অনিয়মে ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সাড়ে চার মাসের মাথায় আবার পরিবর্তন এসেছে। আগের পর্ষদের সাত সদস্যের মধ্যে চারজনই বাদ পড়েছে। নতুন যোগ হয়েছে সাতজন।
বেসরকারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সংখ্যা এখন ১০। তাদের মধ্যে ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের কেউ নেই।
আগের পরিচালকদের মধ্যে থেকে নতুন পর্ষদে থেকে যাওয়া উদ্যোক্তা পরিচালক, চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন।
রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) পরিচালক হারুন-অর-রশিদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পর্ষদ পূনর্গঠনের বিষয়টি ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুল আলম খানকে জানানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিতে এই পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে।
পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদায়ী চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। একটি সেমিনারে যোগ দিতে তিনি এখন বিদেশে আছেন।
ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে ন্যাশনাল ব্যাংকের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সোমবার বিকালে একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে।
আগের পর্ষদ থেকে নতুন পর্ষদে ঠাই পাওয়া তিনজনের মধ্যে অন্য দুজন হলেন শেয়ারধারী উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন ও সিকদার ইন্স্যুরেন্সের মনোনীত পরিচালক সফিকুর রহমান।
বাদ পড়া চারজনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম, সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি এম কামাল হোসেন ও পারভীন হক সিকদার পরিচালক ছিলেন।
পর্ষদে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ রিয়াজুল করিম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম তফাজ্জল হক, রাঙ্গুনিয়ার ব্যবসায়ী এরশাদ মাহমুদ, আইনজীবী আহসানুল করিম।
স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামী, চট্টগ্রামের চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ড. রত্না দত্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জহুরুল হুদা।
একদল শিল্পোদ্যোক্তার উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসাবে ১৯৮৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের যাত্রা শুরু। তবে এক যুগ আগে এর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের হাতে।
তিন বছর আগে জয়নুল হক মারা গেলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। তখন পরিচালনা পর্ষদে তার ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদার, মেয়ে পারভীন হক সিকদারও ছিলেন।
সিকদার পরিবারের দাপটে নানা অনিয়মে তার আগ থেকেই ব্যাংকটি দুর্দশায় পড়ে। এর মধ্যে
জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এক পর্যায়ে গত ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে নতুন পর্ষদও গঠন করে দেওয়া হয়।
ওই পর্ষদে সিকদার পরিবারের অন্য সদস্যদের সরিয়ে দিয়ে শুধু পারভীন হক সিকদারকে রাখা হয়। এবার তাকেও সরিয়ে দেওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংকে সিকদার পরিবারের আর কোনও সদস্য থাকল না।
দুর্বল হয়ে পড়া ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করতে বেশ কয়েকটি সবল ব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ধারার এক্সিম ব্যাংক একটি। তবে এক্সিম ব্যাংক পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আগ্রহ দেখায়।
এরপর গত ৯ এপ্রিল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
তবে আলোচনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত আসায় গত ২৭ এপ্রিল ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এখনই কোনও ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হয়ে কীভাবে সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়, সেই পরিকল্পনা করে।
সেই পথে এগোনোর মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার হস্তক্ষেপ করল।
সারাদেশে দুই শতাধিক শাখা রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের।