Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

ভোট এল যেভাবে

শিল্পীর চোখে প্রাচীন গ্রিসে ভোট দেওয়ার দৃশ্য
শিল্পীর চোখে প্রাচীন গ্রিসে ভোট দেওয়ার দৃশ্য
Picture of শর্মিলা সিনড্রেলা

শর্মিলা সিনড্রেলা

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক অন্যতম প্রক্রিয়ার নাম ‌ভোট। বিশ্বের গণতন্ত্র চর্চাকারী দেশগুলোতে ভোটের জন্য অনেক আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার হয়। এতো বর্তমানের কথা। কিন্তু প্রাচীনকালে ভোট হত কীভাবে? তখন কীভাবে বাছাই হত নিজেদের নেতা?

সেই গল্প ইতিহাসবিদেরা তুলে এনেছেন নানাভাবে। এতে উঠে এসেছে, প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সের কথা। এটি বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র সরাসরি গণতন্ত্রের দেশ। আবার রোমান রিপাবলিকের মতো আধা গণতন্ত্রের দেশের কথাও আছে।

এথেন্স বা রোমের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি শুধুমাত্র ‘‌ডেমোস’দের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। ডেমোস বলতে বোঝানো হত মুক্ত পুরুষ নাগরিকদের। এথেনিয়ান গণতন্ত্রে নারী এবং দাসদের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। 

ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক এরিক রবিনসন তার লেখায় তুলে এনেছেন এথেন্সের ভোটচিত্র। তিনি বলেন, “তখন এথেন্সে ভোট হত খুব কম। প্রাচীন এথেন্সবাসীর বিশ্বাস ছিল, কর্মকর্তা নির্বাচনের জন্য ভোট খুব একটা গণতান্ত্রিক পথ নয়।”

‘‌অ্যানশিয়েন্ট গ্রিক ডেমোক্রেসি’র এডিটর এরিক রবিনসন আরও বলেন, “সবকিছু পরিচালনায় গণতন্ত্রকে পুরোপুরি ক্ষমতা দেওয়া দরকার। সে ক্ষমতা শুধু সম্পদশালীদের হাতে নয়, তুলে দিতে হবে স্বতস্ফূর্তভাবে বেছে নেওয়া ব্যক্তিদের হাতে।”

এথেন্সের মূল পরিচালনা পর্ষদের নাম ছিল ‘কাউন্সিল অব ৫০০’ বা ৫০০ জনের কাউন্সিল। এর দায়িত্বে কে থাকবে তা নির্ধারণে এথেন্সবাসী কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করত। এটা ‘সর্টিশন’ বা বাছাই নামে পরিচিত ছিল। এথেন্সে মোট ১০টি গোত্র ছিল। প্রতিটি গোত্র থেকে ৫০ জনকে নির্বাচন করা হত, যারা এক বছর ৫০০ জনের কাউন্সিলের দায়িত্ব পালন করত।

যুক্তরাষ্ট্রে এক কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের ভোটদানের প্রতীকী ছবি

একজনের এক ভোট

এথেন্সে সব আইন ও আদালতের মামলা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখত অ্যাসেম্বলি। এটি একটি বড় গণতান্ত্রিক পর্ষদ ছিল যেখানে প্রতিটি পুরুষ নাগরিকের কথা বলার অধিকার ছিল। এথেন্সের ৩০ থেকে ৬০ হাজার নাগরিকের মধ্যে অন্তত ৬ হাজার নিয়মিত পরিষদের সভায় অংশ নিতেন। 

তখন এথেন্সের নিয়মিত অ্যাসেম্বলি বসত পাহাড়ের চূড়ায় নিক্স নামের এক উন্মুক্ত অ্যাম্পিথিয়েটারে। নামটি রাখা হয়েছিল গ্রিক শব্দ অনুসারে যার অর্থ ‘শক্তভাবে একত্রিত’। নিক্সে একসঙ্গে ৬ হাজার থেকে ১৩ হাজার সদস্য বসতে পারত।

ইউনিভার্সিটি অব সান ডিয়েগোর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং পিপল’স গভমেন্ট: অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ডেমোক্রেসি গ্রন্থের লেখক ডেল ডিকসন। তার কাছ থেকেও জানা গেছে প্রাচীন ভোটের ইতিহাস।

তিনি জানান, সাধারণত গ্রিকবাসীর তেমন কোনও নির্বাচন ছিল না। সেখানে পোস্টাল বা স্কুল-চার্চে গিয়ে নিজেদের ব্যালট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। নির্বাচনে শারিরীকভাবে উপস্থিত থাকতে হত। সেখান থেকেই মূলত প্রজাতন্ত্র শব্দটি পাওয়া যায়।

প্রতিদিন পর্ষদের আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করত ৫০০ জনের কাউন্সিল। এরপর সব আইন ও সরকারী নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভোট নেওয়া হত। হাত তুলেই নিজেদের ভোট দিতেন সদস্যরা। জয়ী কে হলেন, তা নির্ধারণ করতেন নয়জন ‌‘প্রেসিডেন্ট’। তবে এথেন্সবাসী এক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতেন যেন কোনও দুর্নীতির আশঙ্কা না থাকে – এমনটাই বলছিলেন রবিনসন।

তিনি বলেন, “ওই নয় প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করা হতো পর্ষদের ভোটের আগে। যেন কেউ তাদের প্রভাবিত করতে না পারেন।”

তবে এথেন্সে এমন পদ খুব কম ছিল যেগুলো পর্ষদ নির্ধারণ করতো। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মিলিটারি জেনারেলদের নিয়োগ। ওই সময়ে প্রতি বছর ১০ জন জেনারেল নির্বাচনে যে ভোট হতো, তাতে ভোট দিতে হত বুড়ো আঙুল উচু-নিচু করে। 

গোপন ব্যালট হিসেবে পাথরের ব্যবহার

আইন প্রণয়নের অংশ হিসেবে, এথেন্সে সব ধরনের অপরাধমূলক ও বেসামরিক মামলায় সিদ্ধান্ত নিত পর্ষদ। সেখানে ১২ জন জুরির পাশাপাশি ২০০ থেকে ৫ হাজার মানুষ থাকত বলে জানান ডিকসন। আবার জুরির যেকোনও একজনকে বেছে নেওয়া হত বিচারক হিসেবে। হয়ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি দিতেন না, কিন্তু সব নিয়ম কানুন ও পদ্ধতি যেন ঠিকঠাক অনুসরণ করা হয় তা নিশ্চিত করতেন।

এথেন্সে আরও এক ধরনের ভোটের প্রচলন ছিল। জুরিরা একটি পাথরের তৈরি বিশেষ ধরনের ব্যালট ব্যবহার করতেন। রবিনসনের মতে, প্রত্যেক জুরিকে দুটি নুড়ি পাথর দেওয়া হত। এর একটি ভরাট, অন্যটির মাঝখানে ছিদ্র থাকত। সেখানে রাখা হত দুটি কলস। প্রথমটিতে সত্যিকারের মতামত প্রকাশ করা পাথর ফেলতে হত। দ্বিতীয়টাতে ফেলতে হত অব্যবহৃতটা। তবে কার কোনটা সেটা বোঝার উপায় ছিল না। এটাও অনেকটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই ছিল।

নির্বাসনে বিশেষ নির্বাচন

এথেন্সে আরও একটি ক্ষেত্রে ভোটের ব্যবহার ছিল। কেউ খুব জনপ্রিয় হয়ে গণতন্ত্রের ভালোর জন্য ক্ষতিকর হলে বিশেষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে ১০ বছরের জন্য বহিষ্কার করা যেত। এই ভোটের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো মৃৎপাত্রের অংশ। পর্ষদের সবার হাতে একটি করে পটারি দেওয়া হত। সেখানে কোনও একজনের নাম লিখতে হতো। যদি ৬ হাজার মানুষ একজনের এক নাম লিখত তাহলে তাকে ‌১০ বছরের জন্য এথেন্সের বাইরে পাঠানো হত- এমনটাই লিখেছেন ডিকসন। 

রবিনসন তার ‘ডেমোক্রেসি বিয়ন্ড অ্যাথেন্স’ বইয়ে বলেছেন – প্রাচীন গ্রীক শহরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় শহরের নাম এথেন্স। কিন্তু প্রতিটি মিউনিসিটিপ্যালিসি তাদের নিজস্ব ভোটদান এবং নির্বাচনের ধারা অনুসরণ করত। 

এর মধ্যে একটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রাচীন গ্রীসের স্পার্টা শহরের নাম। সেখানে গণতান্ত্রিক পথ ছিল না। কিন্তু কিছু গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল। স্পার্টার সবচেয়ে ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর নাম ‘কাউন্সিল অব এল্ডার্স’। সেখানে দুজন স্পার্টান রাজা এবং ২৮ জন নির্বাচিত কর্মকর্তা থাকত। তাদের সবার বয়স হতে হতো ৬০ বছরের বেশি। 

শূন্য আসনগুলো পরিপূর্ণ করতে স্পার্টানরা এক অদ্ভূত ধরনের চিৎকার ব্যবহার করতো। রবিনসন বলেন, “এটাকে বলা যায় প্রশংসার মাধ্যমে ভোটগ্রহণ। প্রত্যেক প্রার্থী তখন বড় অ্যাসেম্বলি ঘরে প্রবেশ করতেন। তখন মানুষ চিৎকার করে তাদের সম্মতি দিত। অন্য একটি ঘরে বিচারকরা বসে থাকতেন, যেখানে তাদের দেখা যেত না। সেখান থেকে তারা চিৎকারের মাত্রা বুঝে নির্ধারণ করতেন কে জয়ী হলো। 

রোমান রিপাবলিকের গোপন ব্যালট

রোমান রিপাবলিকেও অনেকটা এথেনিয়ান গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সেখানে নির্বাচিতদের বিভিন্ন শ্রেণি দিয়ে বিভক্ত করা হত। তবে সেখানে এমন একটি পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল যা ছিল ধনীদের পক্ষে।

রোমান রিপাবলিকে এথেন্সের মতো ভোটের পদ্ধতি শুরু হলেও সময়ের পরিবর্তনে তা বদলে যায়। প্রথম দিকে পর্ষদের প্রত্যেক সদস্য হাত উচিয়ে উন্মুক্তভাবে নিজের ভোট দিত। কিন্তু ক্রমশ পরিষ্কার হয়, ‌ধনী পৃষ্ঠপোষকরা রোমান অ্যাসেম্বলিকে কোনও না কোনওভাবে চাপ দিতে শুরু করে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভোট হবে গোপনে। 

১৩৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোম নতুন ধরনের গোপন ব্যালট নিয়ে আসে। সেখানে থাকতো কাঠের ট্যাবলেট এবং একটি মোমের তৈরি শিট। রবিনসন বলেন “সেখানে ভোটার তার ভোট মোম শিট দিয়ে লিখে পুরো ট্যাবলেটটি ব্যালট বক্সে ফেলত।”

তখন থেকেই শুরু হয় গোপন ব্যালটের প্রচলন। এরপর ধীরে ধীরে নানা সময়ে এই ধারায়  পরিবর্তন এসেছে। কিছু যুক্ত হয়েছে, কিছু বিষয় বাদও গেছে।

জর্জ কালেব ব্রিংহ্যামের ১৮৪৬ সালে আঁকা ছবিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক ভোটকেন্দ্রে ভোটের বিচারক ভোটারকে শপথ পড়াচ্ছেন।

ভারতীয় সমাজে নির্বাচন

ভারতীয় সমাজের বৈদিক যুগেও নির্বাচনের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে রাজা সব সময় ক্ষত্রিয়দের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হত। তবু রাজা নির্বাচনে গণদের কথাই ছিল শেষ। এছাড়া বংশীয় ধারা রক্ষার জন্য প্রচলিত নিয়ম ভেঙে প্রাচীন ভারতে কখনও কখনও স্থানীয় প্রধান নির্বাচিত করা হত।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগে ছিল ভোটের ব্যবস্থা। এই দুই সাম্রাজ্যেই ধণী ও ব্রাহ্মণ পুরুষদের ভোটাধিকার ছিল। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কাঠি, কড়ির ব্যবহার ছিল। তবে ভারতীয় সমাজে গোপন ভোটের ব্যবস্থা অনেক পরে হয়েছে।

দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে ভোটের অধিকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দাসেদেরও ছিল। সেখানে ভোটের প্রক্রিয়া ছিল প্রতিনিধিত্বমূলক।

আধুনিক বিশ্বে নির্বাচন

আধুনিক বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থার যাত্রা হয় ত্রয়োদশ শতকে। ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। এরপর ১৬৯৪ সালে ট্রিনিয়্যাল অ্যাক্ট ও ১৭১৬ সালের সেপ্টেনিয়্যাল অ্যাক্টের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ পায়। ১৮৭২ সালে গোপনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে হত। এরপর ১৯২৮ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকার নীতি নেওয়া হয়।

এরপরই ক্রমশ এই নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। একসময় যুক্ত হয় প্রতীক। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে শনাক্তের জন্য প্রতিটি দলকে আলাদা প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। বিশেষ করে ভোটারদের কাছে নিজেদের চেনার সুবিধার্থে নির্বাচনের সময় দলগুলো প্রতীকের ব্যবহার করে।

রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত প্রতীক হিসেবে বেছে নেয় দলের ভাবমূর্তি বা দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো চিহ্ন। পাশাপাশি নিজেদের চরিত্র চেনাতে বিশেষ রংয়েরও ব্যবহার করে দলগুলো। যেমন, রক্ষণশীল দলগুলো সাধারণত কালো বা নীল রঙ ব্যবহার করে। গোলাপী কখনও কখনও সমাজবাদীদের পরিচয় বহন করে। আবার উদারপন্থা বোঝাতে প্রায়ই হলুদ রঙ ব্যবহার হয়।

বাংলায় নির্বাচন

উনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে বাংলায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। ১৯০৯ সালের দিকে ভারত শাসন আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় আইনসভায় নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। ভারত শাসন আইনের আওতায় ভোটাধিকার ও নির্বাচন সংস্থাকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করা হয় ১৯১৯ সালে। এরপর ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক আইন পরিষদে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়। 

এরপর কালের পরিক্রমায় নির্বাচনী ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক ব্যালট, ইভিএমসহ নতুন সব প্রযুক্তি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত