Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন

লেখক হিসেবে আমার দীর্ঘশ্বাস

শিবব্রত বর্মন। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

আমি গল্প-উপন্যাস যা-ই লিখি না কেন, আমার বন্ধু-বান্ধবের সন্তানদের বেশিরভাগ তা পড়তে পারে না। কেননা তারা বাংলা পড়তে পারে না। তাদের কিশোর চোখে বিস্ময় দেখার সাধ আমার আর পূরণ হবে না। লেখক হিসেবে এটা আমার দীর্ঘশ্বাস।

আমাদের পরের প্রায় পুরো প্রজন্ম ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে বড় হচ্ছে। তাদের শিক্ষার বাহন ইংরেজি। সন্দেহ নেই লেখাপড়া, জ্ঞানার্জনে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, ক্যারিয়ার নির্মাণে তারা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়, কিন্তু বাংলা ভাষার সঙ্গে তাদের নাড়ির যোগ শিথিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশ হিসেবে আমরা আগাচ্ছি বটে, জাতি হিসেবে পেছাচ্ছি। এটা এশিয়ার অন্য কোনো জাতির ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে আমার জানা নাই। অন্তত জাপানি, চীনা ও কোরিয়ান জাতির ক্ষেত্রে এটা যে ঘটছে না, আমি নিশ্চিত বলতে পারি।

সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি বাস্তবায়ন এখন অনেক ‘দূর কি বাৎ’ হয়ে গেছে, ২০ বছর আগেও এরকম ছিল না। আর এখানেই একুশে ফেব্রুয়ারি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। ভাষার লড়াইটা এখনই সবচেয়ে প্রকট। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে আমরা কোণঠাসা মনে করেছিলাম, এখন সেটা দেয়ালঠাসা। আর এ কারণে আমাদের একটা একুশে ফেব্রুয়ারিই দরকার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নয়। কিন্তু আমরা তো সেটা বিসর্জন দিয়ে বসে আছি।

একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রূপান্তর আমাদের জন্যে কোনো কাজের কথা হয়নি। এতে আমাদের দৃষ্টি অন্যত্র সরে গেছে। আমরা সত্তর কি তিয়াত্তর বছর আগের ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণীটাই বিস্মৃত হচ্ছি।

প্রথম কথা হলো, মাতৃভাষাকে রক্ষা ভাষা আন্দোলনের মূল লড়াই ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোয় আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা দাবি করেছিলাম। না হলে পূর্ব পাকিস্তান ইউনিটে দাপ্তরিক কাজ বাংলাতে চালাতে দিতে জিন্নাহর কোনো আপত্তিই ছিল না। আপত্তি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও একাসনে বসতে দেওয়া নিয়ে। পাকিস্তানে বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হলে কী হবে? হবে এটাই যে রাষ্ট্র চালানোর বিধিবিধান উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও লিখিত আকারে থাকবে। উর্দু ভাষার বিকাশের প্রতি রাষ্ট্রের যতটুকু মনোযোগ, ততটুকু মনোযোগ থাকবে বাংলার প্রতিও।

এটা ছিল এই জনপদে তখনকার উঠতি মধ্যবিত্তের নাগরিক, বৈষয়িক এবং আত্মিক উচ্চাভিলাষের রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীন দেশে গত অর্ধশতাব্দীতে যে মধ্যবিত্ত পল্লবিত হয়েছে, তারা বাংলা ভাষাকে প্রায় অপাংক্তেয় করে তুলেছে। ইত্যবসরে দেশ হিসেবে আমাদের গর্বের অনেক উপলক্ষ তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু নিজের ভাষা নিয়ে গর্ব করার অবকাশ খুব কমই অবশিষ্ট রেখেছি আমরা। ভাষার আদলে আমরা আমাদের রাষ্ট্রটাকে গড়ে তোলার সুযোগ হারিয়েছি। সেই সুযোগ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দিনে দিনে তিরোহিত হচ্ছে।

সাহিত্যিক উচ্চাভিলাষ আছে বলে আমি ভাষার ব্যাপারটিকে বড় করে দেখছি এমন নয়। ভাষা কেবলই যোগাযোগের মাধ্যম নয়। এটা ব্যক্তি এবং জনগোষ্ঠীর চিন্তা, স্মৃতি ও অভিলাষের বাহন।

লক্ষ্য করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এখন কোনো জটিল বিষয় বোঝাতে গেলে বা কোনো বিষয়ে জোর দিতে গেলে, অথবা রাগ বা অনুরাগ প্রকাশ করতে গেলে ওই অংশটুকু ইংরেজিতে বলেন। তাদের আচরণে এ কথাটা প্রচ্ছন্ন থাকে যে বাংলা ভাষা গুরুভাব প্রকাশের উপযুক্ত নয়। এমনকি সেটা লঘুভাব প্রকাশেরও অযোগ্য। এ কারণে গালাগাল দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা এ ভাষাকে পরিহার করি।

কিন্তু আমার মাথাব্যথা শুধু নিছক গর্ব করা না করা নিয়ে নয়। বাংলা ভাষার বাইরে আমাদের কোনো নিয়তি নেই। সমষ্টি হিসেবে নেই, ব্যক্তি হিসেবেও নেই। বাংলাকে পেছনে রেখে আমরা বিশ্বদরবারে হাজির হতে পারব না। আমাদের চিন্তা ও স্বপ্নের বাহন যদি ভিন্ন ভাষা হয়, তাহলে শূন্য হাতেই আমাদের সেখানে দাঁড়াতে হবে।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বটেই, শুনেছি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন প্রায় সব বিষয়ে শিক্ষকরা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেন এবং শিক্ষার্থীরা পরীক্ষাও দেন ইংরেজিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ ছাড়া আর কোনো বিভাগেই বোধ হয় কোনো অভিসন্দর্ভ বাংলায় লেখা হয় না। এই যদি হয় অবস্থা, তা হলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের বাংলায় রায় দিতে বলা, বা দিতে জবরদস্তি করা, তাদের প্রতি এক ধরনের অবিচারই বটে।

যারা ইংরেজি ভাষাকে বিজ্ঞান চর্চার বিকল্পহীন বাহন ভাবেন, তারা এ কথাটা ভুলে যান যে আমাদের সময়ে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেপারগুলো জার্মান ভাষায় লেখা হয়েছে, গত শতাব্দীতে দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো লেখা হয়েছে হয় ফরাসি নতুবা জার্মান ভাষায়। এমনকি তারও আগের শতাব্দীতে ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোও ইংরেজি ভাষায় রচিত হয়নি। এটির দৈববাণীতুল্য প্রথম লাইন “A spectre is haunting Europe – the spectre of Communism.” পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়েছে এভাবে: “Ein Gespenst geht um in Europe – das Gespenst des Kommunismus.”। এখনও সারা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ যেসব অভিসন্দর্ভ লেখা হয় তার সিংহভাগই অ-ইংরেজি ভাষায়।

অভিসন্দর্ভ বা কোনো গবেষণা নিবন্ধ লিখতে আপনি কোন ভাষা ব্যবহার করছেন, এটা নিছক একটা জাতীয়তাবাদী পছন্দ বা বাছাই নয়। একটি ভাষার যে নিজস্ব অভিজ্ঞতার জগত, যে বুদ্বুদের ভিতরে চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে, তা ওই ভাষার নিজস্ব এমন অনেক উপকরণ বহন করে, যেগুলো ভিন্ন ভাষায় মিলবে না। ভাষা এমনকি বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশেও বাড়তি কিছু যোগ করে। ইংরেজি ভাষায় space শব্দটা দিয়ে যা বোঝানো হয়, বাংলায় ‘মহাশূন্য’ কথাটির অর্থের ব্যাপ্তি তার থেকে ভিন্ন। দুটির শব্দের অর্থ চিরকালই ভিন্ন তলে অবস্থান করবে।        

আমরা বাংলাকে ত্যাগ করছি এমনভাবে যেন এ দেশে কখনও ভাষা আন্দোলন হয়নি, যেন বাংলার মর্যাদার প্রশ্নটি আমরা শুধু উর্দুর বিপরীতে তুলেছি, যেন এখন বাংলা ভাষা আমাদেরকে দেয়া একটা ‘মাল্টিপল চয়েস’ মাত্র।

অথচ, আমরা এটা গর্ব করে বলি, ভাষাভাষীর সংখ্যা বিচারে সারা দুনিয়ায় বাংলা এখন সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। স্থানটা ষষ্ঠও হতে পারে। কিন্তু ধরা যাক, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো কোনো ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, যেখানে নানা ভাষাভাষী যাত্রীর ছুটোছুটি, সেখানে একটা বুক স্টোরে বাংলা ভাষায় লেখা কোনো বই থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? শূন্য। আজ থেকে ১০ কি ১৫ বছর পরও এ সম্ভাবনা শূন্যই থাকবে। কিংবা আরও নিচে নেমে যেতে পারে। এমনকি ওই বিমানবন্দর দিয়ে দিনে ৫ হাজার বাংলাদেশি যাত্রী ভ্রমণ করলেও এ পরিস্থিতির হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে টেগোর ছাড়া কোনো বাংলাভাষী সাহিত্যিকের নাম কেউ বলতে পারে না। ৩০ কোটির এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাষা বিশ্ব দরবারে প্রায় অস্তিত্বহীন। এটা কোনো গর্বের বিষয় নয়।

কিন্তু আমার মাথাব্যথা শুধু নিছক গর্ব করা না করা নিয়ে নয়। বাংলা ভাষার বাইরে আমাদের কোনো নিয়তি নেই। সমষ্টি হিসেবে নেই, ব্যক্তি হিসেবেও নেই। বাংলাকে পেছনে রেখে আমরা বিশ্বদরবারে হাজির হতে পারব না। আমাদের চিন্তা ও স্বপ্নের বাহন যদি ভিন্ন ভাষা হয়, তাহলে শূন্য হাতেই আমাদের সেখানে দাঁড়াতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক।

আরও পড়ুন