Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

অদৃশ্য প্লাস্টিকে সয়লাব পরিবেশ, কমানোর উপায় কী

plastic
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে গত প্রায় দুই বছর ধরে আলোচনা চলছে। জাতিসংঘের প্লাস্টিক দূষণ সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি আলোচনা কমিটি এই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

কানাডার অটোয়াতে গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে সেই আলোচনার চতুর্থ রাউন্ড। এবারের আলোচনায় ১৭৫টি দেশের আলোচকদের মধ্যে মতবিরোধের প্রধান বিষয় ছিল প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করা নিয়ে। অনেক দেশই তা করতে রাজি হচ্ছে না।

প্লাস্টিকের বেশিরভাগই জীবাশ্ম জ্বালানি ও নানা বিষাক্ত রাসায়নিক থেকে তৈরি হয়, যা ব্যবহারের পরেও পরিবেশ দূষণ করে। কারণ এটি সহজে বা সম্পূর্ণভাবে পঁচে না। তাই প্লাস্টিক দূষণ রোধে দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বব্যাপী লড়াই চলছে।

সেই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের মার্চে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদ (ইউএনইএ) প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক একটি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য ১৭৫টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি আন্তঃসরকারি আলোচনা কমিটি গঠন করা হয়। ২০২৪ সালের মধ্যেই একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ওই কমিটি।

২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ওই কমিটি আলোচনা শুরু করে। প্রথম তিন রাউন্ডের আলোচনা হয় উরুগুয়ে ফ্রান্স ও কেনিয়ায়। চতুর্থ রাউন্ডের আলোচনা হল কানাডায়।

কিন্তু চার দফা আলোচনার পরও প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানে চূড়ান্ত কোনও রূপরেখা তৈরি করতে পারেনি ওই কমিটি। চলতি বছরের শেষ দিকে (নভেম্বর-ডিসেম্বরে) দক্ষিণ কোরিয়ায় চূড়ান্ত পর্বের আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

একমাত্র যুক্তরাজ্য গত মাসে বলেছিল, প্লাস্টিকযুক্ত ভেজা টিস্যু নিষিদ্ধ করার জন্য তারা আইন করবে। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ভেজা টিস্যুগুলো ব্যবহারের পর সেগুলো থেকেও পরিবেশে ক্ষতিকারক মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ায়।

আমরা জানি যে, প্লাস্টিকের ব্যাগ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমরা যেটা জানি না, তা হল আমাদের নিত্য ব্যবহার্য্য আরও অনেক জিনিসেই অদৃশ্য প্লাস্টিক বা মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে, যা আমরা দেখতে পাই না। ফলে শুধু প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেই প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ হবে না।

অদৃশ্য প্লাস্টিক এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক কী

এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে প্লাস্টিকের তৈরি বলে মনে হয় না, কিন্তু ব্যবহারের পর সেগুলো থেকেও পরিবেশে প্লাস্টিক ছড়ায়। তাদের একটি ওয়েট ওয়াইপস বা ভেজা টিস্যু।

কানাডার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির স্কুল ফর রিসোর্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধ্যাপক টনি ওয়াকার বলেন, “অদৃশ্য প্লাস্টিক সর্বত্রই রয়েছে।” অধ্যাপক টনি ওয়াকার সায়েন্টিস্টস কোয়ালিশন ফর অ্যান ইফেক্টিভ প্লাস্টিক ট্রিটিরও একজন সদস্য।

এই অধ্যাপক বলেন, “আমাদের চেয়ার, টেবিল ও কম্পিউটার থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য্য বেশিরভাগ জিনিসেই কোনও না কোনও ধরনের প্লাস্টিক রয়েছে।”

তবে তার মতে, সমস্ত প্লাস্টিক বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। উদারহণস্বরূপ, আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক। কারণ আসবাবপত্র আমরা দশকের পর দশক বা দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করি। ফলে সহসাই এর পরিবেশ দূষণে অবদান রাখার সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, একবার ব্যবহারযোগ্য যেসব জিনিসে প্লাস্টিক আছে আমাদেরকে বরং সেগুলো কমানো বা বাদ দেওয়ার প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এগুলো আমাদের আবর্জনার ভাগাড়ে হাজার হাজার টন প্লাস্টিক যোগ করছে। এসব থেকেই পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়ায়।

মাইক্রোপ্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা, যা এমনকি আমাদের খাদ্যেও প্রবেশ করতে পারে। যেমন সমুদ্রের পানিতে প্লাস্টিক কণা মিশলে তা মাছের পেটে চলে যায়। আর সেই মাছ খেলে তা আমাদের দেহের রক্তেও মিশে যেতে পারে।

২০২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধরা পড়ে, মানুষের রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিক কণা ঢুকে পড়েছে। রক্তে থাকা ০.০০০৭ মিলিমিটার পর্যন্ত ছোট প্লাস্টিক কণাও শনাক্ত করা গেছে।

এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অনেকের রক্তে একাধিক ধরনের প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে।

ওই গবেষণার অর্থায়ন করেছিল ডাচ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমন সিজ। সংস্থাটি প্লাস্টিক দূষণ কমাতে কাজ করা একটি সামাজিক উদ্যোগ।

এরপর যুক্তরাজ্য সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করে।

অধ্যাপক টনি ওয়াকার বলেন, এমনকি তথাকথিত ‘বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক’ বা যা একবার ব্যবহারের পর পঁচনযোগ্য বা প্রাকৃতিকভাবে ভেঙে যেতে সক্ষম বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকতে পারে।

অপ্রত্যাশিত যেসব জিনিসে প্লাস্টিক থাকতে পারে

প্লাস্টিকের ব্যাগ ছাড়াও নিত্য ব্যবহার্য আরও অনেক জিনিসেই প্লাস্টিক থাকে। যেমন:

চুইংগাম

চুইংগাম তৈরিতে ব্যবহৃত একটি মূল উপাদান হল পলিভিনাইল অ্যাসিটেট। এ কারণে চুইংগাম খাওয়ার পরও তা সহজে পঁচে না। চুইংগামে থাকা প্লাস্টিক ভেঙ্গে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।

টি ব্যাগ

গরম পানিতে ডোবানোর পর আকৃতি ঠিক রাখতে বেশিরভাগ টি ব্যাগে পলিপ্রোপিলিন নামক প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। অনেক কফি ফিল্টারেও তা থাকে।

সানস্ক্রিন

সানস্ক্রিন তৈরিতেও বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক ব্যবহার করে অনেক ব্র্যান্ড।

অ্যালুমিনিয়াম ক্যান

সোডা ধারণ করে এমন অনেক অ্যালুমিনিয়াম ক্যানে প্লাস্টিকের একটি আস্তরণ থাকে যাতে সোডায় থাকা অ্যাসিড ক্যানের অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে না পারে।

কাগজের রসিদ

অনেক রসিদ থার্মাল কাগজে মুদ্রিত হয়, যা চকচকে করার জন্য প্লাস্টিকের প্রলেপ দেওয়া হয়। এর ফলে বেশিরভাগ কাগজের রসিদ রিসাইকেল হয় না।

প্রসাধন সামগ্রী ও লন্ড্রি পণ্য

অনেক ব্র্যান্ডের টুথপেস্টেই ক্ষুদ্র পুঁতি বা প্লাস্টিকের অনুপুঁতি থাকে যা এক্সফোলিয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। এগুলো পানিতে ক্ষয় বা দ্রবীভূত হয় না। ক্ষুদ্র পুঁতি ফেসিয়াল স্ক্রাব, মেকআপ পণ্য এবং লন্ড্রি ডিটারজেন্ট পাউডারেও পাওয়া যায়।

এ ছাড়াও আরও নানা জিনিসে এমন প্লাস্টিক উপাদান যা আছে যা আমরা খালি ছোখে দেখতে পাই না।

কেন কিছু দেশ প্লাস্টিক উৎপাদন কমাতে চায় না

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ মূলত অর্থনৈতিক। ওয়াকার ব্যাখ্যা করে বলেন, “প্লাস্টিক পণ্য বা পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে অনেক দেশেরই বিশাল লাভ-ক্ষতির হিসাব জড়িত। সেসব দেশের বিশ্বাস, প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করলে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

কিন্তু পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে দিয়ে আলোচনা কমিটিতে থাকা দেশগুলোকে চলতি বছরের মধ্যেই প্লাস্টিক উৎপাদন বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানিয়েছেন।

ওয়াকার উল্লেখ করেন, প্লাস্টিক একটি আন্তঃসীমান্ত দূষণকারী উপাদান, যা নদী ও সমুদ্রর মাধ্যমে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। যার অর্থ এই সমস্যা মোকাবেলায় সব দেশেরই স্বার্থ রয়েছে।

ওয়াকার বলেন, “এমনকি প্লাস্টিক এখন বায়ুমণ্ডলেও রয়েছে, আমরা যে বাতাসে শ্বাস নেই তার সঙ্গেও মিশে গিয়ে প্লাস্টিক বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।”

আরও দেরি হওয়ার আগেই চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তঃসরকারি আলোচনা কমিটিকে সব মতবিরোধ দূরে সরিয়ে রেখে প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধে অবিলম্বে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। আর নয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। সারা বিশ্বেই প্লাস্টিক উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি) বলেছে, যদি কিছুই পরিবর্তন না হয় তাহলে ২০৬০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক প্লাস্টিকের বার্ষিক উৎপাদন তিনগুণ হয়ে যাবে।

কমিটিতে গ্রিনপিসের প্রতিনিধি দলের প্রধান গ্রাহাম ফোর্বস বলেছেন, ব্যাপকভাবে প্লাস্টিক উৎপাদন কমানো ছাড়া প্লাস্টিক দূষণের অবসান ঘটানো অসম্ভব।

টনি ওয়াকার বলেন, “বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বছরে ৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বাকি ৯১ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।”

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত