‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে’
অন্ধ দাবাড়ু সৈয়দ এজাজ হোসেনের জীবনের গল্পটা রবি ঠাকুরের গানের সঙ্গে কি দারুণভাবেই না মিলে যায়!
সড়ক দুর্ঘটনায় চোখ হারিয়ে ফেলা। এরপর হতাশার রাজ্যে ডুবে গিয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবা। এক পর্যায়ে নিজের সঙ্গে লড়াই করে আবারও আলোয় ফেরার আনন্দ। বিষন্নতা থেকে মুক্ত হয়েই এজাজ হারিয়ে যান সাদা কালোর চৌষট্টি ঘরে। জীবনের সব রকমের আনন্দ নতুন করে খুঁজে নিয়েছেন দাবার বোর্ডে।
শনিবার দাবা ফেডারেশনে শেষ হয়েছে ইস্পাহানি ফিদে রেটিং দাবা প্রতিযোগিতা। শারীরিক, দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী দাবাড়ুদের নিয়ে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে অংশ নেন ৩১ জন দাবাড়ু। যেখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এজাজ।
ছোটবেলায় এজাজ স্বপ্ন দেখতেন কম্পিউটার প্রোগ্রামার হবেন। দাবাটাও খেলতেন দুর্দান্ত। সমস্যা ছিল একটাই, দু চোখের রেটিনা দিয়ে মাঝে মধ্যে রক্ত পড়তো। সেটা একটা অসুখ, চিকিৎসাও চলতো। তবে চোখের আলো একেবারে নিভে যায়নি তার।
২০০৩ সালে হঠাৎ এজাজের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সড়ক দুর্ঘটনায় চোখে আঘাত লাগলে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান এজাজ। দুর্ভাগ্যও তখন থেকে পিছু নেওয়া শুরু। জাতীয় দাবার বাছাইপর্ব পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েও সেবার খেলা হয়নি এজাজের।
অন্ধ এজাজ এরপর হতাশার রাজ্যে ডুবে যেতে থাকেন। টগবগে এক তরুণ। চোখে ছিল হাজারো স্বপ্ন। ও লেভেল পাশ করে আরও উচ্চতর পড়াশুনার লক্ষ্য ছিল যার। সঙ্গে ছিল গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার আশা। সেই এজাজের জীবনের সব স্বপ্ন এলেমেলো করে দেয় ওই সড়ক দুর্ঘটনা।
রাস্তা পার হতে গিয়ে মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চোখের রেটিনা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এজাজের।
দাবার বোর্ডের সাদাকালো ঘরের মতো এজাজের জীবনেও রং হারিয়ে যায়। ব্যবসায় লোকসানে পড়ে ধুঁকতে থাকা বাবা মারা যান ২০১৭ সালে। পরিবারের উপার্জনের মতো আর কেউ ছিল না তাদের। আত্মীয় স্বজনের আর্থিক সহযোগিতায় চলতে হতো তাদের। অন্ধ হওয়ায় কোনও কাজ কর্মও করতে পারতেন না। স্নাতকোত্তোরের পড়াশুনটা থমকে যায় শুধু বিষন্নতায় ভোগার জন্য। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। সব মিলিয়ে হতাশা যেন আরও জেঁকে বসে তাকে। ৪১ বছর বয়সী এজাজ বলেছেন সেই দুঃসময়ের গল্প, “ওই সময় আমি পুরোপুরি বাবার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম চলাফেরার জন্য। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম ব্যবহার করেছি দীর্ঘদিন। এই ৯ বছরে একজন প্রতিভাবান ছাত্রের কি পরিমান বিষন্নতা ঘিরে ধরতে পারে সেটা কেউ বুঝবে না। জীবনের সব আনন্দই মুছে গিয়েছিল। দাবার কথা ভাবলেই দুঃখে মনটা ভরে উঠতো। এমনকি আত্মহত্যার কথাও মাথায় ঘুরপাক খেতো।”
দাবাই তাকে আবার বিষন্নতা কাটিয়ে আলোর দিশা দিয়েছে। ওই অবস্থায় ২টি টুর্নামেন্টে খেলার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি, “তখন অন্ধ হয়ে গেলেও ঘরে আলো আছে কিনা সেটা বুঝতে পারতাম। একটা দাবার বোর্ডকে পুরোপুরি কালো রং করে প্রতিটি ঘুটিকে উজ্জ্বলভাবে সাদা রং দিয়ে সাজানোর পর ২০০ পাওয়ারের ভাল্ব জ্বালিয়ে খেলা চালানো হতো। ওই অবস্থায় ঝাপসাভাবে দেখতে পেতাম। এবং খেলাটা চালিয়ে যেতাম।”
পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতিতে খেলার পর যদিও খুব বেশি দিন চলতে হয়নি এভাবে। তাকে খেলতে দেখে অন্ধদের টাচবোর্ড সম্পর্কে ধারণা দেন আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদ। সেই ধারনা নিয়ে তিনিও চেষ্টা করেন এবং টাচবোর্ডেই ফিরে পান হারানো আত্মবিশ্বাস। অতপর ছেলেবেলার প্রিয় দাবাই খুলে দেয় তার মুক্তির পথ। বেঁচে থাকার উপায়ও।
প্রায় ১০ বছর পর ২০১২ সালে আবারও দাবায় ফিরে অন্ধ এজাজ খেলা শুরু করেন। অংশ নেন প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে।
এক পর্যায়ে অনলাইনে বসে অন্ধ দাবাড়ুর সঙ্গে অনুশীলন শুরু করেন এজাজ। এভাবে খেলতে খেলতেই আত্মবিশ্বাস বাড়ে এজাজের। ২০১৪ সালে আবারও নিয়মিত ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় ফেরেন তিনি। দ্বিতীয় বিভাগ দাবায় খেলেন স্বাভাবিকদের সঙ্গে চেস কিউ ক্লাবের হয়ে। কিন্তু খুব বেশি ভালো পারফরম্যান্স করতে পারেননি।
এজাজকে নতুন করে দাবার জগতে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদুর রহমান মল্লিক। যিনি ফিদে ডিজেবল কমিশনের সদস্যও। এজাজ বলছিলেন, “দিপু ভাইয়ের কথা শুনে নতুন করে টুর্নামেন্টে খেলতে এসেছি। আসলে গত ৩-৪ মাস ধরে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠেছি পুরোপুরি। এখন আমি নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা এনজিও সংগঠন শুরু করতে চাই। আমার মতো যে সব অন্ধ মানুষ অতিরিক্তি বিষন্নতায় ভুগছে তাদের নিয়ে কাজ করতে চাই। এজন্য আমার প্রয়োজন স্পনসর সহযোগিতা।”
এজাজ যেন অন্ধ হয়েও একা একা জীবনকে জয় করতে পারেন, এজন্য মা তাকে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছেন। যদিও একাকী জীবনে এরই মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন অন্ধ এজাজ।
এজাজের অনুপ্রেরণার নাম যুক্তরাজ্যের দাবাড়ু ক্রিস রস। জন্ম থেকেই যিনি অন্ধ। ২০১৫ সালের আইবিসিএ (ইন্টারন্যাশনাল ব্রেইল চেস অ্যাসোসিয়েশন) অলিম্পিয়াডে রস জেতেন রুপার পদক।
রসের মতো অলিম্পিয়াডে খেলার স্বপ্ন তার। জিততে চান পদক, “আমি অন্ধদের অলিম্পিয়াডে খেলতে চাই। রস পারলে আমি কেন পারব না?” আত্মহননের পথ ছেড়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এজাজের চোখে এখন শুধুই দাবার আলো।