Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

খোলা কলম

বুয়েটে ‘সাংবাদিক সমিতি’ নিয়ে কিছু প্রশ্ন

‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’র ওয়েবপোর্টালে সর্বশেষ কমিটি বাতিলের কথা জানিয়ে শিগগিরই নতুন কমিটি ঘোষণার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

গণমাধ্যমকর্মী বা একজন সাংবাদিক হয়ে ওঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় প্রতিনিয়ত। তাই একসময় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার কারণে এই পেশাকে ঘিরে যখন কোনও অপমানজনক কথা শোনা যায় বা নেতিবাচক কোনও খবর ঘুরে বেড়ায় তা আমার মতো অনেককেই কষ্ট দেয়।

বিশ্বজুড়ে গণমানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে বিগত কয়েক শতক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মী তথা সাংবাদিকরা। এ কারণে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোরও সমাজে রয়েছে নানামুখী গুরুত্ব। কিন্তু যখন সেই সাংবাদিকতার নাম নিয়ে কোনও সংগঠন তৈরি হয় এবং সেখানে কোনও গণমাধ্যম কর্মী না থাকে, তখন বিষয়টি যেমন শঙ্কার, তেমনি লজ্জাজনক। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাংবাদিক সমিতি নামের সংগঠনটি নিয়ে তেমনি এক অনুভূতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি আমার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’ নামে পরিচিত। এক পর্যায়ে এই সাংবাদিক সমিতির সদস্যও ছিলাম আমি। কিন্তু আমাদের এই সাংবাদিক সমিতির প্রতিটি সদস্য যুক্ত ছিল দেশের স্বনামধন্য সব গণমাধ্যমের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন জটিলতা ও সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা একাডেমিক অর্জন নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিবেদন লিখতে হয়েছে। এসময় বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে ছিল বুয়েটের খবর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করা। অনেক সংবাদমাধ্যমেরই ঢাবি প্রতিনিধি থাকলেও বুয়েটে আলাদা প্রতিনিধি না থাকায় আমার মতোই ঢাবি সাংবাদিক সমিতির অধিকাংশ সদস্য বুয়েটের খবর সংগ্রহ করে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে পাঠাতেন। ফলে দীর্ঘদিন যাবৎ বুয়েটে আলাদা প্রতিনিধি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি দেশের গণমাধ্যমগুলো। এখনও পরিস্থিতি প্রায় একইরকম।

কিন্তু বেশ আশ্চর্যজনকভাবেই হঠাৎ করে আলোচনায় এসেছে ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’। সেটা যতটা না ইতিবাচকভাবে, তার থেকেও বেশি নেতিবাচকভাবে। গত সপ্তাহে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠ্য ক্লাব বুয়েট সাংবাদিক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের ২০২৩-২৪ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।

বুয়েট সাংবাদিক সমিতির গঠনতন্ত্রে সদস্য গ্রহণের শর্ত থাকলেও সেটি পূরণ করা হচ্ছে না।

উপরন্তু, ‘সাংবাদিক সমিতি’ নামধারী এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের নিউজ পোর্টাল ও ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে বুয়েট ক্যাম্পাসে গুজব ও অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ আছে। তাছাড়া, সম্প্রতি টাঙ্গুয়ার হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে যে ৩৪ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তাদের মধ্যে বুয়েট সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ ছয়জন সদস্য ছিলেন। ওই ছয় আসামি হলেন—মাঈন উদ্দীন, ফাহাদুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান, খালিদ আম্মার, তানভীর আরাফাত ফাহিম ও সাদ আদনান অপি।

খেয়াল করার মতো বিষয় হলো, ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’র সদস্যরা দেশের অন্যান্য সাংবাদিক সমিতির সদস্যদের মতো কোনও জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত নন। বুয়েট সাংবাদিক সমিতির একটি নিজস্ব নিউজ পোর্টাল ও ফেইসবুক পেইজ রয়েছে, যেখানে তারা বুয়েট সম্পর্কিত সংবাদ ও তথ্য প্রচার করেন।

গত বছরের ৩১ জুলাই ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাওয়া বুয়েটের ২৪ জন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ৩৪ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যাদের নামে এখনো আদালতে মামলা চলমান এবং তারা জামিনে আছেন। পুলিশের দাবি, গ্রেপ্তারকৃতরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং তারা হাওরে বেড়ানোর উছিলায় সেখানে গোপন বৈঠক ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করতে গিয়েছিলেন।

বুয়েট কর্তৃপক্ষ ওই সাংবাদিক সমিতির সর্বশেষ কমিটি বাতিল বলে ঘোষণা করেছে বটে, কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, এই সমিতির ‘সাংবাদিক’ সদস্য কারা?

খেয়াল করার মতো বিষয় হলো, ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’র সদস্যরা দেশের অন্যান্য সাংবাদিক সমিতির সদস্যদের মতো কোনও জাতীয় সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত নন। বুয়েট সাংবাদিক সমিতির একটি নিজস্ব নিউজ পোর্টাল ও ফেইসবুক পেইজ রয়েছে, যেখানে তারা বুয়েট সম্পর্কিত সংবাদ ও তথ্য প্রচার করেন।

বুয়েট সাংবাদিক সমিতি নামে ফেইসবুক পেইজ থেকে নানা সময়ে এমন পোস্ট করা হয়।

স্বীকৃত কোনও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত না থেকে কিছু ব্যক্তি নিজেদের কিভাবে ‘সাংবাদিক’ হিসেবে দাবি করেন? একইভাবে সাংবাদিকতার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে না থেকে সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা মেনে চলার তোয়াক্কা না করে ‘নিউজ পোর্টাল’ নাম দিয়ে কোনও ওয়েবসাইট চালানো কিংবা ওই সমিতির নামে ‘ফেইসবুক পেইজ’ চালানোর অধিকারই বা তারা কিভাবে পান?   

বর্তমান যুগে সাংবাদিকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব গুজব প্রতিরোধ করা এবং গুজবের বিপরীতে সত্য প্রকাশ করা। এজন্য গণমাধ্যমগুলো একাধিক চেকপয়েন্ট বা সাংবাদিকতার ভাষায় বললে ‘গেট কিপিং’-এর ব্যবস্থা রেখেছে। গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থারও অন্যতম কারণ নির্ভুল তথ্য প্রদানের এমন ব্যবস্থাপনা। সেই গণমাধ্যমই মানুষের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য, যারা ভুল তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে।

বুয়েট সাংবাদিক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা চারজনকে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কিন্তু বুয়েটের সাম্প্রতিক অচলাবস্থার ক্ষেত্রে ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’ গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সাংবাদিক সমিতি থেকেই বুয়েটের ছাত্র ও আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজের একটি ফেইসবুক পোস্ট শেয়ার করা হয়, যেখানে ভুল তথ্য ছিল। একটি সংগঠন যখন ‘সাংবাদিক সমিতি’ নাম নিয়ে কোনও গুজব প্রচার করে তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা সহজেই তা বিশ্বাস করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি সত্যিকার অর্থেই এই সমিতি সাংবাদিকদের দ্বারা পরিচালিত হতো, তাহলে তারা কোনও সংবাদরে নামে কোনও গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার আগে অবশ্যই বারবার তথ্য যাচাই করে নিত। কিন্তু যেহেতু এই সমিতি পরিচালনা করা কেউই সাংবাদিক নয়, সুতরাং তাদের এই বিষয়ের গুরুত্ব বোঝানো অসম্ভব।

বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই সাংবাদিক সমিতি রয়েছে। সবগুলো সমিতিই সংবাদমাধ্যমকেন্দ্রিক, নিজস্ব কোনও পোর্টাল বা ফেইসবুকপেইজকেন্দ্রিক নয়। কিছু শিক্ষার্থী তাদের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই ফেইসবুক পেইজে লিখে দেবেন এবং সেটাই সাংবাদিকতা হয়ে যাবে, তাহলে সংবাদমাধ্যমের এই বিশাল পরিসর ও শিল্প গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?

প্রশ্ন হলো, বুয়েটের কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী তৎপরতায় সংশ্লিষ্ট থাকার অপরাধে পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত কার্যক্রম চালালেও কেন তাদের বিরুদ্ধে  কোনও ব্যবস্থা নিতে অক্ষম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? এমনকি মৌলবাদী গোষ্ঠীর ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত থাকার পরও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বুয়েট প্রশাসন। কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রমাণহীনভাবে একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। আবার আদালতের মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ বাতিলও হচ্ছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে এমন দ্বৈতনীতির অবস্থান নিয়েও কোনও প্রশ্ন উঠছে না সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাংবাদিক সমিতি’ নামে পরিচালিত সংগঠনটি থেকে।

বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই সাংবাদিক সমিতি রয়েছে। সবগুলো সমিতিই সংবাদমাধ্যমকেন্দ্রিক, নিজস্ব কোনও পোর্টাল বা ফেইসবুকপেইজকেন্দ্রিক নয়। কিছু শিক্ষার্থী তাদের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই ফেইসবুক পেইজে লিখে দেবেন এবং সেটাই সাংবাদিকতা হয়ে যাবে, তাহলে সংবাদমাধ্যমের এই বিশাল পরিসর ও শিল্প গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?

একইসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও এটা বুঝতে হবে যে, শুধু কমিটি বাতিল করলেই হবে না, বরং ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’ নামে কোনও সংগঠনকে কার্যক্রম চালাতে দিতে হলে অবশ্যই সেই সংগঠনের সদস্যদেরকে প্রকৃতঅর্থেই সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে।

সাংবাদিকতা বিষয়ক সংগঠনগুলোর এসব বিষয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত। সাংবাদিক সংগঠন হিসেবে যে কেউ নতুন সংগঠন খুলে বসলে তার সম্পর্কে তথ্য যাচাই বাছাই করা উচিত। প্রয়োজন বোধে প্রকৃত সাংবাদিকদের সংগঠন যেমন বিএফইউজে, ডিইউজ, জাতীয় প্রেস ক্লাব বা রিপোর্টাস ইউনিটির মতো স্বীকৃত সংগঠনগুলোর কাছ থেকে এমন বিষয়ে সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। আবার স্বীকৃত এসব সংগঠনেরও দায়িত্ব থেকে যায় এমনসব ভুঁইফোড় সংগঠনের বিষয়ে কথা বলা বলার।

একইসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও এটা বুঝতে হবে যে, শুধু কমিটি বাতিল করলেই হবে না, বরং ‘বুয়েট সাংবাদিক সমিতি’ নামে কোনও সংগঠনকে কার্যক্রম চালাতে দিতে হলে অবশ্যই সেই সংগঠনের সদস্যদেরকে প্রকৃতঅর্থেই সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। পাশাপাশি, বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও উচিত এই বিষয়গুলো আরও যাচাই বাছাই করে দেখার। আর শেষকথা হলো, বুয়েটই হোক বা অন্য কোথাও যেকোনও ‘সাংবাদিক সংগঠন’ যেন প্রকৃত সাংবাদিকদের দ্বারাই পরিচালিত হয়।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সাবেক প্রতিনিধি ও ঢাবি সাংবাদিক সমিতির সাবেক সদস্য।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত