Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

দুই নায়কের ডিপফেইক কী মোড় আনবে ভারতের ভোটে

deepfake-indiavote-240424

লোকসভা ভোট ঘিরে ভারতে রাজনৈতিক উত্তেজনা এমনিতেই তুঙ্গে। এরমধ্যে ঘি ঢেলেছে বলিউড পাড়ার দুই বড় তারকার ভিডিও; তাতে মোদীর বিজেপির বদলে কংগ্রেসকে ভোট দিতে বলছেন আমির খান এবং রণবীর সিং।

কংগ্রেস দলের অনেকে ওই ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়েও দেন।

ভিডিও দুটি ঘিরে একদিকে দুই তারকার ভক্ত,  আরেক দিকে দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থক আর লোকসভার ভোটারদের মধ্যে পাল্টাপাল্টির পারদ চড়ছিলই; এরমধ্যে ফ্যাক্ট চেক থেকে ধরা পড়ে এসব ডিপফেইক কারসাজি।

আমির খান এবং রণবীর সিংয়ের পক্ষ থেকেও ভক্তদের ভুয়া ভিডিও নিয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়। দুই তারকাই এগিয়েছেন আইনি পথে।

ভারতে এবার ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফা ভোট হয়ে গেল ১৯ এপ্রিল। সাত দফায় আয়োজিত এই ভোটের দ্বিতীয় দিন হবে ২৬ এপ্রিল।

এরকম সময় আমির খানের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে হুবহু আমির খানের মতো চেহারা ও কণ্ঠের একজন ভারতবাসীর উদ্দেশে বলছেন, “যদি ভারতকে আপনার গরীব দেশ মনে হয়, তবে আপনি একেবারেই ভুল ভাবছেন। কারণ এখানে প্রত্যেক নাগরিক লাখপতি। প্রত্যেকের কাছে অন্তত পক্ষে ১৫ লাখ থাকার কথা। কী বললেন? আপনার কাছে এই পরিমাণ অর্থ নেই? তাহলে কোথায় গেল আপনার ১৫ লাখ রুপি? জুমলা ওয়াদা থেকে সাবধান থাকুন।”

‘জুমলা ওয়াদা’ বলতে ‘ফাঁপা বুলি’ বোঝানো হয়; ভারতে বিরোধীরা বিজেপি দলের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রায়ই ‘জুমলা’ বা ‘বাটপারি’ বলে থাকেন।

এই ভিডিওতে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট চেয়ে স্লোগান জুড়ে দেওয়া হয়েছে –  ‘ভোট ফর জাস্টিস, ভোট ফর কংগ্রেস’ অর্থ্যাৎ ‘ন্যায়ের পক্ষে ভোট দিন, কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিন’।

২৭ সেকেন্ডের এই নকল ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই চটে যান মিস্টার পারফেকশনিস্ট; সাফ জানিয়ে দেন, এত বছরের পেশাদার জীবনে কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি তিনি।

এরমধ্যে ভারতের ফ্যাক্টলি ও পিটিআই ফ্যাক্টচেক ডেস্ক এবং লন্ডন ভিত্তিক রয়টার্স ডিজিটাল ভেরিফিকেশন থেকে এই ভিডিওর পোস্টমর্টেম করে জানানো হয়, ভিডিওটি এআই দিয়ে বানানো।

ছোট পর্দার সত্যমেব জয়তে অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া এই দৃশ্যটি প্রায় আট বছর আগের; তবে এআই দিয়ে আমির খানের আসল বক্তব্যকে অনেকখানি পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

আসল ভিডিওটি সত্যমেব জয়তে অনুষ্ঠানের প্রোমো ছিল; যা ইউটিউবে এই অনুষ্ঠানের চ্যানেলে প্রকাশ করা হয় ২০১৬ সালের ৩০ অগাস্ট। 

আমির খানের ঘটনার পরপরই ভুয়া ভিডিওর শিকার হন বলিউড তারকা রণবীর সিং।

রণবীর সিংকেও একটি ভিডিওতে ভারতের সংবাদসংস্থা এএনআইয়ের কাছে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বলতে দেখা যায়। ৪১ সেকেন্ডের এই ভিডিওর শেষেও কংগ্রেসকে ভোট দিতে বলা হয়।

ঘটনা খতিয়ে জানা যায়, বারানসীতে গিয়ে বর্তমান সরকারের কোনো সমালোচনা নয়, উল্টো সাধুবাদ জানিয়েছিলেন রণবীর সিং। আসল ভিডিওটি এএনআই তাদের সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে প্রকাশ করেছিল গত ১৪ এপ্রিল।

বানোয়াট ভিডিওর শিকার রণবীর সিং লোকসভা ভোটের প্রথম দফার দিন বিকেলের পর টুইট বার্তায় ভক্তদের সতর্ক করে বলেন, “ডিপফেইক থেকে নিরাপদ থাকো বন্ধুরা।”

এরমধ্যে সংবাদসংস্থা এএনআই  জানিয়েছে, রণবীর সিং আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন।

রণবীরের এক মুখপাত্র এএনআইকে বলেন,  “আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছি; এআই দিয়ে করা রণবীর সিংয়ের ডিপফেইক ভিডিও যেসব সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে ছড়ানো হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর  করা হয়েছে।” 

আমির খান গত ১৭ এপ্রিল মুম্বাইতে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন।

এই নায়কের প্রতিনিধি  সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, এসব ডিপফেইক ভিডিও কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। 

এর আগে বলিউডের নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফ, রাশমিকা মান্দানার চেহারা দিয়ে যৌন উত্তেজক ডিপফেইক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সোশাল মিডিয়াতে।  

এবার ভোটের হাওয়ায় ডিপফেইকের শিকার হলেন বলিউডের দুই নায়ক। রয়টার্স বলছে, তাদের এই নকল ভিডিওগুলো লাখ লাখ বার দেখা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার পর এখন ভারতেও নির্বাচনী মৌসুমে রাজনৈতিক ফায়দা পেতে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এআই দিয়ে ডিপফেইক চর্চা যোগ হলো। 

এক সময় শোভাযাত্রা আর ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়াই ছিল ভোটের রীতি। ২০১৯ সাল থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় জমে ওঠে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেইসবুক।

এ বছরের লোকসভা ভোট থেকেই ভারতে নির্বাচনী প্রচারণায় এআই ব্যবহার শুরু হলো। 

কংগ্রেস দলের সুজাতা পল গত ১৭ এপ্রিল রণবীর সিংয়ের ওই ভিডিও শেয়ার করেছিলেন নিজের এক্স হ্যান্ডেলে। এই হ্যান্ডেলে তার ১৬ হাজার অনুসারী আছে। ভিডিওটি এক্সে শেয়ার হয় ২৯০০ বার, লাইক পায় ৮৭০০টি এবং চার লাখ ৩৮ হাজার বার দেখা হয়।

এক্স থেকে সতর্কবার্তা হিসাবে এই ভিডিওর তলে ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া‘ বলা হয়েছিল; এরপরও সুজাতা পল ভিডিওটি নিজের হ্যান্ডেলে রেখে দেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন, ‘এই ব্যক্তি রণবীর সিংয়ের মতো দেখতে কেউ একজন এবং ভিডিওটি চমকপ্রদ হওয়ার মতো’।

রয়টার্স থেকে ভিডিওটি নিয়ে কংগ্রেসের সোশাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাদের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও ২১ এপ্রিল থেকে এক্সে আর ওই ভিডিও দেখা যাচ্ছে না।  

যোগাযোগ করার পরও নরেন্দ্র মোদীর অফিস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির আইটি হেড থেকেও কোনো সাড়া পায়নি রয়টার্স। 

পুলিশের তদন্ত কতদূর?

ভারতের ভোটার সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। দেশটিতে অন্তত ৯০ কোটি নাগরিক ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় রয়েছে।

ইসিয়া সেন্টার এবং ইনডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট বিজনেস স্কুলের জরিপ বলছে, এখানে প্রত্যেকে দিনে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করে সোশাল মিডিয়াতে।

দুই নায়কের ডিপফেইক ভিডিওর অনেকগুলো পোস্ট সোশাল মিডিয়া থেকে ব্লক করা হলেও ২০ এপ্রিল পর্যন্ত  ১৪টি রয়ে গেছে এক্সে; এই তথ্য জানাচ্ছে রয়টার্স।

ফেইসবুকে দুটো ভিডিওতে ফ্ল্যাগ বসিয়েছিল রয়টার্স; পরে ভিডিও দুটি ফেইসবুক মুছে দেয়। যদিও এখনও আরেকটি ভিডিও রয়ে গেছে এখানে।

রয়টার্সকে এক বার্তায় ফেইসবুক জানিয়েছে,  নীতিমালা ভঙ্গের কারণে ভিডিও মুছে দেওয়া হয়েছে। তবে  এক্স থেকে এমন কোনো বার্তা পায়নি রয়টার্স।  

আমির খানের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনো বক্তব্য না দিলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের দুই কর্মকর্তা রয়টার্সের কাছে বলেন, ভিডিও মুছে দিতে ফেইসবুক এবং এক্সের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন তারা।

সোশাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোা তাদের জানিয়েছে, ভিডিও মুছে ফেলা হয়েছে।   

এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভিডিওগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কি না নজর রাখতে গত শুক্রবার অর্থ্যাৎ ১৯ এপ্রিল ভোররাত ২টা পর্যন্ত তারা জেগে ছিলেন এবং বারবার ওয়েব সাইট রিফ্রেশ করে দেখছিলেন।  

তদন্তের অগ্রগতি কতদূর?

রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে ওই দুই পুলিশ জানায়, “এ ধরনের তদন্তে সময় বেশি লাগে।”

এআই দিয়ে ভোট চাইলেন মৃত নেতা

ভারতের দক্ষিণে কংগ্রেস নেতা ভিজায় ভাসান্থের মুখপাত্র বললেন, তারা এআই দিয়ে দুই মিনিটের অডিও-ভিডিও বানিয়ে সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ করেছে। এই ভিডিওতে এইচ ভাসান্থকুমারকে দেখা যায় ছেলের পক্ষে ভোট চাইছেন সবার কাছে। অথচ তামিলনাড়ুর ব্যবসায়ী এবং ইনডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা হারিকৃষ্ণান নাদার ভাসান্থকুমার ২০২০ সালের অগাস্টে মারা গেছেন।

মৃত রাজনৈতিক নেতা এইচ ভাসান্থকুমার ভিডিওতে বলছেন, “আমার শরীর হয়তো আপনাদের ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু আমার আত্মা এখনও আপনাদের চারপাশে রয়েছে।”

এআই উপস্থাপক সমতা নিজ দলের গুণকীর্তন এবং বিরোধী পক্ষকে তুলোধুনো করেন

কমিউনিস্ট পার্টি অব ইনডিয়া-মার্ক্সিস্ট (সিপিএম) দলের থেকেও ইউটিউবে নির্বাচনী ভিডিও তোলা হয়েছে। এতে সমতা নামে এক এআই উপস্থাপক শাড়ি পরে খবর পাঠকদের মতো করে কথা বলে; সমতা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করে ভিডিওতে।

সমতা আরও বলে, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারে থাকা দলটি পরিবেশ নিয়ে কোনো পরোয়া করেনি; তাদের আমলে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে অনেক জলাশয় হারিয়ে গেছে।

রাজ্য সরকারে থাকা দলটি এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা কোনো অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ হতে দেয়নি।

রয়টার্স এসব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছিল বলে জানাচ্ছে; তবে এতে সাড়া পায়নি তারা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত