Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

কয়েকটি মৃত্যু, আলোচনায় অ্যানেস্থেসিয়া

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।
Picture of আইরিন সুলতানা

আইরিন সুলতানা

ঘটনা ১

পাঁচ বছর নয় মাস চলছিল আয়ানের। তার পরিবার থাকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকায়। গত বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ানকে খৎনা করাতে নিয়ে গিয়েছিল পরিবার।

ওই তারিখে রাত ৯টার দিকে পুরোপুরি অজ্ঞান করে আয়ানের খৎনা করা হয়। কিন্তু রাত ১১টার দিকেও আয়ানের জ্ঞান ফিরে আসে না। আয়ানকে শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা পিআইসিইউতে আনা হয়।

প্রায় সপ্তাহ খানে অচেতন অবস্থাতে লাইফ সাপোর্টে থাকে ছোট্ট আয়ান। গত ৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ২০ মিনিটে জানা যায়, আয়ানের জ্ঞান আর ফিরবে না কোনওদিন।

ঘটনা ২

ফখরুল আলম ও খায়রুন নাহারের বড় সন্তান আহনাফ তাহমিন আয়হামের বয়স ছিল ১০ বছর। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত সে। আয়হামের পরিবার থাকে খিলগাঁও রেলগেট এলাকায়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিল আয়হাম; খৎনা করাতে।  চিকিৎসকরা তাকে নিয়ে রাত ৮টার দিকে অস্ত্রোপচার কক্ষে যায়। শিশু আয়হামকে অবেদন মানে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে খৎনা করানো হয়। তবে এরপর এই শিশুটিও জীবনে ফেরেনি।

প্রতিবেদকের অভিজ্ঞতা

“২০২২ সালে কোনো খাবারই পেটে টিকছিল না আমার (এই প্রতিবেদক)। সাদা ভাত খেয়ে থাকতাম বেশির ভাগ সময়। অনেকে বললেন, আলসার-টালসার হয়ে গেল কি না! অনেকে বললেন, দ্রুত এন্ডোসকপি করাতে। কিন্তু এন্ডোসকপি করতে গলা দিয়ে পাইপ নামার কষ্ট হবে! সেই ভয়ে পেটে-কোমরে তীব্র ব্যথা আর খেতে পারা না পারার যন্ত্রণাই সহ্য করছিলাম। সেই সময় আমি জানলাম এখন অজ্ঞান করে এন্ডোসকপি করানো হয়। ব্যথা টের পাওয়া যায় না এবং একদম সময়ও লাগে না। মনে সাহস এলো, ভাবলাম এবার তাহলে ডাক্তার দেখিয়ে নেই একবার।”

“তখন ধানমণ্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসতেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. টিটু মিঞা (এখন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক)। ওই বছর ২১ মে তাকে দেখালে তিনি এন্ডোসকপি (আপার জিআই) করে দেখতে বলেন। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি পরীক্ষার কথা লেখা ছিল প্রেসক্রিপশনে- এএলটি/এসজিপিটি (অ্যালানিন অ্যামিনোট্রান্সফারেজ বা সিরাম গ্লুটামিক পাইরুভিক ট্রান্সমিনেজ এনজাইম), আয়রন প্রোফাইল, সিরাম ইলেকট্রোলাইটস, ইউরিন আর/ই।”

“এন্ডোসকপি বাদে অন্যান্য পরীক্ষা আমি ২১ মে সন্ধাবেলাতেই করিয়ে রাখি। সেবার আমি ভোর চারটায় সাদা ভাত খেয়ে তারপর না খাওয়া থেকে দিনে গেলাম পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে; ২২ মে। গিয়ে আর অপেক্ষার পালা শেষ হয় না। আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম আবার ব্যথা শুরু হয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষমান রোগীদের আসনে হাত-পা ভাঁজ করে আধা শোয়া হয়ে ঘুমিয়েও নিলাম। দুপুরের পর নড়াচড়া দেখা গেল। আমার ডাক পড়লো। এটা-সেটা পরীক্ষা করে দেখলো ওরা। রিপোর্ট দেখলো। হাতে ক্যানোলা দিয়ে আগে একটা ইনজেকশন দিল। তারপর কমলা ফলের স্বাদের একটা সিরাপ খেতে দিল। এই সিরাপ সম্ভবত ক্যামেরায় পাকস্থলী পরিস্কার দেখা যাওয়ার জন্য খেতে দেয়। তারপর এলো মূল পর্ব।”

“ডাক্তার মনে হয় নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার; ধারণা করছি সঠিক রোগীকে শনাক্ত ও মানসিক ভাবে সহজ করার জন্য। দুতিন জন ছিলেন যতদূর মনে পড়ে। তারপর একজন বললেন, এখন ইনজেকশন দেওয়া হবে হাতে; তাতে একটু  জ্বালা হতে পারে। বলতে বলতে তিনি ইনজেকশন দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাতে একটা শিরশির জ্বালা টের পেলাম এবং উফ বলেই পুরোপুরি অচেতন হয়ে গেলাম।”

“বিকাল সাড়ে ৪টার পর আমার জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলে দেখি আমি আরেক কক্ষে। আমার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আমার পরিবারের লোকেরা পাশে বসে ছিল। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোক ছিল। উঠে বসে দেখলাম এই কক্ষে আরও কয়েকটা স্ট্রেচারে রোগী অচেতন শুয়ে আছে। তাদেরও চেতনা ফিরছিল। আমরা কয়েকজন হুট করে জ্ঞান হারিয়ে আবার হুট করে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে মজা করলাম। এন্ডোসকপি কত সহজ হয়ে গেছে, তা নিয়ে হাসলামও।”

“আমি জানতে চাইলাম, চলে যাবো কি না? খারাপ না  লাগলে যেতে পারি জানানো হলো। আমার কোনো রকম খারাপ বোধ হচ্ছিল না। হেঁটেই নামলাম সিঁড়ি দিয়ে। রাস্তার উল্টা পাশে ব্যস্ত স্টার কাবাবে গিয়ে সাদা পোলাও আর রুই মাছ ভাজা অর্ডার করলাম। সেই ভোর ৪টায় সাদা ভাত খেয়ে সারাদিন কাটানোর পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ভরপেট খেলাম। তারপর বাড়ি ফিরলাম।”

খতনা করাতে এসে পুরোপুরি অবেদন হয়ে তারপর মারা যাওয়া আয়ানের মৃত্যু সনদ ওই রাতেই দিয়েছিল ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাতে আয়ানের মৃত্যুর কারণ বলা ছিল, কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেইলিওর, মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।

আয়ানের বাবা অভিযোগ করেছেন, খৎনা করার সময় আংশিক অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হবে বলা হয়েছিল। কিন্তু আয়ানকে পুরোপুরি অচেতন করা হয় পরিবারের অনুমতি ছাড়াই।

তদন্ত কমিটিকে ৩০ দিনের সময় সীমায় বেঁধে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে আয়ানের মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ বলা হয়নি এবং নির্দিষ্ট করে কাউকে দায়ী করাও হয়নি। তবে অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদনে জানায়, অপারেশনের আগে আয়ানকে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া হয়েছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনে অসন্তুষ্টি দেখিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মাকসুদুল আলমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটি করে দিয়েছে হাইকোর্ট । এজন্য সময় দেওয়া হয়েছে ৩০ দিন।

সম্প্রতি ল্যাব এইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে মারা যাওয়া রাহিব রেজার শারীরিক অবস্থা অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার উপযোগী ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে চিকিৎসক মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এন্ডোসকপি এড়ানো দরকার হতে পারে এমন কিছু রোগীর রিপোর্টে ছিল না। আর রাহিবকে কোনোরকম অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়াই হয়নি; বরং ’মিডাজোলাম‘ ঘুমের ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।

সিডেশন না অ্যানেস্থেসিয়া?

“সার্জিকাল অপারেশনে সাধারণত অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়। আর প্রসিডিউর বা ইনভেস্টিগেশন (স্বাস্থ্য পরীক্ষা) করার জন্য, যেমন একটা বাচ্চাকে যদি এমআরআই মেশিনে দিতে হয় তখন মেশিনের শব্দ বাচ্চা নিতে পারে না; তখন হয়তো বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো হয়। এর ডোজ নির্ধারণ করাই থাকে; কতটুকু দিলে কনসাস সিডেশন হয়, কতটুকু দিলে অ্যানেস্থেসিয়া হবে।”

সিডেশন এবং অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে এসব জানালেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক।

তিনি বলেন, “সিডেশনে থাকা রোগীকে ডাকলে বা স্টিমুলেশন দিলে (অর্থ্যাৎ কোনওভাবে উদ্দীপনা জাগালে) সাড়া দিতে পারবে। কিন্তু অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া রোগীকে স্টিমুলেশন দিলে উঠতে পারবে না।”

সিডেশন অনেকটা হালকা ঘুমের মতো। চারপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে চেতনাশূন্যতা কাজ করবে রোগীর মধ্যে। শিরায় ইনজেকশন দিলে রোগী সিডেশন দশায় চলে যায়।সিডেশনিস্টের দেওয়া ওষুধের মাত্রার উপর নির্ভর করে মৃদু থেকে গাঢ় সিডেশন হয়। হালকা বা মিনিমাল সিডেশনে হয়তো রোগীর তন্দ্রাবোধ হবে কিন্তু কথা বলতে পারবে। মডারেট সিডেশনে ঘুম চলে আসতে পারে; যে কারণে ওই সময়ের প্রক্রিয়া রোগীর পুরোপুরি মনে থাকে না। গাঢ় বা ডিপ সিডেশনে রোগী একেবারে ঘুমে তলিয়ে যাবে এবং তার সঙ্গে চলা প্রক্রিয়া নিয়ে অচেতন থাকবে।

ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তি জোরে শব্দ হলে, আশেপাশে চেয়ার-টেবিল বা দরজা-জানালা, বিছানায় মৃদু কাঁপুনি হলে সাড়া দেবে; তার ঘুম ভেঙে যাবে। একজন পুরোপুরি অচেতন মানুষ তা করবে না 

ঘুমের পাঁচটি দশা রয়েছে; সজাগ, এনওয়ান বা হালকা ঘুম, এনটু বা গভীর ঘুম, এনথ্রি বা প্রগাঢ় ঘুম এবং আরইএম। আরইএম দশায় মানুষ স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন দেখে থাকে।

অ্যানেস্থেসিয়া হলো অজ্ঞান দশার মতোই। জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া করানো মানে রোগীকে পুরোপুরি সংজ্ঞাহীন করে দেওয়া। রিজিওনাল অ্যানেসথেসিয়া মানে নির্দিষ্ট অঙ্গ একেবারে অবশ হয়ে যাবে। লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট অঙ্গের বিশেষ কোনো জায়গা অবশ করে দেওয়া।

মেডিকেলের এই বিষয়গুলো ব্যাখ্যা ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম শফিকুল আলম অধ্যাপক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সার্জারি  করতে হলে রোগীকে ঘুমের মধ্যে, ব্যথা মুক্ত, একদম  রিল্যাক্স করে এবং সংবেদনগুলো বন্ধ রাখতে হয় অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে।”

“কিছু কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা আছে, যা করতে হলে রোগীকে ঘুমের মধ্যে রাখতে হয়; এটা সিডেশন দিয়ে করা হয়।”

সিডেশন ও অ্যানেস্থেসিয়া কেমন ঘুম?

ব্যাখ্যা করে অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জন ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ সংগঠনের সভাপতি  ডা. মনিলাল আইচ লিটু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্যাথেড্রিন, মদ এবং ঘুমের ওষুধ এসব হলো হিপনো স্লিপ বা নারকো স্লিপ। এটা কোনো ঘুম না। এটা হলো জোর করে মানুষকে ঘুমের মতো করে রাখা। যারা মাদক বা ঘুমের ওষুধ নিয়ে ঘুমায় তারা সকালে উঠে ফ্রেশ বোধ করেন না।

“ঘুম স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া; আর মেডিকেলে অজ্ঞান হওয়া মানে তাকে জোর করে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে। ওষুধ দিয়ে জোর করে ঘুম পাড়ালে এটা কখনই ঘুমের শর্ত পূরণ করবে না। এটা বায়োলজিকাল স্লিপ না।”

“ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া মানে পুরোপুরি অজ্ঞান করে ফেলা। ডিসেশনে রোগী নাম্ব বা একেবারে অসাড় হয়ে যায় না।  সিডেশনে যেসব ড্রাগ দেওয়া হয় তাতে টেনশন কমে যায়। পেশি শিথিল হয়ে যায়।”

সিডেশন ও অ্যানেস্থেসিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া নিলে পরে শীত শীত লাগতে পারে, মাথা ও গায়ে ব্যথা হতে পারে এবং চুলকানিও হতে পারে। যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বলছে, এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লম্বা সময়ের জন্য থাকে না।

দাঁতের চিকিৎসায় চেতনানাশক ওষুধ মাড়িতে দেওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক সময় রোগীর মুখে এলার্জি দেখা দিতে পারে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন দাঁতের চিকিৎসক মাসুমা নূর-এ-সাবাহ।  

সিডেশন করা হলেও মাথা ঘোরা, বমি এবং ক্লান্ত বোধ হতে পারে। এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কেটে যায়। 

অ্যানেস্থেসিয়ায় মৃত্যু হার

অ্যানেস্থেসিয়া একটি গ্রিক শব্দ। এর  বাংলা অর্থ অবেদন; যার মানে চেতনাশূন্যতা বা বেদনার বোধ লোপ পাওয়া।  

সাধারণত বয়স্ক রোগী, জটিল রোগ ও অস্ত্রোপচার, দুর্বল শারীরিক অবস্থা, হৃদরোগ, শ্বাসজনিত সমস্যা, কিডনি, লিভারের জটিলতা থাকলে অ্যানেস্থেসিয়া রোগীর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে ওঠে।

অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের সময় থেকে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালের কয়েক বছরের পরিস্থিতি তুলনা করে গবেষণা রয়েছে বাইরে।

অস্ত্রোপচারের জটিলতা, শারীরিক অবস্থা এমন নানা দিক বিবেচনার উপর অ্যানেস্থেসিয়ায় মৃত্যু হার নির্ভর করছে। বলা হয়, সাধারণত অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে মৃত্যু ঝুঁকি ততটা নেই। অন্যান্য শারীরিক সমস্যা নেই এমন রোগীর বেলায় জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার হলে মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি এক লাখে এক জন।

সেন্ট্রাল চীনে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অ্যানেস্থেসিয়া নেওয়া ৯৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৬৯ জনের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে, প্রতি লাখে ৬ দশমিক ৪ জন এতে মারা যায়। এই গবেষণাটি ২০২৩ সালে দ্য ল্যান্সেটে এই নিবন্ধটি প্রকাশ পায়।

অ্যানেস্থেসিয়ার কারণে মৃত্যু পরিসংখ্যান নিয়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।

দেশে অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ কতজন?

একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট বা অবেদনবিদ প্রয়োজনীয় মাত্রায় ওষুধ দিয়ে রোগীকে ব্যথামুক্ত  চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেন। রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, রক্তচাপ এবং শারীরিক  ভারসাম্য দেখাশোনার জন্য  শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত  থাকেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট । রোগীর  ঘুম ভাঙানো অথবা চেতনা ফিরে আসার পরই তার কাজ শেষ হয়।

আইসিইউতে রোগীর ব্যথা নিরাময়ে এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকা রোগীদের জন্য অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট থাকার চর্চা রয়েছে বিশ্বের চিকিৎসা সেবায়।

আমেরিকান সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টস সংগঠনের ওয়েবসাইটে বলা আছে, একজন অবেদনবিদের মেডিকেল শিক্ষাসহ ১২ থেকে ১৪ বছরের শিক্ষার্থী জীবন পার করতে হয়। ১২ হাজার ঘণ্টা থেকে ১৬ হাজার ঘণ্টার ক্লিনিকাল প্রশিক্ষণ নিতে হয় এ ধরনের পেশায় আসতে। 

আইএআরএস বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যানেস্থেসিয়া রিসার্চ সোসাইটির অধীনে জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেশের অ্যানেস্থেসিয়া অবকাঠামো নিয়ে নানা তথ্য-বিশ্লেষণ দেখা গেছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানেস্থেশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনের দেশি-বিদেশি গবেষকদের তথ্য বলছে, দেশে ৯৫২ জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট বা অবেদনবিদ রয়েছে; অর্থ্যাৎ প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ৫৮ জন অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট। ২০১২ সালে ছিল ৮৫০ জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট; অর্থ্যাৎ প্রতি লাখ মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ৫৪ জন অবেদনবিদ।    

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০২০ সালে বলা হয়, দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছেন প্রায় দুই হাজার ৬০০ জন। 

২০২৪ সালে এসেও এই জনবল যে খুব বেশি বাড়েনি তা বোঝা গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেস্থেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিকের সঙ্গে কথা বলে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বললেন,  “সরকারি পরিসংখ্যান আসলে নেই। কারণ সরকারি খাতে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অনেক পদ খালি আছে।

“বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করে, আমাদের সোসাইটির মেম্বার সেভাবে আমরা ধারণা করি আমাদের এখানে প্রশিক্ষিত অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আড়াই হাজার থেকে তিন হাজারের মতো আছেন। তবে সবাই দেশে আছেন কি না তা আমরা বলতে পারবো না।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড বলছে, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন অবেদনবিদ থাকা জরুরি।

এন্ডোসকপি করাতে কি অ্যানেস্থেসিয়া দিতে হয়?

বুক-পেট জ্বালাপোড়া, বমি হওয়া এমন সব উপসর্গ দেখা দিলে একবার এন্ডোসকপি করে দেখা জরুরি হয়ে ওঠে। এই স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগে অন্তত আট ঘণ্টা মতো না খেয়ে থাকতে হতে পারে। আপার জিআই এন্ডোসকপি পরীক্ষায় খুব বেশি সময় লাগে না; পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। 

এন্ডোসকপি করানোর সময় রোগীর অচেতন হয়ে যাওয়া মানেই অ্যানেস্থেসিয়া ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই। মডারেট অথবা ডিপ সিডেশন দিয়ে এন্ডোসকপি করা যায়। এছাড়া অনেক সময় জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়ে থাকে। 

আপার জিআই এন্ডোসকপির বেলায় মডারেট নয়তো ডিপ সিডেশন দিয়েই পরীক্ষা করা হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছে আমেরিকান সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টস সংগঠন।

আমেরিকান সোসাইটি ফর গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল এন্ডোসকপি সংগঠন বলছে, বেঞ্জোডায়াজেপিন গোত্রের মিডাজোলাম এবং ডায়াজিপাম ওষুধ দিয়ে সিডেশন করা হয় সাধারণত।

এছাড়া ড্রোপিরিডল দিয়ে ডিসেশন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্যই  খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এফডিএর সতর্কতা মূলক নির্দেশনা মেনে চলতে হয়।

সতর্ক করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক সকাল সন্ধ্যার কাছে বলেন, “অ্যান্ডোসকপি অল্প সময়ের বিষয় তাই সিডেশন দেওয়া হয়। তবে এই যে আর্টিফিসিয়াল ঘুম, সেই ঘুম থেকে একজনকে ফেরানো যাবে কি না, সেটা কিন্তু জানতে হবে।”

দাঁতের চিকিৎসাতেও অ্যানেস্থেসিয়া?

দাঁত তোলা হলে বা রুট ক্যানেল করার সময় ব্যথা ও ভয় দুটোই গ্রাস করে রোগীর মধ্যে। তখন মাড়িতে ইনজেকশন দিয়ে অবশ করে দেন দাঁতের চিকিৎসক। এছাড়া স্প্রে, জেলি এবং মলম জাতীয় ওষুধ দিয়েও অবশ  করা হয়; যা লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া।

শিশুদের দাঁতের চিকিৎসা করার সময়  কনসাস সিডেশন দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক দাঁতের চিকিৎসকরা।

“যেসব বাচ্চারা চেম্বারে এসে একেবারেই স্থির থাকে না, তাদের বেলায় কনসাস সিডেশন করা হয়,” সকাল সন্ধ্যাকে এ কথা জানালেন ওরাল ও ডেন্টাল সার্জন মাসুমা নূর-এ-সাবাহ।

স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীর বেলায় অ্যানেস্থেসিয়া কী ঝুঁকিপূর্ণ?

স্লিপ অ্যাপনিয়া কোনো অসুখ কি না, সেই প্রশ্নে অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জন ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন,  “স্লিপ অ্যাপনিয়া অবশ্যই একটা অসুখ। যদি ঘুমের মধ্যে এক ঘণ্টায় ১০ সেকেন্ড করে পাঁচ বারের বেশি দম বন্ধ হয়ে যায় সেটাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলে। এর তিনটা গ্রেড আছে – মাইল্ড, মডারেট, সিভিয়ার।”

বাংলাদেশে নাক ডাকা বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অসুবিধাগুলো আমলে নেওয়া হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।

অধ্যাপক মনিলাল আইচ বলেন, “নাক ডাকা আর স্লিপ অ্যাপনিয়া কাছাকাছি ধরনের অসুখ; আবার একই রকম না। তবে যাদের নাক ডাকা সমস্যা আছে, তাদের অনেকেরই স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকে। নাক ডাকা মানে কী? নাক দিয়ে যে বাতাসটা আসছে, গলা দিয়ে ফুসফুসে যাচ্ছে, ট্রাকিয়া (শ্বাসনালি) দিয়ে ল্যারিংক্স (স্বরযন্ত্র) হয়ে যাচ্ছে। এখন এই পথে কোথাও বাধা পাচ্ছে, এজন্যই নাক ডাকছে। এতে করে শরীরে অক্সিজেন কম যাচ্ছে।”

মস্তিষ্কের কোনো জটিলতা থেকে নাক ডাকলে তা সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া বা সিএসএ; আর নাক-গলা ও ফুসফুসের সমস্যায় নাক ডাকলে তা অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ওএসএ।

৫৫ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত ১৬ শতাংশ পুরুষের নাক ডাকার সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু ৫৫ বছর বয়স পার করলে নারী ও পুরুষ ‘সমান ভাবে’ নাক ডাকে।

গোটা বিশ্বে মৃদু থেকে জটিল ওএসএ আক্রান্ত রয়েছে ৯৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এশিয়া মহাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষ অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াতে ভুগছে।

বাংলাদেশে এ ধরনের রোগীর কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বৈশ্বিক পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করে ধারণা করা হয়, দেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগে ভুগছে। 

নানা ঝুঁকির কারণে কোনো রোগী স্লিপ অ্যাপনিয়াতে ভুগছেন কি না তা অস্ত্রোপচার বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগে পরীক্ষা করে নিতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেস্থেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক মনে করিয়ে দিলেন, স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে সিডেশন অথবা অ্যানেস্থেসিয়া দুটোই ‘বিপজ্জনক’ হতে পারে।

“তবে সঠিক বিশেষজ্ঞের অধীনে থাকলে তিনি তো জানবেনই কী কী করণীয়। তাহলে তিনি স্লিপ অ্যাপনিয়া ম্যানেজমেন্ট করবেন।”

খৎনা করাতে অ্যানেস্থেসিয়া কি জরুরি?

ছেলেদের খৎনা করা মানে পুরুষাঙ্গের উপরের চামড়ার বর্ধিত অংশটুকু কেটে ফেলা। এই প্রক্রিয়ায় ব্যথা হয়। তাই যে বয়সেই খতনা করা হোক, ব্যথাহীন ও মানবিক ভাবে খতনা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।

খৎনা করার জন্য সম্পূর্ণ অচেতন করার বা জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার একেবারেই পক্ষপাতি নন ঢাকা খৎনা সেন্টারের চিকিৎসক কাজী সাহাব উদ্দিন। তিনি ৩৬ বছর ধরে শিশু ও বড়দের খৎনা করছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম শফিকুল আলম বললেন, “শিশুকে যদি কাউন্সেলিং করা হয় এবং সে যদি নড়াচড়া কম করে, তবে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েই খৎনা করা সম্ভব। আর জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া করানো হলে শিশুদের ডে-কেয়ারে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।”

তবে এটাও যেহেতু একটি অস্ত্রোপচার, তাই সচেতন শিশু বিষয়টি আঁচ করতে পারলে তার যে ট্রমা হয়, তা এড়াতে জেনারেল অ্যানেন্থেসিয়া দিয়ে খৎনা করানোর পক্ষপাতি অনেক চিকিৎসক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যানেস্থেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক বলেন, “সাধারণত লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েই খৎনা করানো যায়। তবে আমি জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েও অনেক বাচ্চার খতনা করেছি। এজন্য রোগীকে প্রস্তুত করে নিতে হবে আগে।” 

অ্যানেস্থেসিয়ার আগে ও পরে

দাঁতের চিকিৎসক মাসুমা নূর-এ-সাবাহ সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, মাড়ি অবশ করার আগেও রোগীর শারীরিক অবস্থা জেনে নিতে হয়।

“রোগীর এলার্জি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না… হৃদযন্ত্রের অসুখের জন্য ওষুধ চললে সেই অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া হয়। কারণে এমন অনেক ক্ষেত্রে দাঁত তোলা যাবে না। ডায়াবেটিক রোগীর যদি সুগার লেভেল ১০ এর উপরে থাকে তাহলেও দাঁত তোলা হয় না।”

দাঁতের সমস্যা আসা রোগীর বেলায় চিকিৎসা শেষে পরের ধাপগুলো জানিয়ে দেন মাসুমা নূর-এ-সাবাহ।

“যেহেতু মাড়ির নার্ভ ব্লক করা হয় ওষুধ দিয়ে, তাতে পুরোপুরি চেতনা ফিরে আসতে দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যেতে পারে। অনেক সময় অর্ধেক জিভ অবশ হয়ে থাকে।গালের অর্ধেক অংশেও অবশ থাকে। এসময় তাকে শক্ত বা চিবিয়ে কিছু খেতে মানা করা হয়; তবে তরল খাওয়া চলবে।”

অ্যানেস্থেসিয়া দিতে হতে পারে এমন যে কোনো পরিস্থিতি আগে রোগীর শারীরিক ও চিকিৎসার ইতিহাস জেনে নিতে হবে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক এস এম শফিকুল আলম।

প্রতীকী ছবি

“রোগীর ফিজিওলজি নরমাল আছে কি না, যেমন হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিক, অ্যাজমা, থাইরয়েড, অথবা হার্ট, লিভার, কিডনি এবং ফুসফুসের কোনো সমস্যা আছে কি না …এসব বিবেচনা করেই অ্যানেস্থেসিয়া নির্ধারণ করা হয়।”

রোগীর সর্দি-কাশি এবং রক্তপাতের ইতিহাসও দেখা হয়। এছাড়া রোগীর‘শরীরের ওজনের উপরও ওষুধের ডোজ নির্ভর করছে।

“খৎনা করাতে আসা বাচ্চার বেলায় এমন অনেক হয়েছে, বাচ্চার সর্দি-কাশি চলছে। আমরা তা দেখার পর বাচ্চার পরিবারকে পরামর্শ দেই, ওকে আগে সর্দিকাশির চিকিৎসা করিয়ে দুই সপ্তাহ পরে আসেন। যদি ব্লিডিংয়ের সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা হেমাটোলজি বিভাগে রেফার করে দেখি তাদের কী মতামত। এমনও বলে রাখি, দরকার হলে বাচ্চা আরেকটু বড় হলে খৎনা করব।”

অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেস্থেসিয়ায় অচেতন থাকা রোগীকে ‘মাল্টি প্যারামিটার পেশেন্ট মনিটর’ দিয়ে রোগীর শারীরিক অবশ্য পর্যবেক্ষণ করা হয়। 

“রোগীর পালস দেখা হয়। রক্তচাপ দেখা হয়। রেসপিরেটরি রেট, কার্বন ডাই অক্সাইড কেমন থাকছে তা দেখা হয়”, বললেন অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক  এস এম শফিকুল আলম।

সতর্ক থাকতে করণীয় কী?

সিডেশন করানোর আগে যা যা জেনে নেওয়া আবশ্যক তা নীতিমালা আকারে প্রকাশ করেছে আমেরিকান সোসাইটি ফর গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইন এন্ডোসকপি সংগঠন।

তাদের পরামর্শ- রোগীর নাক ডাকার অভ্যাস, স্লিপ অ্যাপনিয়া সমস্যা, ওষুধে অ্যালার্জি, চলমান ওষুধের বিবরণ, আগে কখনও অ্যানেস্থেশিয়া ও সিডেশন নেওয়া হলে তারপর কোনো শারীরিক প্রতিক্রিয়া, কতক্ষণ আগে শেষ খাওয়া হয়েছে এবং ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস আছে কি না এসব জানতে হবে।

এছাড়া নারীর বেলায় গর্ভকাল চলছে কি না তাও জেনে নিতে হবে অথবা পরীক্ষা করতে হবে।

সিডেশন কিংবা অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার অথবা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো পরিস্থিতি দেখা দিলে রোগীর স্লিপ অ্যাপনিয়া গ্রেড কত তা জানতে হবে, বললেন ডা. মনিলাল আইচ  লিটু।

চিকিৎসকদের জন্য তাই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি একটি জাতীয় নির্দেশনা তৈরির প্রয়োজনীয়তাও দেখছেন তিনি।

অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো জনমনে ভয় জন্ম দিয়েছে। আর এখানে সার্বিকভাবে সচেতনতায় ঘাটতি দেখছেন ডা. মনিলাল আইচ।

অ্যানেস্থেসিয়া বা সিডেশন দিতে হলে প্রত্যেক রোগীর রোগের ইতিহাস জানা কেন জরুরি তা ব্যাখ্যা করলেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্টসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একই ডোজের ওষুধে সবার মধ্যে একই মাত্রায় শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা নাও যেতে পারে। তাই এ ধরনের প্রশিক্ষণ পাওয়া বিশেষজ্ঞের সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।”

অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনার মতো যেন আগামীতে না ঘটে তাই রোগীর সম্মতি ছাড়া কোনো ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া যাবে না বলে সতর্ক করছেন এই অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) বা যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এফডিএ রোগ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ওষুধ নিয়ে অনেক ধরনের সরকারি নীতিমালা দিয়ে থাকে। সেসব নির্দেশনা এই সরকারি সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইটেও মেলে। 

দেশে সরকারি পর্যায়ে অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে স্বাস্থ্য সেবায় কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে ডা. দেবব্রত বনিক বলেন, “নীতিমালা নেই। তবে আমাদের সোসাইটি থেকে বলা হয়, প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকলে তারা অ্যানেস্থেসিয়া দিতে পারবে হাসপাতালে। এর বাইরে প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া যাবে না।”

এছাড়া দেশে সরকারি ভাবে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট জনবল বাড়ানো দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত