Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ভারতের নারীরা স্তন ছোট করতে অস্ত্রোপচার কেন করছেন

reduction-breast-270424
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

আগে যেখানে সিনেমা জগতে নামতে গেলে অনেক নায়িকা স্তনের আকার বাড়িয়ে নিতেন অস্ত্রোপচার করে, গত পাঁচ বছরে না কি তার উল্টোটা ঘটছে ভারতে।

২০১৯ সাল থেকে  প্রতি বছরই শতভাগ করে বাড়ছে স্তন ছোট করার অপারেশন।  কিন্তু এই উল্টো রথ কেন?

নিজের অভিজ্ঞতা মনে করে ইনডিয়া টুডের কাছে জাসপ্রীত (ছদ্মনাম) বলেন, “আমার সেই দিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ হলো মাত্র। বাড়ি ফিরতে বাসে উঠেছি। শুনতে পেলাম কেউ একজন চিৎকার করে বলে উঠলো, ওয়াও, এতো বড় স্তন।”

কথাটা শুনে ধাক্কা খেয়েছিলেন জাসপ্রীত। ঘুরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, কে বলতে পারে এভাবে? কিন্তু তাকে খুঁজে পাননি আর। শুধু বুঝতে পারলেন, এমন কথা বলার ধৃষ্টতা যিনি দেখিয়েছেন তিনি একজন পুরুষ।   

১৮ বছরে পা রাখা একজনের জন্য নিজের শরীর নিয়ে হয়রানিমূলক কথা শোনার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। নানা জনের আপত্তিকর কথা শুনতে শুনতে ২৪ বছর পর জাসপ্রীত ঠিক করলেন, তিনি স্তনের হাইপারট্রফির চিকিৎসা করাবেন।

অঙ্গ বা পেশীর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াকে হাইপারট্রফি বলে।  অস্ত্রোপচারের পর জাসপ্রীতের স্তনের আকার কমে আসে।  

“আমার স্তনের আকার ৪২এইচ থেকে ৪০বি হয়ে গেলো। আমি ভীষণ স্বস্তি পেলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে ভীষণ  আনন্দ হলো আমার।”

জাসপ্রীত একাই নয়; বিরল হলেও স্তনের হাইপারট্রফি সমস্যায় ভুগছেন হাজার হাজার ভারতীয় নারী। আর এ কারণেই এই নারীদের অনেকে অস্ত্রোপচার দিয়ে স্তন ছোট করতে আগ্রহী হচ্ছেন।    

স্তন ছোট করার অস্ত্রোপচার বাড়ছে

ঠিক কত সংখ্যক অপারেশন হয়ে সে তথ্য খোঁজ করেছিল ইনডিয়া টুডে। তবে এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন নিউ দিল্লির ডিভাইন এসথেটিকস এর প্লাস্টিক সার্জন অমিত গুপ্তা।    

তিনি বলেন, “ভারতে অস্ত্রোপচারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ব্যবস্থা নেই। অথচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের পরিসংখ্যান রাখা হয়।

“তবে আমার কাজের সূত্র ধরে বলি, তাহলে সাধারণ হিসেবে আমি বলবো গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি বছর শতভাগ করে বেড়েছে। এমনকি এর বেশিও হতে পারে।”

এই পরিসংখ্যান সঠিক বলে মনে করছেন চিকিৎসক আকাঙ্ক্ষা গোয়েল এবং শুধাংশু পুনিয়া।  এই দুজন  নিউ দিল্লিতে নারীর স্তন ছোট করার অপারেশন করেন।    

কত সংখ্যক অপারেশন হয় সেই ধারণা দিতে চিকিৎসক পুনিয়া বলেন, “সপ্তাহে অন্তত একটি অপারেশন তো করা হয় -ই। তারমানে মাসে চার থেকে ছয়টা অপারেশন।”

অথচ আগে  তারা মাসে মোটে একটা অস্ত্রোপচার করতেন; এতেই বোঝা যায় নারীরা আগের থেকে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন স্তন ছোট করতে।   

চিকিৎসক গুপ্তা বলেন, তরুণীদের মধ্যে স্তন ছোট করার অস্ত্রোপচার সংখ্যা বাড়ছে।

মেয়েরা কেন তাদের বুকের মাপ ছোট করে আনতে চায়?

সবাই ঝোঁকের বশে অস্ত্রোপচার করছে না, স্তনের মাপ ছোট করে আনায় অনেকেরই শক্তপোক্ত কারণ আছে ।

১. পশ্চিমাদের দেখে প্রভাবিত

শাড়ি ও কুর্তা হলো ভারতীয় নারীদের পরিধেয়। যদিও এতো বছর ধরে পশ্চিমাদের পোশাকের ধরনে প্রভাবিত হয়েছে ভারতীয় নারীরা।  

চিকিৎসক গুপ্তা বলেন, “এখন টিশার্ট এবং আঁটোসাঁটো কাপড় পরছেন সবাই। কিন্তু যাদের ভারী স্তন তাদের ঘাড়ে ও গলায় ব্যথা হয়।”

পছন্দের ওয়েস্টার্ন জামা পরার বাসনা থেকেই অনেক নারী স্তন ছোট করে নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।  

৩০ বছর বয়সী মিনাক্ষী আগারওয়াল (ছদ্মনাম) একজন উদ্যোক্তা। ২০১০ সালে স্তন ছোট করিয়ে নেন তিনি।  আর তারপর প্রথমেই এতদিন ধরে পরার ইচ্ছে পুষে রাখা পোশাকটি গায়ে চাপান।

“আমেরিকা ঘুরতে যাওয়ার ছবিটা আমার কাছে এখনও আছে। সেখানে আমি ওই জামা পরেছিলাম; এতদিন ধরে ওটাই পরতে চেয়েছিলাম আমি”, বললেন মিনাক্ষী।

২. নারী স্বাধীনতা

এক দশক আগেও নারী তার বাবামা অথবা স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিল। যে কারণে এ ধরনের অপারেশনের কথা পরিবারে জানানো নিয়ে লুকোচুরি ছিল তাদের মধ্যে।

 সেই সময় কাটিয়ে নারী এখন অনেকখানি স্বাধীন।  

অমিত গুপ্তা মনে করেন, “২৫ বছরের নারী নিজের অপারেশনের খরচ জোগাতে পর্যাপ্ত আয় করেন। বেশির ভাগ নারীই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেন। এমনটা ১০ বছর আগেও দেখা যেত না।”

আর তাই ভারী স্তনের বোঝা বুকে উপর চেপে রাখার কষ্ট নিয়ে চলতে চান না আজকের নারীরা।

“তারা অর্থ জমান সার্জারি করাবেন বলে। কারণ তারপরেই গলা এবং পিঠের বেদনা থেকে মুক্তি মিলবে তাদের।”

৩. আত্মবিশ্বাস বাড়াতে  

একজন সার্জন হিসাবে গুপ্তা বলেন, “প্রতিবার অস্ত্রোপচারের পর আমি দেখতাম অনেক রোগী কাঁদছে। বুকের উপর থেকে জগদ্দল পাথর নেমে গেলো যেন তাদের।”

মিনাক্ষী এবং জাসপ্রীত দুজনের কেউ-ই অস্ত্রোপচারের আগে নিজের শরীর নিয়ে স্বস্তিতে ছিলেন না। একথা তারা দুজনেই জানান ইনডিয়া টুডের কাছে।

স্তন ভারী হওয়ার কারণে আড্ডা-সামাজিকতা এড়িয়ে চলতেন মিনাক্ষী। এমনকি শরীরচর্চার জন্যও যেতেন না বাইরে কোথাও।  সবার থেকে আড়াল হতে পড়ার মধ্যে ডুবে থাকতেন তিনি।  

“সামাজিক আড্ডাতে আমি স্বস্তি বোধ করতাম না। এমনকি যখন কর্মক্ষেত্রে যেতাম তখনও। আমার এখনও মনে পড়ছে, কম বয়সে আমি খুব সতর্ক থাকতাম আমার ভারী বুক নিয়ে।”

সন্তান হওয়ার পর মিনাক্ষী সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার অস্ত্রোপচার করাবেন।

অপারেশনের পর অন্তর্বাসের মাপ ৩৮ থেকে ৩৪ হয়ে গেলে মিনাক্ষী যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন।

প্রতি গ্রীষ্মে আজেবাজে কথার শিকার হতেন জাসপ্রীত।

যখন কোনো পোশাক পরতেন, বড় স্তনের কারণে নিজের কাছে নিজেকে অদ্ভুত মনে হতো তার।  

“আমার কোনো পোশাকে নিজেকে ভালো লাগতো না।”

কিন্তু অস্ত্রোপচার করার পর জাসপ্রীত নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন।

”সার্জারির পর আমি দোকানে গিয়ে কয়েকটা অন্তর্বাস পরে দেখলাম। আগে আমার মাপে কোনোকিছুই পেতাম না। অথচ সেইদিন আমার মনে হলো, ওয়াও! আমার গায়ে মাপ মতো হওয়ার মতো পোশাকও আছে তাহলে”, বললেন জাসপ্রীত।

৪. সোশাল মিডিয়া

২০২৪ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শরীরের সঠিক মাপ ধরে রাখা নিয়ে অনেক ভিডিও জনপ্রিয় হচ্ছে। এরমধ্যে স্তন ছোট করার প্রক্রিয়া, চিকিৎসক বা রোগীর কথাও বাকিরা জানতে পারছেন। এতে করে অন্য নারীরা এ ধরনের অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন।

“যেমন অপারেশনের আগে ও পরের ছবি আমরা সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করে থাকি। যেন অন্যরা একটা ভালো ধারণা পায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষ এখন জানে এ ধরনের সার্জারিও করানো যায়। ১০ বছর আগেও মানুষের এ নিয়ে ধারণা ছিল না কোনো”, বললেন চিকিৎসক গোয়েল।

সামাজিক মাধ্যমে যৌনহয়রানি

গত ৫ মার্চ বিগ বসের ১৭ পর্বের প্রতিযোগী আয়েশা খান জানালেন, বাবার চেয়েও বয়সী একজন তার স্তন নিয়ে বাজে কথা বলেছেন।  

ওই ভয়ানক অভিজ্ঞতা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি বাড়ির কাছে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। ওখানে দুই চাকার বাহনে বসে থাকা এক বুড়ো লোকও ছিল সেখানে।

“আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো আমার বাবাকে চেনেন। তাই আমি তার ডাকে সাড়া দিয়ে বলেছিলাম, বলুন আংকেল। জবাবে ওই বুড়ো লোক বলেন, “তোমার স্তন জোড়া সুন্দর।” আমি এতোটাই বিব্রত হয়েছিলাম যে, ঘটনাটা এড়িয়ে যেতে চাইলাম।”

সোশাল মিডিয়াতে নারীকে আক্রমণ করা মন্তব্যের অধিকাংশেই থাকে বড় স্তন, বড় নিতম্ব, চিকন কোমর; একথা জানালেন গোয়েল।   

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অস্ত্রোপচারের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই বিরল।  

তবে অনেকের ভীতি কাজ করতে পারে; যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাবে। অস্ত্রোপচারের পর স্তনের বোঁটায় কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে; যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাময়িক হয়।

স্তন ছোট করার পর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে সমস্যা হতে পারে। যদিও অস্ত্রোপচারের পর অনেক নারীই কোনো জটিলতা ছাড়াই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন।

অপারেশনের সময় দুই স্তনের মাপ একই রাখার চেষ্টা করা হয়। এরপরও দুই স্তনের মাপে খানিক কমবেশ হয়ে যেতে পারে।

যে কোনো অপারেশনের পর সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে; স্তন অপারেশনের পরেও তাই। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।

শেষ কথা তাহলে কী?

একটি আদর্শ সমাজে নারীকে কখনেই তার শরীরের জন্য যৌনাত্মক মন্তব্যে হয়রানি করা যাবে না। নারী যতই তার শরীরের অধিকার বুঝে নেবে, ততই শারীরিক ও  মানসিক ভাবে সুস্থ বোধ করবে তারা।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত