Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

কাহালুর হাতপাখা বাতাস দিচ্ছে সারাদেশে 

কাহালুর আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রাম দুটিতে কয়েকশ বছর ধরে হাতপাখা বানানো হচ্ছে।
কাহালুর আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রাম দুটিতে কয়েকশ বছর ধরে হাতপাখা বানানো হচ্ছে।
Picture of আসাফ-উদ-দৌলা নিওন

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন

প্রচণ্ড গরমে গোটা দেশের মানুষের যখন উঠেছে নাভিঃশ্বাস, তখন ব্যস্ততা বেড়েছে বগুড়ার কাহালু উপজেলার দুটি গ্রামে। এই গ্রাম দুটিতে হাতপাখা তৈরি হয়। এবারের আগুন ঝরা গরম বাড়িয়েছে গ্রাম দুটির গ্রামের বাসিন্দাদের কাজ, সেই সঙ্গে আয়ও।

কাহালুর আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রাম দুটিতে কয়েকশ বছর ধরে তালের পাতা দিয়ে পাখা বানানো হচ্ছে। গ্রীষ্মপ্রধান এই দেশে বছরে ছয় মাস পাখা তৈরির মৌসুম তাদের। চৈত্র-বৈশাখ বিক্রির মূল সময়।

মোটামুটি ছয় মাসে গ্রাম দুটি থেকে অন্তত ৮ কোটি টাকার পাখা বেচা-কেনা হয়ে থাকে বলে দাবি করেন কারিগররা।

একটা সময় ছিল, যখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। তখন গরমে মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল হাতপাখা। এর চাহিদা এখন কমেছে, কিন্তু প্রচলন ফুরোয়নি। এবার এপ্রিলের শুরু থেকে তাপদাহ হাতপাখার ব্যবসাকে যেন দিয়েছে নতুন জীবন।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাহালুর পাইকড় ইউনিয়নে পাশাপাশি দুই গ্রাম আড়োলা ও যোগীরভবনে গিয়ে দেখা যায় পাখা তৈরির ব্যস্ততা।

গ্রাম দুটির প্রায় সবাই হাতপাখা তৈরিতে যুক্ত। সব বাড়ির দরজায় বা উঠানে ছড়িয়ে রয়েছে তালপাতা, ডাল। সেখানে একসঙ্গে বসে কাজ করছে নারী-পুরুষরা।

কেউ পাতা কাটছে, কেউ সেলাই করছে। আবার কেউ তৈরি হওয়া পাখায় তুলি দিয়ে রঙের আচড় কাটছে। সংসারের কাজের ফাঁকেই সবাই মন দিচ্ছেন পাখা বানানোয়।

আড়োলার উত্তর আতাল পাড়ায় কথা হয় যুবক এরশাদ আলীর সঙ্গে। বাড়ির সামনের গাছের ছায়ায় বাবা-মার সঙ্গে বসে কাজ করছিলেন তিনি। তিনি যেমন কারিগর, তেমন তালপাখার পাইকারি ব্যবসাও আছে তার।

আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রাম দুটিতে ঘরে ঘরে কয়েকশ বছর ধরে হাতপাখা বানানো হচ্ছে।

এরশাদ তার দাদার কাছে শুনেছেন, এই এলাকায় যোগীর রাজা থাকতেন। রাজার দরবারে বাতাসের জন্য পাখা দরকার পড়ত। সেসসব পাখা আনা হতো অন্য অঞ্চল থেকে, অনেক টাকা খরচ করে। তখন রাজা নিজেই লোক পাঠিয়ে পাখা বানানো শেখান। সেসব কারিগরদের হাত ধরেই এই এলাকায় শুরু হয় পাখা বানানোর প্রচলন।

এরশাদ আলীর শোনা গল্পের কোনও প্রামাণ্য দলিল পাওয়া না গেলেও গ্রামের সবাই কয়েক পুরুষ ধরে পাখা তৈরি করে যাচ্ছে।

এরশাদ বলেন, প্রতি মৌসুমে প্রতি ঘরে অন্তত দুই লাখ পকেট পাখা তৈরি করা হয়। আর হাত পাখা তৈরি হয় আরও এক থেকে দেড় লাখ।

“একেকটা ঘরে প্রতি সিজনে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা আয় করে। এখানে খরচ অর্ধেক। বাকিটা লাভ।”

এরশাদের বাড়ির পাশে কথা হয় আরেক কারিগর মো. জহুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনিও ‘বাপ-দাদার আমল’ থেকে পাখা তৈরি দেখে আসছেন।

“তাদের দেখাদেখি আমরাও করছি। আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে এ কাজ শুরু হয়। তখন পাতা নিয়ে ওষুধ দিয়ে আমরা তুলে রাখি। পরে ফাগুন মাসে পাতা নিয়ে পাখা বানানো শুরু হয়।”

পাশের জেলা জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকে তালপাতা আসে, সেগুলো কিনে নিয়ে বাসায় বসে পাখা বানানো হয়।

তিন থেকে চার সদস্যের একটি পরিবার দিনে ১০০টি পাখা তৈরি করতে পারে বলে জানান জহুরুল।

কারিগররা জানান, আশ্বিন মাস থেকে তারা তালপাতা সংগ্রহ শুরু করেন। এরপর শীত পেরিয়ে যখন মাঠের কাজ শেষ হয়, তখন পাখা তৈরিতে লেগে পড়েন। এভাবে বর্ষার আগে পর্যন্ত চলে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ।

আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রাম দুটিতে তৈরি হাতপাখা সারাদেশে যায়।

এই এলাকায় মোট পাঁচ ধরনের পাখা তৈরি হয়। ডাট পাখা, ঘুরকি, পাটি, পকেট ও আমান পাখা। আড়োলা গ্রামের অন্তত ৫০০ ঘর আছে, তার মধ্যে ১০০ ঘর ডাট পাখা বানায়। ১০০ ঘর ঘুরকি, পাটি ২০ ঘর ও পকেট পাখা বানায় ১৫০ ঘর। এর মধ্যে অনেক পরিবার আছে যারা কয়েক ধরনের পাখাই তৈরি করেন। প্রায় একই রকম পরিবার আছে যোগীর ভবন গ্রামে।

পাইকড় ইউপির সদস্য, আড়োলা গ্রামের বাসিন্দা হায়দার আলী বলেন, “আড়োলা ও যোগীর ভবন গ্রামে প্রায় এক হাজার ঘর রয়েছে। এই এক হাজার ঘর থেকে অন্তত ৮-১০ কোটি টাকা পাখা তৈরি হয়। এই পাখা ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়।”

এখনকার বাজারে একশটি ডাট পাখা বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার টাকায়। ঘুরকি পাখা আড়াই হাজার, পাটি ৪ হাজার, পকেট পাখা ১২শ-১৪শ ও আমান পাখা ৫ হাজার টাকা দরে।

ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পাইকাররা গ্রাম দুটিতে যায় পাখা কিনতে। বিভিন্ন ওরশ বা মেলাতেও বিক্রি হয় এসব পাখা।

কারিগরদের সঙ্গে আলাপ করতে করতে দেখা মেলে সিরাজগঞ্জের হাট পাঙ্গাসী থেকে আসা আজিজার শেখ নামে এক পাইকারি ব্যবসায়ীর। এখান থেকে পাখা নিয়ে তিনি সিরাজগঞ্জের বাজারে ও মেলায় বিক্রি করেন।

দু বছর আগে এখান থেকে পাখা নেওয়া শুরু করেন জানিয়ে আজিজার বলেন, এবার পাখার দাম একটু বেশি।

পরিবারভিত্তিক এসব হস্তশিল্পের প্রায় সব কাজ হয় নারীদের হাতে। এ গ্রামের অধিকাংশ নারী কারিগর তৈরি হয়েছেন বিয়ের সুবাদে। এছাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া মেয়েরা দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে হাত লাগান পাখা তৈরিতে।

হাতপাখা বানানোর মূল কাজের বেশিরভাগই হয় গ্রামের নারীদের হাতে।

কত বছর ধরে কাজ করছেন, তার সঠিক হিসাব নেই অশীতিপর তাহেরা বানুর। জানালেন, বিয়ে করে এই এলাকায় আসেন তিনি। এর প্রায় তিন বছর পর পাখা বানানোর কাজ শেখেন। তখন থেকেই চলছে পাখা বানানো।

দক্ষিণ আতাল পাড়ার মেয়ে তানজিলা পাখা বানানো শিখেছেন দেখতে দেখতে। তিনি বলেন, “আমার বাবারা করতেছিল, ভাইয়েরা করে। আমরা শুধু রঙ দিচ্ছিলাম। এখন আমরা বানাই। দিন আড়াইশ টাকা করে পাই রঙ করে। আগে পাচ্ছিলাম এক টাকা, ৫০ পয়সা করে, এখন প্রতি পিস আড়াই টাকা করে পাই।”

তানজিলার ভাষ্য, “এই টাকা দিয়ে কেউ জায়জিনিস কিনে। কেউ সংসার চালায়, কেউ কিস্তি দেয়। মানে যায় যেমন পাখা বানায়, তেমনি টাকা আয় কর।”

এমনকি হাতপাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করতে স্বামীসহ বাবার বাড়িতে এসেছেন সাদিয়া। তার স্বামীর বাড়ি বগুড়া সদরের দাঁড়িয়াল এলাকায়, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। এখন কাজের চাহিদা নেই, তাই এবার হাতপাখা বানাতে এখানে এসেছেন। পরিকল্পনা করছেন, সামনের বার স্বামীর বাড়ি থেকে পাখা বানিয়ে বাবার বাড়িতে পাঠাবেন।

আড়োলা ও যোগীরভবন গ্রামের মানুষের মূল আয়ের উৎস হাতপাখা তৈরি। বংশ পরম্পরায় হাতপাখা বানালেও আজও তারা হস্ত বা কুটির শিল্পের কারিগর হিসেবে কোনও স্বীকৃতি পাননি। সরকারি নেক নজরও পড়েনি তাদের ওপর।  

টপি বেগম নামে আরেক গৃহবধূ এই গ্রামে এসেছেন প্রায় ১২ বছর আগে। বউ হয়ে আসার পর থেকেই যুক্ত হয়েছেন পাখা তৈরির কাজে।

তিনি বলেন, “আমরা যেভাবে কাজ করি, আজ পর্যন্ত কোনও স্বীকৃতি পাইনি। স্বীকৃতি মানুষ চাবে না? মানুষের সবি দরকার পড়ে।”

ইউপি সদস্য হায়দার আলী বলেন, “এর আগে দুবার আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু করা হয়নি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত