Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ভারতে ভোটে যেভাবে প্রভাব রাখছে সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা

Influencer
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ভারতে লোকসভা নির্বাচন শুরুর কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দিল্লির এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দেখা যায়। সেখানে বিয়ারবাইসেপস ও কার্লি টেলসের মতো নামধারীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে দেখা যায় মোদীকে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণের জন্যই ওই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। সোশাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় এসব ব্যক্তিত্বদের পাশে প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ দাঁড়াবেন, কয়েক বছর আগেও এমনটা ভাবা যেত না।

দেশটির ভোটারদের ভোট কীভাবে নিজেদের ব্যালট বক্সে আনা যায়, এনিয়ে রাজনীতিকরা নানা কৌশল আঁটতে ব্যস্ত। এরই অংশ হিসেবে এসব সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের কাজে লাগানো হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হলো- তরুণ, উদাসীন ও হতাশ ভোটারদের কাছে দলীয় রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছানো।

কেউ কেউ সোশাল মিডিয়াকে গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ মনে করেন। তাদের মতে, সোশাল মিডিয়ায় যে কেউ স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে।

কিন্তু আরেক দল এসব মাধ্যমের অন্ধকার দিকটি তুলে ধরেন। তারা বলছেন, এসব মাধ্যমে মানুষকে হুমকি দেওয়া থেকে শুরু করে অর্থের বিনিময়ে ভুল তথ্যও ছড়ানো হয়।

মাত্র এক দশক আগেও নিজেকে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ বলে কেউ পরিচয় দিত না।

কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাজনীতির সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিনয় দেশপাণ্ডের মতে, ইনফ্লুয়েন্সার বিষয়টা এখন পেশা হয়ে গেছে। বহু তরুণ ‘পকেটমানির’ জন্য এসব মাধ্যমে কাজ করছে।

পকেটমানি শব্দটি দিয়েও আসলে পুরো চিত্র ধরা যায় না। সোশাল মিডিয়ায় অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন, এমন নতুনরা দিনে ২ হাজার রুপি উপার্জন করতে পারে। তবে এই লাইনের প্রভাবশালীরা একটি পোস্টের জন্য প্রায় ৫ লাখ রুপিও পান। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন ব্যবস্থাপকও পুরো মাস খেটে এই টাকা বেতন পান না।

‘রান্টিং গোলা’ নামের চ্যানেলের নির্মাতা নাম প্রকাশ না করে বিবিসিকে জানান, নির্বাচনী প্রচারের জন্য রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পরিচালনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ১ থেকে ৫ লাখ রুপি পর্যন্ত প্রস্তাব দিয়েছে।

দেশপাণ্ডে জানান, রান্টিং গোলা বিধানসভা নির্বাচনে এক বিরোধী প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালিয়ে তাকে জিতিয়ে দিয়েছিল। চ্যানেলটির ফলোয়ার (অনুসারী) কম হলেও তারা সংগঠিত ছিল।

তিনি বলেন, “সোশাল মিডিয়ার কনটেন্ট বেশ শক্তিশালী। এটি একজন ব্যক্তির অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে পারে। এসব কনটেন্ট কোনও বিশ্বাস বা মতামতকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। কিন্তু ইস্যুভিত্তিক সমালোচনামূলক চিন্তার অভাব দেখা দেয় এই প্রক্রিয়ায়।”

প্রীতি আগরওয়াল (২৫) এমন অনেকের মধ্যে একজন, যারা খবরের জন্য ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও টুইটারের মতো প্লাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন। আরও অনেকের মতো তিনিও ‘পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্সারদের’ অনুসরণ করেন। এসব ইনফ্লুয়েন্সারা সোশাল মিডিয়ায় রাজনীতি নিয়ে সরব ভূমিকা পালন করেন।

প্রীতি বলেন, “খবর প্রায়ই বিরক্তিকর ও জটিল লাগে। আমি মনে করি এসব ইনফ্লুয়েন্সাররা খবরকে মজার ও সহজ করে উপস্থাপন করে। ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মতামত গঠনে সহায়ক হয়।”

কিন্তু প্রশ্ন হলো-প্রীতি আগরওয়ালরা আসলে কার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছেন?

ইউটিউবার সমদীশ ভাটিয়া জানান, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে তার সঙ্গে বহু রাজনীতিক যোগাযোগ করেছিলেন। তাকে সাক্ষাৎকার দিতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, “তারা চেয়েছিল আমি যেন প্রশ্নগুলো আগে থেকে তদের জানাই। আর ভিডিও পাবলিশ করার আগে তাদের অনুমোদন নিই। আমি এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে।”

মিশিগান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জয়োজিত পাল মনে করেন, দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে রাজনীতিকরা তাদের মানবিক দিক জনগণের সামনে তুলে ধরতে চান। এমন সাক্ষাৎকার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়।

অনেক রাজনীতিক সাবধানে এমন সাক্ষাৎকারগুলো পরিচালনা করেন। সতর্কতার সঙ্গে প্রশ্ন করা হলেও ওই সাক্ষাৎকার রাজনৈতিক প্রচারে পরিণত হতে পারে বলেও মনে করেন জয়োজিত পাল।

ভারতের শীর্ষ ইনফ্লুয়েন্সাররা কাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, এনিয়ে সম্প্রতি তিনি গবেষণা করেন। তিনি দেখতে পান, বিরোধী নেতাদের চেয়ে বিজেপির (ভারতীয় জনতা পার্টি) নেতারাই এক্ষেত্রে এগিয়ে।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের সমালোচনা করে এমন অ্যাকাউন্টগুলোতে পোস্টের সংখ্যা কমেছে। একই সময়ে বিজেপির পক্ষ নিয়ে পোস্টের সংখ্যা বেড়েছে।

জয়োজিত পাল বলেন, “সরকারকে খোলাখুলি সমালোচনা করার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের আদর্শ সমর্থন করে এমন কনটেন্ট প্রকাশে মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এই ঘটনা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ানক।”

বিরোধীদের সমর্থনে যেসব ইনফ্লুয়েন্সররা কাজ করছেন, তাদের প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যারা সরকারবিরোধী কনটেন্ট পোস্ট করেন, সরকারের প্রতিশোধের ভয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে চাননি তারা। নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে তারা ছদ্মনামে চ্যানেল পরিচালনা করেন।

বিসিসিকে র‌্যান্টিং গোলা জানায়, তাদের পোস্ট করা ভিডিওতে প্রায়ই হুমকি দেওয়া হয়। তাদের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট কোনও কারণ না দেখিয়েই কয়েকবার নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।

বিজেপি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে যে তারা ভিন্নমত ও বাকস্বাধীনতাকে দমন করেছে।

কিন্তু বিজেপি সমর্থক ইউটিউবার শাম শর্মাও বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, ভারতে বাকস্বাধীনতার সমস্যা হতে পারে।

উদ্বেগ সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে এসব ইনফ্লুয়েন্সারদের ব্যবহার করছে।

কংগ্রেসের সোশাল মিডিয়া প্রধান সুপ্রিয়া শ্রীনাতে বলেন, “মূলধারার মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ বিজেপির হাতে। আমাদের তহবিল জব্দ করা হয়েছে যাতে বিজ্ঞাপন দিতে না পারি।”

কংগ্রেস নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধের অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু সরকার সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে।

শ্রীনাতের মতে, এই বাধাগুলোর কারণে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ইনফ্লুয়েন্সাররা একটি কার্যকর মাধ্যম। তিনি উল্লেখ করেন, কংগ্রেস তার স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। তারা দলের নীতিতে বিশ্বাসী ও সোশাল মিডিয়ায় দলের কর্মকাণ্ড প্রচারে আগ্রহী।

আম আদমি পার্টির সাবেক রাজনৈতিক পরামর্শক অঙ্কিত লালও জানান, রাজনৈতিক প্রচারের ক্ষেত্রকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক করতে ভুমিকা রাখছে ইনফ্লুয়েন্সাররা।

সাবেক সাংবাদিক ও বর্তমানে দ্য দেশভক্ত নামে ইউটিউব চ্যানেল চালান আকাশ ব্যানার্জি। তার মতে, ইনফ্লুয়েন্সাররা প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমের তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্টবাদী।

তিনি ‘ইজ ইন্ডিয়া বিকামিং এ ডিক্টেটরশিপ?’ নামের ভিডিওটির প্রসঙ্গ টানেন। জার্মানি থেকে ধ্রুব রাঠে নামের এক ইনফ্লুয়েন্সার ওই ভিডিওটি তৈরি করেছিলেন।

মোদী সরকারের সমালোচনা করে তৈরি ওই ভিডিওটি প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দেখেছে। ওই ভিডিওর পর অনেক কনটেন্টে ‘ডিক্টেটরশিপ’ শব্দটির ব্যবহার হয়। এমনটা অতীতে দেখা যায়নি।

আকাশ ব্যানার্জি বলেন, “ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে আমাদের হয়ত জানালা খুলে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব নেই। কিন্তু রাতের আঁধার নেমে আসছে কি না, সেদিকে নজর রেখে জাতিকে সতর্ক করা আমাদের কর্তব্য। মানুষকে জানানো দরকার যে ভোটের মাধ্যমে তারা এই পরিস্থিতি বদলাতে পারে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত