo.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত