Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ভোটের মাঠে ‘গুপ্তসেনা’ আইআইটির বেকাররা

আইআইটি ও আইআইএম এর মতো ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকদের দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণার কৌশল নির্ধারণে কাজ করায় রাজনৈতিক দলগুলো। ছবি: এএফপি।
আইআইটি ও আইআইএম এর মতো ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকদের দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণার কৌশল নির্ধারণে কাজ করায় রাজনৈতিক দলগুলো। ছবি: এএফপি।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

“একটি যাত্রীবাহী বিমানে কতগুলো টেনিস বল আটতে পারে?”

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক করা এক তরুণ নীরাজ। চাকরির জন্য তিনি গিয়েছিলেন নেশন উইথ নমো (এনডাব্লিউএন) নামে ভারতের শাসক দল বিজেপির একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ফার্মে। সেখানেই তাকে উপরের প্রশ্নটি সমাধানে ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল।

প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে ভারতের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক করাদের নিয়ে গঠিত ছোট একটি টিমে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে তাদেরকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের সমীক্ষা, ভোটার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল।

কারা বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে না, তা বের করাই ছিল তাদের মূল কাজ। তাদের বয়স, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা দলে ভাগও করে তারা।

এরপর প্রতিটি দলের সাধারণ উদ্বেগ, সমস্যা বা ভয় খুঁজে বের করে তারা। বিজেপির পক্ষে কীভাবে একে কাজে লাগানো যায়- তার কৌশলও তৈরি করে তারা। বিজেপির নজরদারির মধ্যেই তাদের এসব কাজ করতে হয়।

নীরাজ বলেন, “ আমরা যারা জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (জেইই) পাস করেছি তারা সমস্যা সমাধানে ভালো।”

মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নীরাজ তার আসল নাম প্রকাশ করেননি।

ভারতে শীর্ষ সরকারি প্রকৌশল, আইন ও ব্যবস্থাপনা কলেজে ভর্তি হতে হয় বিভিন্ন সর্বভারতীয় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে। যেমন ২৩টি আইআইটিতে ভর্তি হতে চাইলে দিতে হয় জেইই। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তবে মাত্র ২-৩ শতাংশ শিক্ষার্থী শীর্ষ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পান। তাদেরই একজন নীরাজ।

নীরাজের মতো ভারতের শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিজনেস স্কুল থেকে পাস করা শত শত গ্র্যাজুয়েট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাকরি হিসেবে রাজনৈতিক প্রচারে যোগ দিয়েছেন। বেশি বেতনের করপোরেট চাকরি পাওয়ার আগে কিছু সময়ের জন্য তারা এই কাজ করেন।

আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অথবা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) থেকে এমবিএ ডিগ্রি থাকলে ভালো চাকরি নিশ্চিত। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই ও টুইটারের সাবেক সিইও পরাগ আগরওয়াল আইআইটির ছাত্র।

আর পেপসিকোর প্রাক্তন সিইও ইন্দ্রা নুইয়ের ছিলেন আইআইএম এর ছাত্র। কিন্তু গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাস থেকে নিয়োগ দেওয়ার প্রথা ও প্রযুক্তি সংস্থাগুলোতে কর্মীর চাহিদা কমায় আইআইটি ও আইআইএম থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের বেশ কিছুটা সময় বেকার থাকতে হচ্ছে।

এই গ্র্যাজুয়েটরা বিপুল পরিমাণ তথ্য ব্যবস্থাপনা ও বিশ্লেষণে দক্ষ হওয়ায় রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তাদের কদর বেশি।

ভারতে রাজনৈতিক পরামর্শক শিল্পের বাজার প্রায় ৩০ কোটি ডলারের (২ হাজার ৫০০ কোটি রুপির বেশি)। স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ অন্যান্য জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলগুলোতে পরামর্শক নিয়োগের প্রবণতা বাড়তে থাকায় এই বাজার বাড়ছে।

আইআইটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে স্নাতকদের আকৃষ্ট করতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফেলোশিপ দেয়। এসব চাকরি সাধারণত চুক্তিভিত্তিক। মেয়াদ তিন মাস থেকে তিন বছর। তবে বেতন বেশ ভালো।

এছাড়া বিভিন্ন সুবিধাসহ দেশের ভবিষ্যত বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করা হয় এসব চাকরিতে।

পলিটিক অ্যাডভাইজার নামে দিল্লির একটি রাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থার পরিচালক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার অঙ্কিত লাল বলেন, “এই চাকরিতে কোনও উপায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকার আকর্ষণও রয়েছে।”

নীরাজ ও তার টিমের সদস্যরা ত্রিপুরায় ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজ করেছিলেন। রাজ্যটিতে বিজেপি পুনঃনির্বাচিত হওয়ার আশায় ছিল। তবে নীরাজ ও তার টিমের বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে, বিজেপি রাজ্যটির উত্তরাঞ্চলে ভালো অবস্থানে আছে।

কিন্তু অমরপুর নির্বাচনী এলাকায় ভোটাররা অন্য দলের দিকে ঝুঁকেছে, যেখানে ছবিমুড়াসহ কয়েকটি গ্রামে আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস। অঞ্চলটি বহু বছর ধরে অবহেলা ও দারিদ্রের শিকার।

জামাতিয়া নামে একটি গোষ্ঠীর মানুষরা ককবরক ভাষায় কথা বলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘ত্রিপুরার আমাজন’ নামে পরিচিত এই দুর্গম ও বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে তাদের বাস।

ছবিমুড়ায় মাঠ জরিপের পর নীরাজরা বিজেপির জন্য একটি সমাধান খুঁজে পান। তার দেখতে পান, সেখানে কয়েকটি প্রভাবশালী জামাতিয়া পরিবারকে পক্ষে আনা গেলে পুরো এলাকার ভোট পাওয়া যাবে।

নীরাজ বলেন, “তারা বেশ দরিদ্র। তাদের একমাত্র চাওয়া হলো বাড়ির চারপাশে একটি সীমানা প্রাচীর।”

বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে বিষয়টি জানানোর দুই থেকে তিন দিন পরই জামাতিয়া সদস্যদের প্রায় ৮০টি বাড়ির জন্য চার ফুট উঁচু মাটির সীমানা প্রাচীর তৈরি করে দেওয়া হয়। বাড়তি প্রণোদনা হিসেবে প্রতিটি বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতরে জোড়ায় জোড়ায় ছাগলও রাখা হয়। দেয়ালগুলো দলীয় প্রচারের ক্যানভাস হয়ে ওঠে। সেগুলোয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় প্রার্থীর প্রতিকৃতি আঁকা হয়।

এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য আল জাজিরা অনুরোধ জানালেও সাড়া দেননি বিজেপির ত্রিপুরার মুখপাত্র।

পাঁচ বছর ধরে রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা বিজেপির জন্য এই দেয়াল তৈরি করে দেওয়া তেমন কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু যে দেশের ৮০ কোটি মানুষ এখনও বেঁচে থাকার জন্য বিনামূল্যের বা ভর্তুকির খাদ্যের উপর নির্ভরশীল, সেখানে এক জোড়া ছাগল ও একটি সীমানা প্রাচীর জীবন বদলে দেওয়ার মতো উপকার। আর এর বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা ও ভোট উভয়ই মেলে।

ভোটারদের ঘুষ দেওয়া অপরাধ এবং নির্বাচনী রীতির লঙ্ঘন। এতে কারাদণ্ড ও নির্বাচন বাতিল হতে পারে। কিন্তু দেয়ালগুলো নির্মাণে একজন ঠিকাদার নিয়োগ করায় এবং দলের কেউ সরাসরি জড়িত না থাকায় তা অস্বীকার করার সুযোগ আছে। এছাড়া অভিযোগটি প্রমাণের জন্য লম্বা সময় ধরে তদন্তও করতে হবে।

এই সুযোগে নীরাজদের পরামর্শ মতো কাজ করায় বিজেপি প্রার্থী অমরপুর আসনে জিতে যায়। তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) প্রার্থীকে অল্প ব্যবধানে হারান।

গত ১৯ এপ্রিল লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েকমাস আগেই আইআইটির স্নাতক, আইআইএমের এমবিএ ডিগ্রিধারী, আইনজীবী ও গবেষকদের একটি বিশাল দলকে কাজে নামানো হয়। তারা বিজেপির প্রচারাভিযানের কৌশল, সমস্যাগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা ও বিশ্লেষণে ব্যস্ত ছিলেন।

এরপর তারা তাদের নিয়োগকর্তাদের কাছে সোশাল মিডিয়া ও হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়া খবর ছড়ানো থেকে শুরু করে কোথায় উপহার ও বিভাজনমূলক বক্তৃতা দিতে হবে- সে বিষয়ে পরামর্শ তুলে ধরেন।

তাদের উচ্চ বেতন ও জয়ের রোমাঞ্চ ছাড়া রাজনীতির খেলায় কোনও অংশ নেই। তারা নিজেদেরকে ‘রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ সমস্যা সমাধানকারী’ বলে আখ্যা দেন।

আল জাজিরার সঙ্গে কথোপকথনে তারা স্বীকার করেছেন, ভোট টানার জন্য ক্লায়েন্টেদের দেওয়া তাদের পরামর্শ বা সমাধানগুলো গণতন্ত্রের জন্য সর্বোত্তম ইতিবাচক নাও হতে পারে। তবে তারা দাবি করেন, তাদের কোনও পক্ষপাত নেই। তারা কেবল সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দিকেই মনোনিবেশ করেন।

ভোট পরামর্শক প্রশান্ত কিশোর।

গোপনে পরিচালিত অভিযান

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার বাসিন্দা রাজেশ (ছদ্মনাম) আইআইটির একজন প্রকৌশলী। তিনি ইনক্লুসিভ মাইন্ডস নামে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ১২ সদস্যের তথ্য বিশ্লেষণ দলের দায়িত্বে রয়েছেন। ইনক্লুসিভ মাইন্ডস ভারতের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির হয়ে কাজ করে।

দেশে ছড়িয়ে থাকা শত শত মাঠকর্মী রাজেশ ও তার টিমকে ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীদের নাম পাঠায়। তাদের প্রধান সমস্যাগুলোসহ ভোটারদের খুঁটিনাটি- সব তথ্যের বিবরণও পাঠায়।

অন্য রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মতোই ইনক্লুসিভ মাইন্ডসও ভাড়া করা ও পার্টি-অনুগত পেইজের মাধ্যমে ফেইসবুক ও ইনস্টাগ্রামে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এটা করে তারা ভোটারদের মেজাজ-মর্জি, প্রিয় দল, আদর্শ, আগ্রহ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে। মেটাও তাদের ভোটারদের বয়স গোষ্ঠী, লিঙ্গ ও নির্বাচনী এলাকার তথ্য সরবরাহ করে।

রাজেশের দলের কেউ কেউ প্রতিটি রাজনৈতিক বিবৃতি, সমাবেশ, রোড শো, বক্তৃতা ও দলীয় ইশতেহারের প্রভাব বের করতে সংবাদ ও সোশাল মিডিয়ায় নজর রাখে।

রাজেশ বলেন, “ইনক্লুসিভ মাইন্ডসের প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কর্মী আইআইটি থেকে ও ৫ শতাংশ আইআইএম থেকে পাস করা। প্রায়ই তারা ‘তথ্যই রাজা’ এমন মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি করেন।”

সংগৃহীত তথ্য বাছাই করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। এরপর সেগুলো প্রায় ৫০টি ‘ড্যাশবোর্ডে’ দেখানো হয়। বোর্ডগুলোতে ইন্টারঅ্যাকটিভ স্ক্রিন থাকে, যেখানে বার চার্ট, লাইন গ্রাফ, ড্রপ-ডাউন মেনু ও মানচিত্রসহ একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সব পোলিং বুথের ভোটের পরিসংখ্যান দেখানো হয়। সেখান থেকে বের করা হয়, কোন এলাকায় বেশি নজর দিতে হবে।

নরেন্দ্র মোদীর গত দুই নির্বাচনী প্রচারে কাজ করেছেন রাজনৈতিক কৌশলবিদ অভিমন্যু ভারতী। তিনি বলেন, “নির্বাচন এগিয়ে আসলে আমরা প্রায়ই ভোটারদের মধ্যে নানা বিভাজন তৈরির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলতাম। কারণ আমরা যদি মেরুকরণ না করি, তাহলে আমরা জিততে পারব না।

“দলটি তখন আরএসএস-এর লোকদের বলবে যে, ‘আবার এই লোকেরা (মুসলিম) আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে। তাদের না ঠেকালে অপরাধ বাড়বে।”

বিজেপির মূল আদর্শগত সংগঠন আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) ভারতজুড়ে প্রায় ৬ লাখ সদস্য রয়েছে।

ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্টনিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা রাজনৈতিক পরামর্শদানকে ‘অত্যন্ত অস্বচ্ছ প্রভাবক অপারেশন’ বলে মনে করেন, যার ন্যূনতম নৈতিক ভিত্তি নেই।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মিথ্যা প্রচার, ভুল তথ্য ও অনলাইন ঘৃণামূলক প্রচারণা এদের মাধ্যমেই চালাচ্ছে।

“নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলে সোশাল মিডিয়ায় ভুয়া খবর, ঘৃণামূলক পোস্ট বাড়তে থাকে। ভাড়া করা ও প্রক্সি পেইজের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, মিথ্যা তথ্য, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পোস্ট করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। এই সবই করা হয় রাজনৈতিক পরামর্শকদের দিয়ে।”

ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট বুম লাইভের মতে, ভারতে মুসলিমরাই ভুয়া সংবাদের প্রধান টার্গেট।

হায়দরাবাদে একটি ছোট রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এফ-জ্যাকের পরিচালক মোহাম্মদ ইরফান বাশা বলেন, “যে নির্বাচনী এলাকায় তরুণ ভোটারদের সংখ্যা যত বেশি, সেখানে ধর্মীয় বিভাজন তৈরিও ততটা সহজ।

“অধিকাংশ তরুণ ভোটারের কোনও রাজনৈতিক আদর্শ নেই। তারা নতুন চিন্তা ও ধারণার জন্য উন্মুক্ত। আর এই কারণেই তাদের সহজেই প্রভাবিত ও পরিস্থিতির মেরুকরণ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।”

তেলেঙ্গানায় গত বারের নির্বাচনে এক সাবেক কংগ্রেস নেতার প্রচার ও কৌশল পরিচালনা করছিলেন মোহাম্মদ ইরফান বাশা। তিনি এবার বিজেপির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বাশা সাবেক কংগ্রেস নেতার হয়ে কাজ করার সময় দেখতে পান, তরুণরা কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকছে। ফলে ওই তরুণদের আরও কাছে টানতে তিনি ওই নেতাকে তার বক্তব্যে ধর্মীয় বিষয়গুলো যোগ করতে বলেছিলেন। নির্বাচনের ফলে অন্যদের অবাক করে দিয়ে ওই নেতা তখন জিতেও গিয়েছিলেন।

মোহাম্মদ ইরফান বাশা বলেন, “কংগ্রেসে থাকার সময় এই প্রার্থী ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। এখন তিনি বলছেন, জয় শ্রী রাম।”

এই স্লোগানটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী হিন্দুদের একত্রিত করার জন্য বিজেপির একটি অস্ত্র।

প্রাক্তন রাজনৈতিক কৌশলবিদ অভিমন্যু ভারতী বলেন, “প্রেম ও যুদ্ধে সবকিছুই ন্যায়সঙ্গত এবং এটিও (নির্বাচন) যুদ্ধ।”

অভিমন্যু ভারতী এখন অনলাইনে স্কুল অব পলিটিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। সেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিবিদ ও পরামর্শদাতাদের কোর্স করানো হয়। তার অনেক ছাত্র-ছাত্রীই আইআইটি থেকে পাস করে আসা।

তরুণ ও সস্তা প্রতিভা

ভারতে ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে স্থাপিত আইআইটি ও আইআইএমগুলো একটি আধুনিক, স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিল্পোন্নত জাতি গঠনের গতি বাড়াতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ভারতের অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিবর্তিত হয়েছে। তাদের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন কোর্স যোগ হয়েছে। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার সঙ্গে স্টার্ট-আপ ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

আইআইটির র‌্যাংকিংয়ে আইআইটি বোম্বের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়াররা শীর্ষে থাকেন। টেক কোম্পানি ও কনসালটেন্সি ফার্মগুলো তাদের সরাসরি ক্যাম্পাস থেকেই নিয়োগ দিয়ে দেয়। কিন্তু রসায়ন, মেকানিক্যাল, অ্যারোনটিক্যাল, মাইনিং ও মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম।

ভারতের হতাশাজনক চাকরির বাজারে স্নাতকদের বেকারত্বের হার অশিক্ষিত যুবকদের চেয়ে নয় গুণ বেশি। এই সুযোগে পেশাদার, করপোরেট-স্টাইলের রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় পাঁচ বা ছয় বছর আগে আইআইটি এবং অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া শুরু করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কংগ্রেসের প্রচার দলের একজন সদস্য বলেছেন, “এরা তরুণ ও সস্তা প্রতিভা। তারা উত্তেজিত এবং কাজ করতে খুব আগ্রহী।” তিনি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওড়িশার কলেজগুলোতে দলটির নিয়োগ অভিযানে কাজ করছেন। ওড়িশায় এবার লোকসভার সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনও হচ্ছে।

রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনও নির্দিষ্ট ডিগ্রি চায় না। তারা শুধু তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ ও গাণিতিক দক্ষতাসম্পন্ন স্মার্ট লোক চায়। যারা কোডিং জানে বা শিখতে পারবে, সমস্যা সমাধানে ভালো এবং টানা উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারে- তাদেরই খোঁজ করে।

অধিকাংশ এমবিএ ডিগ্রিধারীকে তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজ হলো- সিস্টেম ও প্রক্রিয়া সেট আপ, দল পরিচালনা, রিসোর্স বরাদ্দ ও তা রাজনীতিকদের সামনে উপস্থাপন করা। আর আইআইটি ইঞ্জিনিয়াররা প্রযুক্তি সহায়তা, তথ্য সাজানো ও আলাদা করার কাজ করেন।

পলিটিক অ্যাডভাইজার্সের পরিচালক লাল বলেন, “এগুলো সাময়িক চাকরি। আইআইটি ও আইআইএম ফেলোরা এক বা দুই বছর সময় দেন, তার বেশি নয়। যাদের যাওয়ার কোনও জায়গা থাকে না তারাই স্থায়ী হন। তাদের জন্য এটাই বেঁচে থাকার উপায়।”

বিজেপির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী কৌশল ও প্রচার ইউনিট অ্যাসোসিয়েশন অফ এ বিলিয়ন মাইন্ডস (এবিএম) এর সঙ্গে কাজ করা একজন প্রকৌশলী ও এমবিএ ডিগ্রিধারী মোহন (ছদ্মনাম)।

তিনি বলেন, “ভবিষ্যত নিয়োগকর্তাদের এমন কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের দিকে বাঁকা চোখে তাকানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবু এমন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে থাকার রোমাঞ্চ অতুলনীয়।

“এখানে সবচেয়ে বড় আকর্ষণটা হলো দেশের শীর্ষে থাকা মানুষদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ এবং প্রকল্পগুলোর বিশাল বাজেট। রাজ্য নির্বাচনে ১০-২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রকল্পগুলোর জন্যও আমরা সরাসরি সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। ১০০ মিলিয়ন ও তার বেশি মূল্যের প্রকল্পগুলোর জন্য পার্টির নেতাদের কাছে প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করতে হতো।”

মোহন (ছদ্মনাম) তার নাম বা তিনি যে রাজ্যে কাজ করেছেন তা প্রকাশ করেননি। কারণ তিনি এবিএম এর সঙ্গে একটি অপ্রকাশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। মোহন বলেন, “আমাদের ফোন আজও ট্যাপ হয়।”

ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচনে ১৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, যা বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শক এবং শত শত জরিপকারী ও ডেটা বিশেষজ্ঞদের খরচও রয়েছে। তাদের কাজ হলো, ভোটারদের মন জয়ে সবচেয়ে কম খরচের সমাধানটি খুঁজে বের করা। কখনও তা হবে সীমানা প্রাচীর, কখনও তা ধর্ম।

গোপনীয়তা

প্রাক্তন রাজনৈতিক কৌশলবিদ অভিমন্যু ভারতী মনে করেন, নির্বাচনে জয়ের দুটি মন্ত্র। সেগুলো হলো- পরিমাপ এবং ট্র্যাক বা অনুসরণ।

তিনি বলেন, “ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে ত্রুটিগুলো শোধরানো যায়। নির্বাচনে যে নেতা বা দল সবচেয়ে কম ভুল করে তারাই জয়ী হয়। সেজন্য ত্রুটিগুলো শোধরানো গুরুত্বপূর্ণ।”

প্রার্থী বাছাই ও প্রচারের কৌশল, স্লোগানে কৃতিত্ব তুলে ধরা, বিরোধীদের আক্রমণ করা এবং কোন প্রভাবককে সাক্ষাৎকার দিতে হবে, মন্দির পরিদর্শন করা, এমনকি কখন এবং কোথায় একজন দলিতের বাড়িতে খাবার খেতে হবে- সবকিছুই পূর্ব-সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। এসব করা হয় ভোটের ফলে পরিবর্তন আনতে।

মাঠে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ করা হয় শুধু কান খাড়া রাখার জন্য নয়। তাদের নিজেদের এবং বিরোধী নেতাদের সব কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট করা, কে অসন্তুষ্ট এবং কাকে পক্ষে আনা বা কেনা যায়- তা খুঁজে বের করার জন্যও।

নীরাজ বলেন, “কাজটি এতোটাই গোপন যে, আপনি আপনার পরিচয় হারাতে শুরু করবেন।” কখনও কখনও রাজনৈতিক তথ্য সংগ্রহের জন্য পর্যটক, সাংবাদিক বা গবেষক হিসেবে নিজের পরিচয় দেন তিনি।

বেশিরভাগ রাজনৈতিক পরামর্শক গোপনে কাজ করেন। কর্মচারীদের এনডিএ স্বাক্ষর করতে হয় এবং একই দলের কর্মীদের বেতন প্রায়ই ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে আসে। মাঠকর্মীদের ফোন ও নেতাদের গাড়ি জিপিএসের মাধ্যমে ট্র্যাক করা হয় এবং প্রযুক্তি দলগুলোকে দিয়ে নজরে রাখা হয়।

আল জাজিরা এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, তাদের দিনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পরিবারকে দেওয়ার মতো সময়ও থাকে না। অবসাদ, ক্লান্তি, জয়ের জন্য প্রচুর চাপ থাকে এবং অহরহ সহকর্মীদের চাকরি হারানো বা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

মোহন বলেন, “এই কাজে খুবই চাপের মধ্যে থাকতে হয়। আর সে কারণেই এই কাজের মূল পজিশনে খুব কমই কোনও নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরা অন্যান্য কলেজ থেকেও লোক নিয়োগ করেছি, কিন্তু তারা খুব দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে। কেবল আইআইটি ও আইআইএম-এর তরুণরাই সেই পরিবেশে কাজ করার ও ডেলিভারির সক্ষমতা রাখে।”

নীরাজ ত্রিপুরায় বিজেপির রাজ্য শাখার সভাপতির সঙ্গে একটি বৈঠকের কথা স্মরণ করেন। সেখানে তথ্য এবং মাঠের রিপোর্টের ভিত্তিতে নেশন উইথ নমো টিম সুপারিশ করেছিল, গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কিছু একটা গোলামাল সৃষ্টি করতে হবে।

নীরাজ বলেন, “তারা জীবন নিয়ে চিন্তার চেয়ে ভোটকে বেশি ভালোবাসে।”

এই পরামর্শে দলের নেতা অবিলম্বে কিছু বিজেপি কর্মীকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অধ্যুষিত এলাকায় পোস্টার লাগাতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ওই নেতা বলেন, “তারা আমাদের কর্মীদের মারধর করবে এবং তারপরে আমরা মিডিয়ার কাছে বিবৃতি দিতে পারব।

“এমন সময় হঠাৎ তার কাছে ফোন আসে, দলের এক কর্মীকে খুন করা হয়েছে। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই, মিল গ্যায়া মুদ্দা (ভাই, আমরা আমাদের ইস্যু পেয়ে গেছি)’।”

বিজেপির ত্রিপুরার মুখপাত্রর কাছে এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য আল জাজিরার অনুরোধ জানালেও তিনি সাড়া দেননি।

নীরাজ এখন আর রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন না। কিন্তু মোহন এখনও নির্বাচনে প্রবাহিত অর্থের কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত বোধ করেন। কারণ তিনি মনে করেন, ওই অর্থ দিয়ে ভোট ও প্রতিপক্ষকে কেনা যায়। আবার নির্বাচনী প্রচার যেমন-বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন, পোস্টার ছাপানোর মতো বিভিন্ন কাজও করানো যায়।

আপাতত, তিনি একটি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছেন। তা হচ্ছে নির্বাচনী প্রচার চালানোর ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের থেকে রাজনৈতিক পরামর্শকদের হাতে আসার।

আল জাজিরাকে মোহন বলেন, “বর্তমানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের (পরামর্শকদের) হাতে তেমন কোনও ক্ষমতা নেই। এটা এখনও অনিশ্চিত অঞ্চল। তবে এটা একবার পেয়ে গেলে, আমি অবশ্যই ফিরে যেতে চাই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত