Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

লাকী আখান্দের মৃত্যুবার্ষিকী ও একটি বিস্মৃত কপিরাইট আন্দোলন

lucky akhand

মৃত্যুর অর্ধযুগ পেরিয়ে গেল লাকী আখান্দের। কিন্তু অধরাই রয়ে গেছে এই কণ্ঠযোদ্ধার শেষ স্বপ্ন। গানের সকল শিল্পীদের কপিরাইট ঠিকঠাক পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে কণ্ঠশিল্পীদের সেই সময়ে গড়ে তোলা আন্দোলনেও থেকেছেন প্রথম সারিতে। সেই আন্দোলন অবশ্য এখন বিস্মৃত।

লাকী আখান্দের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সেই আন্দোলনের সহযোদ্ধা সংগীত সংগঠক এবং জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান কুল এক্সপোজারের সিইও এরশাদুল হক টিংকুর কণ্ঠেও ঝরলো সেই আপসোস। মৃত্যৃর ঠিক আগে লাকী আখান্দ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, সেই শেষদিনগুলোতে পাশে ছিলেন টিংকু।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “লাকী ভাই শুধু নিজের গানের কপিরাইট চেয়েছিলেন এমন নয়। উনি চেয়েছিলেন সকল শিল্পীর গান কপিরাইটের আওতায় আসুক। উনার মৃত্যুর আগে আমরা এই বিষয়টা নিয়ে দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করি। অথচ আজকে উনার মৃত্যুর পর ৬ বছরে পেরিয়ে গেল। কিন্তু লাকী ভাই উনার গানগুলোর কপিরাইট পেলেন না।”

লাকী আখান্দের পারিবারিক অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা জানিয়ে টিংকু আরও বলেন, “লাকী ভাই যদি গানের রয়্যালিটি নিয়মিত পেতেন তাহলে আজকে কোন সমস্যাই থাকতোনা। উনার মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েরা বেশ অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অথচ উনার গানের রয়্যালিটি ঠিক মতো পেলেই কিন্তু খুব ভালোভাবে ওদের চলে যাওয়ার কথা।”

মৃত্যুর আগে লাকী আখান্দের চিকিৎসার তহবিল তুলতে সেই সময় ঢাকার মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক একটি কনসার্টের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। 

সে বিষয়টিও এসেছে টিংকুর আলোচনায়।

“একবার লাকী আখান্দকে হাসপাতালে দেখতে গেলেন আনিসুল হক। দুজনে আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আনিসুল হক লাকী ভাইকে বললেন যে তিনি তহবিল সংগ্রহের জন্য একটা বড় কনসার্ট আয়োজন করতে চান। যেখানে শুধু লাকী ভাইয়েরই গান গাওয়া হবে। এই কথা শুনে লাকী ভাই ভাবতে লাগলেন কাদের কাদের গান গাইতে বলা যায়। উনার চাওয়া ছিল পুরো কনসার্টের সংগীত পরিচালনা তিনিই করবেন। চেয়েছিলেন স্টেজে কয়্যার টিম পারফর্ম করবে।”

যদিও লাকী আখান্দের এইসব চাওয়ার বাস্তবায়ন আর সম্ভব হয়নি। 

১৯৫৬ সালের ৭ জুন পুরোনো ঢাকার এক সংগীতানুরাগী পরিবারে লাকী আখান্দের জন্ম।  

শৈশবেই লাকী আখান্দের সংগীতের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। বাবা আব্দুল আলী আখান্দের কাছেই তার সঙ্গীতের হাতেখড়ি। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আর্মির অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট। অবসরের পর গানের প্রতি জন্মে তার ভালোবাসা। সন্ধ্যার পর বসতেন হারমোনিয়াম নিয়ে। চলতো রাতভর গান। বাবার গান শুনে শুনে লাকীকেও পেয়ে বসে সঙ্গীতের নেশা। 

১৯৬৩-৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন ও রেডিওর সঙ্গীত অনুষ্ঠানে লাকী অংশ নিতেন শিশু শিল্পী হিসেবে। ১৩ বছর বয়সেই জিতে নেন আধুনিক সংগীতে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের পুরস্কার। আর ১৪ বছর বয়সে লাকী আখান্দের নাম এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এইচএইমভি ইন্ডিয়াও লাকীকে যখন সুরকার হিসেবে নিযুক্ত করে, তখন তার বয়স ছিল সবে ১৬। 

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে লাকী আখান্দ যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সংগীতশিল্পীর ভূমিকায় হন অবতীর্ণ। একে একে লিখে যান বেশ কিছু গান। সেখানে তার গানের মধ্যে ছিল ‘জন্মভূমি বাংলা মাগো একটি কথা শুধাই তোমারে’, ‘ওই চেয়ে দেখো পুব আকাশ ফিকে হলো, ভোর হলো, ভোর হলো পথের আঁধার আর নাই’, ‘আমরা গেরিলা, আমরা গেরিলা মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর’ ইত্যাদি।

দেশ স্বাধীন হলে যোগ দেন বাংলাদেশ বেতারে। চাকরিজীবনের শেষদিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন বেতারের সংগীত পরিচালক হিসেবে।

১৯৮৭ সালে ছোট ভাই হ্যাপি আখান্দের অকালমৃত্যু লাকীকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “বাবার কাছ থেকে যা জেনেছি, হ্যাপিকে শিখিয়েছি। হ্যাপিকে আমি অনেক দুঃখ দিয়েছি। তখন আমাদের অনেক অভাব ছিল, দুঃখ-যন্ত্রণা ছিল। তবে সংসারে যদি অভাব না থাকত, আমাদের ভেতরে যদি কষ্ট না থাকত, তাহলে আমাদের ভেতরে মিউজিক ঢুকত না।”

লাকী আখান্দ এর প্রথম অ্যালবামের নাম তার নিজের নামেই ‘লাকী আখান্দ’। প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। 

বহু জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। যার মধ্যে ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘মামনিয়া, ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’, ‘কী করে বললে তুমি’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘ভালোবেসে চলে যেয়ো না’ অন্যতম।

গানে ‘হামিং’-এর ব্যবহারে লাকী আখান্দ ছিলেন অনন্য। 

একই গান ভিন্ন ভিন্ন সুরে সংগীত আয়োজনের ক্ষেত্রে লাকী আখান্দ ছিলেন রীতিমতো বিষ্ময়কর। ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি সুরকার লাকী আখান্দ যেভাবে গেয়েছিলেন, সেই একই গান কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ভিন্ন সংগীত পরিচালনায়। 

ছোট ভাই হ্যাপি আখান্দকে নিয়ে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান লিখেছি’ গানটি বাংলাদেশের আধুনিক গানের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে।

নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ গানটিরও সুরকার ছিলেন লাকী আখান্দ।

২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল ক্যান্সারের সঙ্গে হেরে গিয়ে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন অমিত প্রতিভার এ শিল্পী। মৃত্যুর আগে অন্তত নিজের গানগুলোর কপিরাইট করতে চেয়েছিলেন লাকী। সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বিষয়টির কোন সুরাহা হয়নি। 

তার মৃত্যুতে দেশের সংগীত অঙ্গনে বিশাল শূন্যতা নেমে এলেও খুব দ্রুতই যেন তিনি বিস্মৃত হয়ে যান।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত