অনেক বছর ধরেই সঙ্গীতাঙ্গন থেকে দূরে ছিলেন এক সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল পেপার রাইমের লিড ভোকাল আহমেদ সাদ।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টায় ৫২ বছর বয়সে পার্থিব জীবনের সমাপ্তি ঘটালেন এই শিল্পী। প্রয়াত কণ্ঠশিল্পীর বন্ধু ও পেপার রাইম ব্যান্ড দলের প্রতিষ্ঠাকালীন ড্রামার অনিন্দ্য কবির অভিক এক ফেইসবুক পোস্টে এ খবর নিশ্চিত করেন। ব্যান্ডটি তার অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজে সাদকে স্মরণ করছে।
ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে সাদ কয়েকদিন আগে হার্ট অ্যাটাক করে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় প্রয়াত শিল্পী আহমেদ সাদের ছোটবেলার বন্ধু সুমন জামানের সঙ্গে। তারা ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বড় হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। একই সঙ্গে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েও। এমনকি ‘পেপার রাইম’ এর প্রতিষ্ঠাকালীন বেইজ গিটারিস্ট ছিলেন সুমন।
সুমন জামান বলেন, “সাদ ২০০৮ সাল থেকেই কণ্ঠনালীর ক্যান্সারে ভুগছিল। মাঝখানে অনেকদিন ব্যাংককে ছিল। সেটা সেরে গিয়েছিল। পরে আবার ওর ক্যান্সার ফিরে এসেছে মাসখানেক আগে। মূলত ওর অসুস্থতার কারণেই ২০০৯ সালে উদ্যোগ নেওয়ার পরও আর গান গাওয়া হয়নি।”
নব্বই দশকের মাঝামাঝি দ্যুতি ছড়িয়েছিল পাঁচ বন্ধু মিলে গড়ে তোলা পেপার রাইম ব্যান্ডটি। ১৯৯৪ সালে বের হওয়া তাদের একমাত্র অ্যালবামটির নামও ছিল ‘পেপার রাইম’।
সদ্য প্রয়াত ব্যান্ড শিল্পী সাদের জন্ম ১৯৭০ সালে। তিনি ভোকাল পাশাপাশি ব্যান্ডদলটির হয়ে হারমোনিকাও বাজাতেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গিয়েছেন।
‘পেপার রাইম’ ব্যান্ডের ইতিহাস
পেপার রাইমের শুরুর লাইন আপটা ছিল এরকম- কী বোর্ডে নাসের হক, বেইজ গিটারিস্ট সুমন জামান, গিটারে রাশেদ ইকবাল, অনিন্দ কবির অভিক ড্রামসে এবং আহমেদ সাদ ভোকাল। এদের প্রত্যেকেরই বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
নব্বই দশকের শুরুতে রাশেদ এবং সুমন ‘সাডেন’ ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নাসের এবং সাদ ছিলেন আরেকটি ব্যান্ড ‘স্ন্যাপস’ এর সদস্য। ১৯৯২ সালে জানুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই পাঁচ বন্ধু একই সঙ্গে একটি শো করেন। শো শেষে ওই রাতেই তারা একটি ব্যান্ড গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। সেই ব্যান্ডটি ‘পেপার রাইম’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
সেইসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের পাশের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারের একটি গ্যারেজে ছিল ব্যান্ডটির প্র্যাকটিস প্যাড। মূলত অনিন্দ কবির অভিক এর মা ছিলেন তখন শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট। সেই সূত্রেই তাদের সেখানে আখড়া গড়ে তোলা।
তবে প্রথম অ্যালবামটি বের হয় অবশ্য আরও দুই বছর পর। বের হওয়ার পরপরই অ্যালবামটি দারুণ হিট করে। বিশেষত অ্যালবামের ‘অন্ধকার ঘরে’ গানটি ব্যান্ড সংগীত শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে।
ওই গানটির তিন নম্বর প্যারাটি ছিল এমন-
“নিকষ কালো এই আঁধারে
স্মৃতিরা সব খেলা করে
রয় শুধু নির্জনতা
নির্জনতায় আমি একা…”
কেমন ছিল সেই অ্যালবাম
অ্যালবামে মোট ১০টি গান ছিল। গানগুলো হলো- বলো তো আকাশের কি রং, বৈশাখে, একবার বলে যাও, এলোমেলো, যখনি আকাশ, কেন যে সে, কখনো কি খুঁজেছো, মনে করো কোনও এক বিকেলে, তুমি কি আমায় ভুল বুঝেছো এবং বব ডিলানের ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড এর ছায়া অবলম্বনে ‘হাওয়ায় আসে বন্ধু’।
গায়ক আহমেদ সাদের অসম্ভব সুন্দর গায়কী ও হারমোনিকার পাশাপাশি মিউজিক কম্পোজিশন শুনে একবারও মনে হবে না বব ডিলানের গানটির নকল। আবার একবারও মনে হবে না মূল গানকে নষ্ট করে দিলো। এটি ছিল এ অ্যালবামের সবচেয়ে সাহসী কাজগুলোর মধ্যে একটি।
শেষ গান
একটি অ্যালবামের পরেই পেপার রাইম সদস্যরা নিজেদের ব্যস্ততার কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। তবে, ২০০৯ সালে আবারও ব্যান্ডটি গঠনের চেষ্টা করেন। অভিক দেশের বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে ২০১১ সালে ব্যান্ডে যোগ দেন। কিন্তু ভোকাল আহমেদ সাদ অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার সব পিছিয়ে যায়।
সবশেষে ‘আশিক মিউজিক’ লেবেলের হয়ে ‘আবার’ অ্যালবামটিতে ‘দাঁড়াও বন্ধু’ গানটি গান পাঁচ বন্ধুর ‘পেপার রাইম’। তানভীর জামানের লেখা লিরিক্সে এটি তাদের গাওয়া শেষ গান, যেটি রিলিজ হয় ২০১৯ সালে। এই গানেও পাওয়া যাবে ভোকাল সাদের দুর্দান্ত শক্তিশালী কণ্ঠ।