Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

এস আলমের পোড়া চিনিতে মাছ মরছে কর্ণফুলীতে

এস আলম গ্রুপের কারখানার গুদামে আগুন লাগার পর চিনি মেশানো পানি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। এরপর ভেসে উঠছে মরা মাছ।
এস আলম গ্রুপের কারখানার গুদামে আগুন লাগার পর চিনি মেশানো পানি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। এরপর ভেসে উঠছে মরা মাছ।
Picture of বিশেষ প্রতিনিধি, সকাল সন্ধ্যা

বিশেষ প্রতিনিধি, সকাল সন্ধ্যা

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষেই এস আলম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানা। দুদিন আগে সেখানে গুদামে আগুন লাগার পর পোড়া চিনি পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে পড়ছিল নদীতে। তাতে পানি দূষণের যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, তা সত্যি করে এখন মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখা যাচ্ছে।

বুধবার সকাল থেকে নদীতে মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সেই মরা মাছ ধরার জন্য অনেকে জাল নিয়ে গেছেন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে সেতুর নিচে ব্রিজঘাট এলাকায়। কাঁকড়াসহ কিছু জলজ প্রাণীও নদী উপকূলে মরে থাকতে দেখা গেছে।

এস আলম সুগার রিফাইনারির অবস্থান নদীর দক্ষিণপাড় থেকে ৭০০ মিটার দূরত্বে। সেতু পার হয়েই মইজ্জারটেক এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বামপাশেই কারখানাটি।

এস আলম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানার গুদামে সোমবার আগুন লাগে।

ব্রিজঘাটে এস আলমের নিজস্ব জেটি আছে। সাগরে বড় জাহাজে পণ্য আনার পর ছোট জাহাজে স্তানান্তর করে প্রথমে সেই ঘাটে ভেড়ানো হয়। সেই ঘাট থেকে মাটির নিচে স্থাপিত পাইপলাইনে ভোজ্যতেল এবং ট্রাকে করে অপরিশোধিত চিনি কারখানার ভেতরে নেওয়া হয়।

সোমবার বিকালে আগুন লাগে কারখানার চিনির গুদামে। তাতে ১ লাখ টন চিনি পুড়ে গেছে বলে এস আলম কর্তৃপক্ষ জানায়।

আগুন নেভাতে সোমবার থেকেই ফায়ার সার্ভিসের ১৪ ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে পানি ছিটাচ্ছিল। পরে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমানবাহিনীও। বুধবার সকালেও আগুন পুরোপুরি নেভানো যায়নি।

তিন দিন ধরে চলা আগুন নেভাতে লাখ টন পানি ছিটানো হয়। গুদামে পোড়া চিনি সেই পানির সঙ্গে মিশে নালা দিয়ে কর্ণফুলী নদীর ব্রিজ ঘাটসহ বেশ কটি এলাকায় পড়তে দেখা যাচ্ছে।

কর্ণফুলী হচ্ছে জোয়ার-ভাটার নদী। ফলে পোড়া চিনি নালা দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়লে একটি স্থানে সীমাবদ্ধ থাকছে না। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পুরো নদীর অন্তত দুই কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়েছে চিনি।

মঙ্গলবারও এস আলম গ্রুপ দাবি করেছিল যে পোড়া চিনি নদীতে ছড়ায়নি; তবে স্থানীয়রা দেখছেন উল্টো চিত্র।

এস আলম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানার গুদামে সোমবার আগুন লাগে। পোড়া চিনি মিশ্রিত পানি নদীতে পড়ার পর মাছ মরে ভেসে উঠলে তা ধরতে নামে স্থানীয়রা।

কর্ণফুলী নদীতে ভাসমান ছোট জাহাজের শ্রমিক আবদুল আলিমও বুধবার জাহাজ থেকে নেমে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন কর্ণফুলী নদীর উত্তরপাড়ের বাংলাবাজার এলাকায়।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মঙ্গলবার বিকাল থেকেই দেখেছি নদীর পানি ছোপ ছোপ কালো। জোয়ার থাকা পানি একস্থানে স্থির ছিল না।

“আজ সকাল থেকেই দেখি জাহাজের পাশেই চিংড়ি, মইল্লা মাছ ভেসে উঠেছে। পরে জাহাজের পাশে থাকা ছোট ডিঙ্গিতে নেমে জাল নিয়েই মাছ ধরেছি। বেশ কিছু মাছ ধরা পড়েছে জালে।”

এস আলম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানার গুদামে সোমবার আগুন লাগে। পোড়া চিনি মিশ্রিত পানি নদীতে পড়ার পর মাছ মরে ভেসে উঠছে।

নদী পাড়ের শিকলবাহা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ইলিয়াস জাবেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়েছে শিকলবাহা খালের পাশে। কারণ পোড়া চিনি সরাসরি সেখানেই নদীতে পড়েছে।

“সকাল মাছ ধরা পড়ার খবর পেয়ে পাড়ার ছেলে-পেলে-বুড়া সবাই নদীতে যায়। কেউ ঝাঁকি নিয়ে, কেউ আবার জাল নিয়ে গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ মাছ ধরা পড়েছে হাতে।

একেকজন ৪/৫ কেজি করে মাছ পেয়েছে। বেশিরভাগই চিংড়ি আর বাইলা।”

নদীতে মাছের মৃত্যুর খবর টিভির খবরে দেখেছেন বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন ঘটনাস্থলে যাচ্ছি টীম নিয়ে। নমুনা সংগ্রহ করব। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ।”

মাছ মরছে কেন

চিনি দূষণে মাছের মৃত্যুর কারণ জানতে সকাল সন্ধ্যা যোগাযোগ করে চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, দূষিত এই পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় মাছ মারা যাচ্ছে।

“অপরিশোধিত চিনি আগুনে পুড়ে গিয়ে বর্জ্য হিসেবে কর্ণফুলী নদীতে পড়েছে। নালার মাধ্যমে সরাসরি নদীতে পড়ায় পরিবেশগত প্রভাব পড়বে। পানির মাত্রা মান কমে গিয়ে ইকোলজিক্যাল অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে। আর পানিতে অক্সিজেন লেভেল কমে যায়ায় মাছগুলো মারা পড়ছে।”

নদীর পাশেই কারখানা গড়ার আগে দূষণ ঠেকানোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনির উদ্দিন বলেন, “বিশেষ করে বিওডি (বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড), সিওডি (কেমিকেল অক্সিজেন ডিমান্ড) এবং ডিও (দ্রবীভূত অক্সিজেন) মাত্রায় হেরফের হতে পারে।

“পানির মান কমার সাথে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে এবং নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে। মাছ মারা যাওয়ার মাধ্যমেই আমরা প্রমাণ পেলাম।”

এস আলম গ্রুপের চিনি পরিশোধন কারখানার গুদামে সোমবার আগুন লাগে। পোড়া চিনি মিশ্রিত পানি নদীতে পড়ার পর মাছ মরে ভেসে উঠছে।

স্থানীয় ইছানগর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগুনে পোড়া চিনিতে কারখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানি চিনির সঙ্গে মিশে নদীতে পড়েছে।

আগুন নেভাবে কী পরিমাণ পানি গত তিন দিনে ছিটানো হয়েছে, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। তবে বেশি পানি যে ছিটানো হয়েছে, তা জানা যায় ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশার কথায়।

তিনি বলেন, “অপরিশোধিত চিনি মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের একটি যৌগ। কার্বন ও অক্সিজেন দুটোই আগুন জ্বলতে সহায়তা করে।

“৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অপরিশোধিত চিনি গলে গিয়ে ভোলাটাইল কেমিকেলে (ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক) পরিণত হয়। এই কেমিকেলের আগুন নেভাতে আমরা যত পেয়েছি, ততই পানি ঢেলে নেভানোর চেষ্টা করেছি।”

এস আলম গ্রুপের কারখানার গুদামে আগুন লাগার পর পোড়া চিনি মেশানো পানি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে।

চিনি মেশানো পানি নদীতে যাওয়া ঠেকাতে এস আলম কর্তৃপক্ষের কোনও পদক্ষেপই দেখেনি স্থানীয়রা।

অভিযোগের বিষয়ে এস আলম গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ কিছু বলতে চাননি।

তবে মঙ্গলবার এস আলম গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (অ্যাডমিন) আখতার হাসান বলেছিলেন, “আগুনে পোড়া চিনি কর্ণফুলীতে যাচ্ছে না। এসব নিজস্ব জমিতে ডাম্পিং করা হচ্ছে। আর নদীতে গেলেও তা নদী কিংবা জীব-বৈচিত্র্যের কোনও ক্ষতি হবে না। কেননা এখানে কোনও ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই।”

তার একদিন পরই মাছ মরে ভেসে উঠে তার কথার অসারতা প্রমাণ করল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত