Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

ঘর নয় যেন জ্বলন্ত উনুন

প্রচণ্ড গরমে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ঢাকার বস্তিবাসী। ছবি: সকাল সন্ধ্যা
প্রচণ্ড গরমে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ঢাকার বস্তিবাসী। ছবি: সকাল সন্ধ্যা

ঘরের চারদিকে টিনের দেয়াল। ৭ ফুট বাই ৭ ফুটের ঘরে ছাদহীন চালও যেন মাথা ছুঁই ছুঁই। ভেতরে পাতা একটিমাত্র চৌকি। এককোণায় রাখা মাটির চুলা। 

ঘরে ঢোকার জন্য একটি দরজা থাকলেও নেই কোনও জানালা। মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুরের হাজী লাট মিয়ার ঘাট এলাকার বরকতের বস্তির ছোট্ট এই ঘরে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে জীবনযাপন করছেন গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম।

ফাতেমার মতো আরও শতাধিক পরিবারের বাস এই বস্তিতে। কাঁটাসুর খালের পাশে জমে থাকা ময়লা পানি ও বাঁশের খুঁটির উপর বস্তিটি গড়ে তোলা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনাবিষয়ক প্রতিবেদন বলছে, সারাদেশে ১৮ লাখ ৪৮৬ জন মানুষ বস্তিতে থাকেন।

এর আগে ২০১৪ সালে বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ২২ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ জন মানুষ বস্তির বাসিন্দা। এদের মধ্যে ঢাকা মহানগরে বস্তির সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এসব বস্তিতে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের বাস।

যদিও এর দুই বছর পর ২০১৬ সালে বস্তি নিয়ে কাজ করা চারটি সংগঠন দাবি করে, সাড়ে ছয় নয়, ঢাকায় ৪০ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করেন।  

মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুরের বরকতের বস্তিতে বুধবার দুপুরে কথা হয় ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তীব্র তাপদাহে ঘর ছেড়ে একটি ভবনের ছায়ায় বসেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন বস্তির আরও অনেকে।

ফাতেমা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রোদের লাইগ্যা চাল দিয়া যেন আগুন পড়তাছে। চুলার মতো গরম হইয়া গেছে ঘরটা। এত গরম যে ভেতর থাকন যাইতেছে না। দুপুর বেলা তাই ঘর ছাইড়া বিল্ডিংয়ের ছায়াত বইসা থাকি।’     

ফাতেমা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার রিকশাচালক মো. রফিকের স্ত্রী। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় এই বস্তিতে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।

ফাতেমা বলেন, “ভিটামাটি সব নদীর পেটত যাওনের পর স্বামীর লগে ঢাকা আইসা এই বস্তিতে উঠছিলাম। এখানেই পোলা-মাইয়ার জন্ম। তাগো জন্মের পরে স্বামী আমাগো ছাইড়া চইলা গেছে। সেডাও ১২ বছর হইয়া গেল। এরপর বাসা-বাড়িত কাম কইরা পোলা-মাইয়া লইয়া কোনোরকমে জীবন কাটাইতেছি।’

একটার সঙ্গে আরেকটা ঘর লাগিয়ে গড়ে তোলা হয় বস্তি ছবি: সকাল সন্ধ্যা

ফাতেমার পাশে বসেছিলেন ৩০ বছর বয়সী আরেক গৃহকর্মী ইয়াসমিন। তার জন্ম এই বস্তিতেই। তার বাবা বাদশা মিয়া আগে রিকশা চালালেও অসুস্থতার কারণে এখন আর কোনও কাজ করতে পারেন না। আর মা জামেলা খাতুন বয়সের ভারে ন্যুব্জ।

বাসাবাড়িতে কাজ করে বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশোনা করেন ইয়াসমিন। বরকতের বস্তিতে ২ হাজার ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে একটি ঘরে থাকেন।

তীব্র গরম কীভাবে সামাল দিচ্ছেন জানতে চাইলে তার ঘর দেখার অনুরোধ করেন ইয়াসমিন। “চলেন নিজের চোখে দেখবেন কেমনে থাকি আমরা।” বলেন তিনি।

ইয়াসমিনের ঘরে ঢুকে দেখা যায়, মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে আছেন তার বাবা। মাথার উপরে সিলিং ফ্যান ঘুরলেও দরদর করে ঘামছেন তিনি। গরম কমাতে টিনের চালের নিচে কাগজের কার্টন গুঁজে দিলেও কোনও লাভ হয়নি তাতে।

ঘরের ভেতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গরমে শরীর ভিজে ওঠে। ইয়াসমিন বলেন, “ঘরে যত গরম, বাইরে রোদে দাঁড়াইয়া থাকলেও অতটা লাগে না। ঘরের ভেতরে থাকতেই পারি না।”   

বিদ্যুৎ চলে গেলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। ছবি: সকাল সন্ধ্যা

ইয়াসমিনের পাশের ঘরে থাকেন শাহানাজ আক্তার। তিনিও গৃহকর্মীর কাজ করেন। জানান, ২৬ বছর ধরে এই বস্তিতে আছেন তিনি।

শাহানাজের স্বামী কালাম মিয়া ভ্যানচালক। বলেন, “রোদের কারণে বেশিক্ষণ ভ্যান চালাইতে পারি না। আবার গরমে ঘরে থাকাও দায়। গরম থিকা বাঁচতে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত বাইরেই বইসা থাকি। এরপর ঘর একটু ঠান্ডা হইলে ঘুমাইতে পারি। এর মধ্যে যদি কারেন্ট চইলা যায়, তাইলে তো আর কথাই নাই।”

ঢাকার রায়েরবাজার নেকাব খান রোডের সালামের বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, চলাচলের জন্য মাঝখানে সরু গলিপথ রেখে দুপাশে বানানো হয়েছে সারি সারি ঘর। এই গলি দিয়ে একসঙ্গে দুজন মানুষের চলাচলের উপায় নেই।

ঘরের ভেতরে প্রচণ্ড গরমের কারণে বাইরের গলিতেই নিজেদের ঠান্ডা করেন বস্তিবাসী। এক শিশুকে সেখানেই বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে দেখা গেল।

ঘরের চেয়ে বাইরের তাপমাত্রা যেন কম। ছবি: সকাল সন্ধ্যা

সালামের বস্তির টিনের ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। জানালা নেই কোনোটাতেই। সবচেয়ে বড় ঘরের আয়তন ৮ ফুট বাই ৮ ফুট। আর ছোটগুলোর আয়তন ৫ ফুট বাই ৬ ফুট।

আয়তনভেদে একেকটি ঘরের ভাড়া আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। বস্তির বেশিরভাগ মানুষই রিকশা-ভ্যানচালক, শ্রমিক আর গৃহকর্মী। 

এই বস্তিতে থাকেন রিকশাচালক আব্দুল মান্নান। বয়স ৬৫। ২০ বছর আগে পরিবার নিয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার বাদলা গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। বলেন, “রোদ উঠলে টিনের চাল থেকে যেন আগুন বাইর হয়। তাই ঘরে না থাইকা ম্যালা রাত পর্যন্ত রাস্তাঘাটেই ঘুরি।”

সালামের বস্তিতে ৩ হাজার ৩০০ টাকার ঘরে ভাড়া থাকেন ঢালাইশ্রমিক মো. শফিউল্লাহ। তিন মাসের ছেলে ফাহাদ ও স্ত্রী ফাতেমাকে নিয়ে তার সংসার। গরমে আর সবার মতো হাঁসফাঁস করছেন তিনিও।

শফিউল্লাহ বলেন, “ঘরে ঢুকলে মনে হয়, ইটভাটার চুলায় ঢুকলাম। গরমের কারণে ছেলেটাও শান্তি পায় না। সারাদিন কান্নাকাটি করে।”

হাজারীবাগের কালুনগর বস্তি, সোনাতনগড় বস্তি ও বউবাজার বস্তিতে দেখা যায় একই দৃশ্য। গরমের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

বউবাজার বস্তির বাসিন্দা ও চা-দোকানি মনির হোসেন বলেন, “রোদে মানুষ ঘরে ঢুকে শান্তি খোঁজে। আমরা উল্টাডা করি। ঘরে থাকতে না পাইরা বাইরে বইসা থাকি। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নাই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত