Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

যে জীবন যোদ্ধার যে জীবন অভিনেতার   

humayan faridi final
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির স্নাতকের ছাত্র ছিলেন অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। এসময় শুরু হলো বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। দেশ বাঁচানোর প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফরীদি। যুদ্ধ শেষে পড়াশোনায় ফেরত না গিয়ে বেছে নেন বোহেমিয়ান জীবন। পাঁচ বছর পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে স্বাধীন দেশে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি সন্ধান পান নিজের সুপ্ত প্রতিভার। সবুজে ঘেরা এই ক্যাম্পাসেই বিকশিত হতে থাকে তার প্রতিভার ডালপালা, একসময় যা পরিণত হয় মহীরুহে। 

১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল কিংবদন্তী অভিনেতা প্রয়াত হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যু দিন। ঢাকাই চলচ্চিত্রে ভিলেন রোলের ধারণা পালটে দেওয়া এই অভিনেতার ছিল এক বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবন। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মঞ্চে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তিনি। 

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ুন ফরীদি। বাবা এটিএম নুরুল ইসলামের ছিল বদলির চাকরি। সে সুবাদে শৈশব- কৈশোর কেটেছে মৌলভীবাজার, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জসহ নানা জেলায়। বাবা ছিলেন জুরি বোর্ডের কর্মকর্তা। মা বেগম ফরিদা ইসলাম ছিলেন গৃহিনী।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন প্রবাদপ্রতীম নাট্যকার সেলিম আল দীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চ নাটকের সঙ্গে।  

১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নাট্য উৎসব। যার প্রধান সংগঠক ছিলেন ফরীদি। সেখানে ‘আত্মস্থ ও হিরণ্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন।

তবে হুমায়ুন ফরীদি নিজের জীবনের প্রথম অভিনয় হিসেবে বিবেচনা করেন শৈশবের একটি মজার ঘটনাকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেন, “বাবার পকেট থেকে ১০ টাকা চুরি করে এমন ভান করছিলাম যে এই কাজ আমি করতেই পারিনা। এটাই ছিল আমার প্রথম অভিনয়।”

১৯৭৬ সালে ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হোন ফরীদি। সেখানে একে একে কাজ করেছেন শকুন্তলা, ফণীমনসা, কীত্তনখোলা, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি এবং কেরামত মঙ্গল- এর মতো মঞ্চ নাটকে। 

১৯৯০ সালে ঢাকা থিয়েটার থেকেই পরিচালনা করেন নাটক ‘ভূত’। আর এই নাটক দিয়েই শেষ হয় ফরীদির ঢাকা থিয়েটার পর্ব।

বলা হয়ে থাকে, নাট্যজন ও চলচিত্র পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর হাত ধরেই নাকি হুমায়ুন ফরীদি যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নাট্য উৎসবে বাচ্চু গিয়েছিলেন বিচারক হয়ে। সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেন ফরীদিকে। বুঝতে পারেন এই তরুণ একদিন যাবে বহুদূর।  

আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরীদির অভিনীত প্রথম টিভি নাটক।

সে সময় টিভি নাটক মানেই বিটিভি। বিটিভির জনপ্রিয় ‘সংশপ্তক’ নাটকে ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি রীতিমতো সুপার স্টারে পরিণত হন।

কিন্তু টিভি নাটকের সুপারস্টার হঠাৎ ঢাকাই চলচ্চিত্রে কেন এসেছিলেন? এই প্রশ্ন জীবদ্দশায় শুনেছিলেন বহুবার। 

উত্তরে তিনি বলতেন, মূলত সংসার চালাতেই টিভি নাটক ছেড়ে সিনেমায় এসেছিলেন। 

ফরীদির ভাষায়, সে সময় বিটিভিতে নাটক করে অভিনয়শিল্পীরা পেতো ৪২০ টাকা। এই টাকায় সংসার চালানো কঠিন। কিন্তু সিনেমায় কাজ করে যা পাওয়া যেতো তাতে সংসার চালানো সহজ ছিল।

মূলধারার চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম শুটিং করেন ‘দিনমজুর’ সিনেমার জন্য। তবে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘সন্ত্রাস’। শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত এ দুটো সিনেমাই ছিল ব্যবসায় সফল।

হুমায়ুন ফরীদি প্রযোজিত একমাত্র সিনেমা ‘পালাবি কোথায়’। যদিও তিনি এর একমাত্র প্রযোজক ছিলেন না। এই সিনেমার আরও বেশ কয়েকজন প্রযোজকের একজন ছিলেন তিনি। এই সিনেমায় তিনি নিজেও অভিনয় করেছিলেন। 

এই ছবিতে টাকা বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়েছিলেন ফরীদি। এরপর আর কোন সিনেমায় প্রযোজনা করা হয়নি তার। 

‘পালাবি কোথায়’ তামিল অভিনেতা কমল হাসান প্রযোজিত সিনেমা ‘মাগালিত মাততুম’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করা হয়। যা কিনা আবার হলিউড সিনেমা ‘নাইন টু ফাইভ’ থেকে অনুপ্রাণিত।

মূলধারার চলচ্চিত্রে পা রাখার আগে স্বল্পদৈর্ঘের সিনেমায় অভিনয় করা হয়েছিল এই গুণী অভিনেতার। আর সে সিনেমার নাম ‘হুলিয়া’। যার পরিচালক ছিলেন তানভির মোকাম্মেল। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪ সালে।

ঘটনাবহুল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি স্মৃতি ফরীদিকে প্রায়ই নাড়া দিতো। আর এ ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদের নাম।

এক গ্রীষ্মে ফরীদি বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ একদিন এক বন্ধু ফোন করে জানালো, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফজল মাহমুদ আত্মহত্যা করেছেন। এই ঘটনাটি ফরীদিকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আর ফোন করে এই খবরটি তাকে জানিয়েছিলেন সেদিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনু মুহাম্মদ।

মৃত্যুকে সহজভাবে নেওয়ার কথা বলতেন এই অভিনেতা। মৃত্যু নিয়ে বলা তার কিছু কথা নানা সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতো এত স্নিগ্ধ, এত গভীর সুন্দর আর কিছু নেই। কারণ, মৃত্যু অনিবার্য। তুমি যখন জন্মেছ, তখন মরতেই হবে। মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় থাকলে কেউ পাপ করবে না। যেটা অনিবার্য, তাকে ভালোবাসাটাই শ্রেয়।’ 

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মৃত্যুকে ভয় পাওয়া মূর্খতা। জ্ঞানীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করো, গ্রহণ করো, বরণ করে নাও। তাহলে দেখবে জীবন কত সুন্দর।’

হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধুর অকাল মৃত্যুই তাকে শিখিয়েছিল মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিতে। 

হুমায়ুন ফরীদি অভিনয় করেন ১০০টিরও বেশি সিনেমায়।

তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিনেমা হলো ‘বীরপুরুষ’, ‘লড়াকু’, ‘দহন’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’, ‘আঞ্জুমান’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘ব্যাচেলর”, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ প্রমুখ।

তার মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ সিনেমা ‘এক জবানের জমিদার হেরে গেলেন এইবার’। উত্তম আকাশ পরিচালিত ছবিটি ২০১৬ সালে মুক্তি পায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত